
পর্ব -০১
অবন্তীর দাদীর বাসায় কে যেন প্রতি রাতেই বেল দিয়ে যায়। ডায়াবেটিকস, হৃদ রোগ আর হাই প্রেশারের রোগী হলেও এখনও বাহাত্তর বছর বয়েসী দাদী বেশ শক্ত সমর্থ্য আছেন। সহজে ভয় পান না। প্রায় শতবর্ষী বুড়ো দাদাকে সাথে নিয়ে একা ফ্লাটে বাস করেন। ছেলেমেয়েরা সব নিজ নিজ পরিবার নিয়ে এ বাড়িতেই আলাদা ফ্লাটে থাকে। অনেক বছর ধরেই দাদীর ঘুম পাতলা, প্রায় সারা রাতই জেগে থাকেন। ছেলেমেয়ে ভাড়াটিয়া মিলিয়ে দুই ইউনিটের চারতলা বাসা। পাঁচতলার কাজ চলছে। দারোয়ান না থাকলেও নিজেরাই গেট খোলে, নিজেরাই তালা লাগিয়ে দেয়। এ কাজটা সবসময় করে অবন্তীর ছোট চাচা আকমল। রাত বারোটার মধ্যে মেইন গেটে তালা দেয়া হয়ে যায়। নাতি নাতনীরা কেউ কেউ রাত জেগে পড়াশুনা করে কিন্তু অত রাতে এদের কেউ ঘর থেকে বেরোয় না তো মাঝ রাতে কলিংবেল বাজায় কে? এক তলায় দু’রকম ভাড়াটিয়া আছে; রাস্তার পাশেরটা একটা কোচিং সেন্টার, ক্লাস নেয়া হয়ে গেলে রাত আটটার দিকে চাবি জমা দিয়ে চলে যায়। আর পশ্চিম পাশে থাকে এক ভদ্রলোক। জুতার ব্যবসায়ী। তার সাথে বাড়ি ভাড়ার যাবতীয় কথাবার্তা হয় মেজ ছেলে আজাদের সাথে।
ঘটনার শুরু কয়েক রাত আগে। আনুমানিক দেড়টা-দুটা হবে! অবন্তী নিজের বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলো। হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠলো। ধুরুম! টঙ! বং! চমকে বই থেকে মুখ তুলে শব্দের উৎসের দিকে আবার কোন শব্দ হওয়ার অপেক্ষায় কান খাড়া করলো। ওর বিছানার ডান পাশ থেকে হাত চারেক জায়গা পরেই ওর ঘরের একমাত্র খোলা দরজাটা। তার সামনে দেড় হাত পরিমানের সামান্য একটু জায়গা ছেড়ে সামনের দিকে চল্লিশ সিএফটির ঘিয়ে রঙা নো-ফ্রস্ট ফ্রিজটা। অবন্তী বিছানায় উঠে বসলো। সেখান থেকে ডানে দরজার দিকে তাকিয়ে সোজা পশ্চিম বরাবরে ফ্রিজ তারপরে শোকেসটা এবং সেটা ছাড়িয়ে একেবারে বাইরের দরজার লুকিং গ্লাস পর্যন্ত গলা বাড়িয়ে দেখলো। অবন্তীর ঘর থেকে রান্নাঘরটা দেখা যায় না। ওটা ফ্রিজের গা ঘেঁষে ভেতর দিকে চলে গেছে উত্তর পাশে। খাবার ঘরে খাওয়ার শেষ হলে একটা সাত পাওয়ারের এনার্জি বাল্ব জ্বালানো থাকে। ওটা সারা রাত্রি ডিম লাইটেরও কাজ করে। মা শোয়ার সময় সেটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এত রাতে রান্না ঘরে হাড়িপাতিল কার হাতের খোঁচায় পড়বে? অবন্তী বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে মিনিট কয়েক একটানা ওর ঘরের দরজার দিকে চেয়ে থাকে। মা যদি রান্নাঘরে গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কথা বলতে বলতে বের হয়ে আসবে। ওর মায়ের তো একা একা কথা বলার অভ্যাস। যখন যা করছেন ভাবছেন তা জোরে জোরে বলে। যেমন এখনই অভ্যাসবশতঃ পড়ে যাওয়া হাড়ি পাতিলের উদ্দেশে মায়ের বলে ওঠার কথা- ‘পড়োস ক্যান? ভাত খাস না?’ আর অবন্তীর রুমের দিকে তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বিরক্ত মুখে বলার কথা-‘এখনো ঘুমাও নাই? চেহারার তো বারোটা বাজাচ্ছো রাত জেগে জেগে!’ এটা মায়ের কমন ডায়ালগ! কিন্তু না! যেটুক সময়ে মা এসব করবে বা বলবে তার চেয়ে বেশি সময় ধরে নিজের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো অবন্তী। অথচ মা’কে ফ্রিজের কোণা থেকে বের হয়ে আসতে দেখলো না। মা তাহলে এদিকে আসেইনি।
