
ফজরের নামাজের পরে। ভোর সূর্যের কাছাকাছি। সবেমাত্র বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছি। ঠিক তখনই কাকপক্ষীর ডাক। মা গিয়ে হুঁশ হুঁশ তাড়িয়ে দিল। আর বলতে লাগলো, সক্কাল সক্কাল কাক ডাকে, না জানি কোন বিপদ আছে?
কথাটি মাটিতে পড়ে আত্মসমর্পণই করতে পারলো না। কান্নাকাটির শব্দ এসে ভিড় করলো উঠানে। হাউমাউ করে কান্না। যে কান্নায় হৃৎপিণ্ড কাঁদে। আর অশ্রু-শিশির গড়াগড়ি করে। আর দেহপিঞ্জর নিবুনিবু করে।
মা একা-একাই বলল, যা ভেবেছিলাম তাই। না জানি আবার কি হলো? এই মিল্টন! এই মিল্টন! কিরে শুনছিস না? দ্যাখ তো কি হলো?
নিমাই দাদা হিন্দু মানুষ। সাতসকালে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু একই পাড়ায় থাকি। প্রায়ই সুখদুখমাখা কথা বলে। তখন তাকে হিন্দু নাকি মুসলিম সেটা মনে হয় না। মনে হয় একই জ্বালায় জ্বলছি। ক্ষুধার জ্বালায়।
উঠোন বরাবর যেতেই দেহ থেকে আত্মাটুকু ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো। দেহের কলকব্জায় ঝং ধরেছে। দেহ যন্ত্রটি হঠাৎই থমকে গেছে। ঘষাঘষি করলেও প্রাণ ফিরে পাবে না।
বারান্দার ছাউনি বরাবর। তুলসীগাছের কাছাকাছি। ছাউনি পেরোতেই হাতের বাম পাশে। কয়েকটি কাঠের তক্তার উপর মুখউজ্জ্বল দেহখানা রাখা। একমাত্র মেয়ে ধরিত্রীর। ৯ বছর বয়স। বুঝতে বাকী রইলো না।
জিহ্বা দেখা যাচ্ছে। চোখদুটো বড়সড়। চুলগুলো এলোমেলো অগোছালো। চেহারাটা বিবর্ণ, বিভৎস। গলায় দড়ির দাগ। দড়ির ঘষাঘষিতে একপাশের চামড়া উঠে গেছে। বাকিটুকু কালো। নাকে রক্তবমি। এখনো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। পরনের জামা নাকের রক্তে লাল। পায়ের আঙুলগুলো বাঁকানো। পলক পড়লেই শরীরটা ঝিনঝিন করে ওঠে।
বউদি অজ্ঞান অবচেতন। বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। মাথার কাছাকাছি অশ্রুপাতের জলে কাঁদায় পরিপূর্ণ। মাটি থাপড়াইয়া থাপড়াইয়া নিচু করে ফেলেছে।
নিমাইদা এখনো কাঁদছে। হৃদয় পোড়া আর্তনাদে কাঁদছে। দুঃখকষ্টের আহাজারিতে কাঁদছে আর বলছে রাতে বারবার ভাত চেয়ে না পেয়ে কখন যে মেয়েটি আমার গলায় দড়ি দিছে। আমি আর ধরিত্রীর মা কিছুই জানিনা।
নিমাইদা আবার কেঁদে কেঁদে বলে উঠলো, ‘মহাজন রে! কত্তো রে কইলাম আমাকে কিচ্ছু টাকা ধার দ্যান কিন্তু সে দিলোই না। দিলে হয়তো মাইয়াডা আমার…।
নিমাইদা তাঁত শ্রমিক। তাঁতের ব্যবসাও আর আগের মতো নেই। তারপরও আবার করোনা পরিস্থিতিতে তাঁতের কাজ বন্ধ। আর শ্রমিকদের কাছে টাকা পয়সা জমানো থাকে না। তারা দিন আনে দিন খায়।
প্রচন্ড পানি ঢালার পর জ্ঞান ফেরে বউদির। জ্ঞান ফেরার সাথেই আবার হাউমাউ করে কাঁদে আর বলে, মেয়েটি গতরাতে শ্যাষম্যাশ নুনভাত চেয়েছিল কিন্তু সেটাও…।
নিমাইদা বলল, আমি বারবার শ্যামাকে কইলাম মিল্টনদের বাড়ি থেকে নুনভাত চেয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু ও কইলো ওরা মুসলিম। আরে! ক্ষুধা কি আর হিন্দু মুসলিম বোঝে?
পাশে আরও দুটি হিন্দু বাড়ি আছে। কিন্তু সেখানেও নিমাইদা যায়নি। তারা নাকি নিচু জাতের সাথে…।
৭টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
মনোমুগ্ধকর লিখনী, ভালো লাগলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হায়রে জাত পাত, হায়রে অভাব! মনটা ব্যথায় ভরে উঠলো। শুভ সকাল
সাবিনা ইয়াসমিন
পেটের ক্ষুধা কোনো ধর্ম মানে না। ক্ষুধার কাছে সবাই পরাজিত হয়।
গল্পের প্লট ভালো লেগেছে। তবে গলায় ফাঁসি বা আত্মহত্যার জন্যে নয় বছর বয়স একটু বেশিই কম। এত ছোট শিশুর পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব না।
নিয়মিত লেখার পাশাপাশি অন্যদের লেখাগুলোতেও সময় দিন মাসুদ ভাই।
শুভ কামনা 🌹🌹
কামাল উদ্দিন
আরে! ক্ষুধা কি আর হিন্দু মুসলিম বোঝে? এটাই জীবনের কঠিন বাস্তব। সবার রক্তের একই রং ক্ষুধার জ্বালাও তাই। নুন ভাতের জন্য এমন জীবন বিনাসী অভাব যেন কারো জীবনে না আসে সেই কামনা করছি।
সুরাইয়া পারভীন
পেটের ক্ষুধা কি আর মানে জাত পাত ধর্ম! নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের করুণ পরিণতি উল্লেখ করেছেন।
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন সবসময়
জিসান শা ইকরাম
করোনায় অনেক দুর্ঘটনার জন্ম দেবে।
ধর্ম আর জাত পাতের অন্ধত্ব আর যাবে না আমাদের সমাজ থেকে।
শুভ কামনা।
হালিম নজরুল
জাত গেল জাত গেল বলে
এ কি আজব কারখানা…..