সক্কাল থেইক্কায় লাল্টুর মনভার। এমনিতেই মনভার। কোন কারণ নেই। তবে, মুখটা শুকনো শুকনো। চেহারায় হারানোর অভাব। কে যেন হারিয়ে গ্যাছে তার থেইক্কা। চিরতরের হারিয়ে যাওয়া।
ভাইয়া, কি অইসে তর? মুখডা শুকনো শুকনো লাগছে যে।
নারে বইন, কিচ্চু অয়নাই। এমনিতেই…
না না! তুই মন অয় আমার কাচে কিচু লুকচ্ছিস। কি লুকচ্ছিস বলনা?
আরে না! কিচুই লুকচ্ছি না। তবে কেমন যেন লাগছে।
কেমন আর লাগবে, এহন পর্যন্ত একটা বিড়িও ধরাস নাই। এইজন্য মন অয় এইরহম লাগচে।
হ, তুইতো ঠিক কথাই কইচিস বইন। এইজন্যই তো মনে অয় এইরহম লাগছে।
একটা বিড়ি ধরাগা। দেকবি সবকিচু ঠিক। তোর তো আবার বিড়ি না খাইলে…। খলখলে হেসে উঠলো মণি।
ও কথাডাই আর বাকী রাখলী ক্যা? প্রতিদিনই তো কস। আইজক্যাও না হয় বললি।
আমি কি মিছা কথা কই?
না, মিছা কথা কবি ক্যা। তুইতো সত্য ছাড়া কুনো কথাই কস না।
অইচে অইচে। এহন যা।
মোবাইল বেজে উঠলো। ‘ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না’ – রিংটোন বাজছে। রিসিভ করতেই লাল্টুর মুখটি যেন আরও চুপসে গেলো। হঠাৎই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। পুরুষের কান্না। বেশি দূর পৌঁছায় না। গলার মধ্যে খিল লেগে গেছে। কোন কথা বলতে পারছে না সে। দম ফুরিয়ে যাচ্ছে তার।
কে ফোন দিচেরে ভাই? ক্যারে কথা কস না ক্যা? কি অইলো? ক্যারে ভাই?
না, লাল্টুর কোন সাড়াশব্দ নেই। কোন কথাও বলছে না সে। একদম নিশ্চুপ, চুপচাপ।
মণি কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, ‘ক্যারে মিয়া ভাই কুনো কথার…’। হঠাৎই ভয় পেয়ে যায় মণি। বুক ধড়ফড় করে ওঠে তার। থতমত অবস্থা।
আস্তে আস্তে লাল্টুর পাশে গিয়ে বসে সে। জিজ্ঞেস করে, কি অইসে? কিন্তু লাল্টু কোন কথা বলে না। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে বুক অবধি। মোবাইলে কে যেন তখনও হ্যালো হ্যালো করছে।
মণির কন্ঠে হ্যালো শব্দটি শোনার পর ওপাশ থেকে গড়গড় করে কথা বলতে লাগলো। মণি শুধু চুপচাপ শুনছে। কোন কথা বলছে না। লাইনটি কেটে যাওয়ার পরপরই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো মণি। কান্নার শব্দ শুনে আশেপাশের রুমের লোকজন এসে ভিড় করলো। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলো- কি হয়েছে, কি হয়েছে? মণি মা মা করে কাঁদছে।
পাশের রুমের শিউলি আন্টি অফিসের সুপারভাইজারকে ফোন দিয়ে বললো, মণি-লাল্টুর মা মরে গেছে।
মণি-লাল্টু গ্রামে রওনা দিয়েছে। কিন্তু পথ যেন আজ ফুরচ্ছেই না। যতই রাস্তা অতিক্রম করছে ততই যেন দূরত্ব বাড়ছে। ততই যেন সুঁই সুতোয় দুঃখগুলো গেঁথে যাচ্ছে। ততই যেন কষ্ট আরও কাছাকাছি এসে বসবাস করছে।
বাস চলছে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই কেঁদে কেঁদে উঠছে দুই ভাইবোন। ডুকরে ডুকরে কাঁদা। সত্যি! এ কাঁদায় দুঃখ বেশি, কষ্ট বেশি।