এ বাসায় পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর। একটায় ও থাকে। আরেকটায় বাবা-মা। বাবা তো বাসায় নেই। মাকে ঘুম থেকে ডাকা উচিত কিনা বুঝতে পারছে না। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসা উচিত। কিন্তু ওর ভয় লাগছে। এমনিতেও ও বেশি রাতে রান্নাঘরের দিকে যায় না। ও পুনরায় বইয়ের ভেতরে মনযোগ দিতে চাইলো। কিন্তু আর মন বসাতে পারলো না। মাঝে মাঝে রান্নাঘরের থাইয়ের জানালার লক লাগানো হয় না, চাপিয়ে রাখা হয়। চাপিয়ে রাখা জানালার পাল্লা টেনে খুলে নিশ্চয়ই বিড়াল ঢুকবে না! মনের অজান্তেই ওর গা ছম ছম করে উঠলো। হাড়িপাতিল পড়ার শব্দটা পরিস্কার শুনলো ও। এত জোরে শব্দ হলো অথচ মা কেন শোয়া থেকে উঠে এলো না? অবন্তী কি তাহলে ভুল শুনলো? কিছুই বুঝলো না ব্যাপারটা। বইটা বন্ধ করে ও লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরলো। চোখ প্রায় বুঁজেই এসেছিলো। বাম কাত হয়ে শুয়ে ছিলো। হঠাৎ মনে হলো বিছানার পাশে কী কেউ এসে দাঁড়িয়েছে? কথাটা ভাবতেই গা শিরশির করে উঠলো। এখন যদি ওর দিকে উবু হয়ে এসে ওর ঘাড় মটকে দেয়? এটা মনে হতেই ও বাম কাত থেকে সোজা হয়ে চিত হয়ে শোয়। ডান কাত হয়ে দেখে কেউ নেই। মনের ভুল। ঘরের ভেতরে তেতুল রঙা লম্বা আলমারী। লম্বা লম্বা পর্দা। অন্ধকারে ভয় লাগে! খানিক পরেই বিছানার লাগোয়া জানালার বাইরে ধুপ ধুপ টুপ টুপ শব্দ হতে থাকে। জানালার খুব কাছেই রয়েছে কেউ! ভুত নাকি! ভৌতিক সিনেমাগুলোতে যেমন দেখায়-শব্দের উৎস খুঁজতে জানালার পর্দা সরাতেই জানালার গ্লাসে বীভৎস মুখ উঁকি দেয় সে কথা মনে পরতেই অবন্তী আরও তীব্রভাবে চোখ বুঁজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে থাকে। ভৌতিক যে কোন কিছু থেকে অবন্তী দূরেই থাকে; এসব ওর নার্ভে সয় না! কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না মনে হলো কেউ ওর নাম ধরে খুব জোরে ডাকছে-“অবন্তী! এই অবন্তী!” অন্ধকারে চোখ খুলে বিছানার সামনে একটা ছায়া দেখে “ও মা-গো!” বলে ধরমড়িয়ে উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ডেই বোধ ফিরে পেলো। “ওহ মা!”
“অবন্তী, ঘরে চোর এসেছিলো! দেখে যা!” বলে মা ছুটে গেলো নিজের ঘরে। অবন্তীও মায়ের পিছন পিছন গিয়ে যা দেখলো তাতে একই সাথে অবাক এবং ভয়ে শিউরে উঠলো- “একী!” ও দেখলো মায়ের বিছানার সাথের লাগোয়া থাইয়ের গ্লাসের জানালার এক পাল্লা টেনে সরানো আর পর্দাটা ভাঁজ করে উঠিয়ে রাখা। আর মায়ের বালিশের পাশে এক হাত সমান একটা দু’ইঞ্চি চওড়া কাঠের টুকরা রাখা। মা ভয়ার্ত গলায় বললো-“অবন্তী, মোবাইল ফোনটা নিয়ে গেছে!”
অবন্তী মোবাইলের চেয়ে কাঠের টুকরাটা নিয়েই ভাবছে। চোর যদি মায়ের মাথাটা ফাঁটিয়ে রেখে যেত ও তো এতীম হয়ে যেতো!
ভোর হয়ে এসেছে। মা-মেয়ে দুজনে থম ধরে বসে আছে। এতক্ষণ চোরের কাণ্ডে অবন্তী ভুলে গিয়েছিলো! এখন বললো, “রাত দেড়টার দিকে রান্নাঘরে পাতিল পরে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। তখনই এসেছিলো নাকি?”
মা শুনে অবাক হয়ে গেলো-“তাই নাকি? আমাকে ডাকো নাই কেন? তাইতো ভাবছি রান্নাঘরের জানালাটা এতখানি ফাঁক করা কেন? আমিতো ভেবেছি তুমি হয়তো রান্নাঘরে চুলায় কোন কাজ করেছিলে!”
“এতো জোরে শব্দ হলো আর তুমি শুনলে না তাই ভেবেছি মনের ভুল!”
দুজনের কারোরই আর ঘুম হলো না। মা চা বানাতে বসলো। অবন্তী নিজের ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো। মা বললো, “কাকে ফোন দিচ্ছিস? এত ভোরে বাবাকে ঘুম থেকে তুলিস না।“
অবন্তী বললো, “না, বাবাকে না। তোমাকেই। দেখি চোর তোমার সিমটা এখনই বন্ধ করে দিয়েছে কিনা।”
চলবে…
১০টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
অনুপম, ভালোই হয়েছে।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
এখনো হয়নি শেষ। আরও আছে বাকী।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খালি ভয় দাও কেন? চোর তো পাক্কা চোর, কিভাবে মোবাইল টা নিয়ে গেল! এতো নিখুঁত বর্ণনা মনে হয় আমার সাথেই যেন ঘটছে। ভালো থেকো, সুস্থ থেকো। শুভ সকাল
জাকিয়া জেসমিন যূথী
তুমি তো সাহসী মেয়ে। ভয় পাবে কেন?
হ্যাঁ, দেখো না সামনে কী হয়! অপেক্ষায় থাকো। আসবো আবার রাতে। কারণ চোর ও তো রাতেই এসেছিলো… 😉
নিতাই বাবু
অবন্তীর বুদ্ধি আছে। কিন্তু বুদ্ধি সময়মতো কাজে লাগাতে পারেনি বলেই মোবাইল ফোনটা হাতছাড়া হয়েছে। তবে দেখা যাক, অবন্তীর করা কল চুরি হওয়া মোবাইলে কল হয় কিনা, কেউ কল রিসিভ করে কিনা, কোনও কথা হয় কিনা। যেহেতু গল্পের এটা প্রথম পর্ব, সেহেতু আগামী পর্বে হয়তো আমার ধারণা স্পষ্ট হতে পারে।
শুভকামনা-সহ প্রার্থনা করি এই সময়ে সপরিবারে ভালো থাকার।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
বুদ্ধিমান পাঠক। দেখা যাক, পাঠকের অনুমান এর সাথে লেখকের পথ একই দিকমুখি কিনা।
শুভকামনা-সহ প্রার্থনা করি এই সময়ে সপরিবারে ভালো থাকার। এই শুভকামনা আমাদের সবার জন্য।
সুপায়ন বড়ুয়া
মোবাইল চোরা ছিচকে চোর।
নাকি আগের মতো নাটকে ভরা।
ভালো লাগলো। শুভ কামনা।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
দেখা যাক, পরের পর্বে নাটক কোন দিকে গড়ায়।
আশা করি , পরের পর্বেও আপনাকে পাঠক হিসাবে পাবো।
সুরাইয়া পারভীন
এই তবে ঘটনা। অবন্তী যাকে ভূতের কাণ্ড বলে ভয়ে স্তব্ধ ওটা আসলে চোর বেটার কাণ্ড। দেখি পরের পর্বে কী আছে।
জিসান শা ইকরাম
যাক অল্পের উপর দিয়ে মানে মোবাইয়ের উপর দিয়ে গিয়েছে এবার। কিন্তু রান্নাঘরের শব্দে অবন্তির মা এর ঘুম ভাংগালো না কেন?
পারিপার্শ্বিক অবস্থার নিখুত বর্ননা।
পরের পর্বে যাচ্ছি।
শুভ কামনা।