১২ টা বেজে কয়েক মিনিটে বাস এসে থামলো। তারপর রিকশা চেপে গ্রামের রাস্তার মোড়ে আসতেই মণি-লাল্টুর কান্নাকাটি আরও বেড়ে গেলো। লোকজন এসে ভিড় জমালো। কেউ একজন বললো, দুজনকে ধরে নিয়া যা।
পুকুর পাড়ের কাছাকাছি এসেই দাঁত লেগে যায় মণির। লাল্টু হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। বাড়ির উঠান বরাবর লাশের খাটিয়া দেখে বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটে পড়ে লাল্টু। কাছের আত্মীয় স্বজনরা এসে লাল্টুর মাথায় পানি ঢালতে থাকে। একটু হুঁশ ফিরলে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে এজন্যই সক্কাল থেইক্কাই মনে হচ্ছে কি যেন হারায়ছি! কি যেন হারায়ছি! কিন্তু মা তোমাকে যে হারায়ছি বুইঝতে পারি নাই। তুমিও চইল্যা গ্যালা, আমাদের আর রইল কে?
১৫টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
মা, যিনি কাছে না থাকলেও তার স্নেহ-স্পর্শ সন্তানকে ঘিরে থাকে। যে কান্নায় প্রিয়জনকে হারানোর ব্যাথা থাকে সেই কান্নায় দুঃখ, কষ্ট অত্যন্ত বেশি। তাই কারো বাড়িতে কেউ মারা গেলে তাদের আশেপাশের মানুষেরা কান্না শুনলেই বুঝতে পারে ঐ বাড়িতে কি হয়েছে। অণুগল্প ভালো লাগলো।
শুভ কামনা 🌹🌹
মুহাম্মাদ মাসুদ
ধন্যবাদ , ঠিক বলেছেন।
আলমগীর সরকার লিটন
চমৎকার লাগল
মুহাম্মাদ মাসুদ
♥️♥️♥️♥️ ভালোবাসা রইলো …
রেজওয়ানা কবির
শিরোনামটা খুবই পছন্দ হয়েছে।ভালো থাকবেন। শুভকামনা।
মুহাম্মাদ মাসুদ
ধন্যবাদ, আপনিও ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন করোনা থেকে মুক্ত থাকুন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
শিরোনামেই বাজিমাত। চমৎকার হয়েছে আনুগল্প। আপনজন মারা গেলে এমনি মনের মধ্যে অস্থিরতা ভর করে। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
মুহাম্মাদ মাসুদ
খুশি হলাম, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। নিজেকে এ অবস্থায় দাড় করাতে ভালো লাগলো না। মা গেলে পাব কই?
শুভ কামনা রইলো।
মুহাম্মাদ মাসুদ
ঠিক বলেছেন, আমার নিজেরও বারবার একথাই মনে হয়েছে। মা অমূল্য সম্পদ।
আরজু মুক্তা
আমার মা যখন মারা যান। সেদিনও আমার বুকের ভেতরটা কেমন করছিলো। বুঝিনি সকালে দুঃসংবাদ আসবে।
মুহাম্মাদ মাসুদ
আহারে! কলিজার সম্পর্ক এমনই। আল্লাহ পাক আপনার আম্মুকে জান্নাত দান করুক। দোয়া রইলো।
আরজু মুক্তা
আমিন
উর্বশী
শিরোনাম ই থমকে যাওয়া। যার আপনজন চলে যায়, একমাত্র তার গভীরতা সেই কেবল বুঝতে পারেন,কি নেই,কি হারিয়েছেন।সব মায়েদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
ভাল থাকুন,অফুরান শুভ কামনা সব সময়।
মুহম্মদ মাসুদ
ধন্যবাদ প্রিয় । অনেক অনেক ভালোবাসা