ঢাকার আফতাব নগরে সেই সময় ভিতরের অনেকটা এলাকা জুড়ে কাঁশবনের প্রাধান্য ছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে অনুজ ফটোগ্রাফার জাহিদের অনুরোধে প্রথম গিয়েছিলাম। তারপর আফতাব নগরে বহুবার যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ফটোগ্রাফীর জন্য আর যাওয়া হয়নি। সেদিন আবহাওয়া অনুকুলে না থাকায় আমরা স্পটটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। তার মূলঃকারন ছিলো পাখির অবস্থান ও অভ্যাস পর্যবেক্ষন করা। যেন পরবর্তীতে আসলে বুঝা যায় কোথায় কোন পাখির বিচরন। আমরা দুজন গল্প করছি আর হাঁটছি। হঠাৎ জাহিদ থেমে গেল। আমি বেশ কিছুটা পথ সামনে চলে গেলাম। জাহিদের কন্ঠ শুনতে না পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি একটা ঝোপের আড়ালে বসে রয়েছে। আমাকে হাত দিয়ে ইশারায় ডাকছে। কৌতুহুল নিয়ে আমি দ্রুত গতিতে ওর সামনে গেলাম। জাহিদ আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখাচ্ছে আর ফিঁসফিঁস করে বলছে, স্যার,এই পাখিতো জীবনে দেখি নাই। আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম। জাহিদের কথার উত্তর না দিয়ে পাখিটির ছবি তোলার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। এমন জায়গায় পাখি দুটি বসা ছিল তাতে ফোকাস করা সম্ভব হচ্ছিল না। সামনে ও দুই পাশে ডাল। ফোকাস করতে গেলেই ডালে ফোকাস হয়ে বসে থাকে। অনেক্ষন চুপ করে বসে রইলাম। এই আশায় যদি একটু নড়াচড়া করে ডানে বা বামে বসে তাহলে অন্ততঃ পাখিটির ছবি তুলতে পারবো। এরই মাঝে পাখিটি একটু সরে অন্য ডালে বসলো। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না। কারন পর্যাপ্ত আলো না থাকায় ছবি পরিস্কার হচ্ছিলো না। হঠাৎ খেয়ার হলো যে, যদি উড়ে যায় তাহলে রেকর্ড শট আর নেয়া হবে না। তাই ক্যামেরার আই,এস,ও বাড়িয়ে কয়েকটি ক্লিক করলাম। ছবির মান খুবই খারাপ হলেও পাখিটি বুঝা যাচ্ছিলো। এতটুকু সান্তনা নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে আসলাম।
বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলাম। তারা আরো ডিটেইলস ছবি চায়। নইলে আই,ডি করা সম্ভব নয়। তবে রেজা খান স্যার বললেন মুনিয়া প্রজাতির পাখি। এখানেই পাখিটির সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে উত্তরায় গেলাম লাল মুনিয়ার ছবি তোলার জন্য। লাল মুনিয়ার সঙ্গে অন্য মুনিয়ারও ছবি তুলছি। এমন সময় এক জোড়া আফতাব নগরের সেই পাখিটি কাঁশবনের একটি ডালে বসলো। পাখি দুটির ভারে কাঁশ ডালটি নুঁইয়ে পড়লো। সব বাদ দিয়ে সেই পাখির ছবি তোলায় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। চকচকা ঝকঝকা ছবি দেখে মনটা ভরে গেল। পরে জানতে পারলাম গবেষকরা এই পাখিটিকে Chest-nut Muniaপ্রজাতি থেকে আলাদা করে ভিন্ন একটি প্রজাতি হিসেবে রেকর্ড করেছে। যার নাম দিয়েছে Tri-colored Munia বা ত্রিরঙ্গা মুনিয়া। তার পূর্বে সারা বিশ্বে ৫ প্রজাতি মুনিয়ার নাম রেকর্ড ছিলো। এই প্রজাতিকে আলাদা করায় এখন ৬ প্রজাতির মুনিয়ার দেখা পাওয়া যায়।
Tri-colored Munia বা ত্রিরঙ্গা মুনিয়া Estrildidae পরিবারের Lonchura গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ১২ সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যের ১১ গ্রাম ওজনের ছোট আকারের তৃনভোজী পাখি। এরা মূলত কালো-মাথা মুনিয়া পরিবারে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। পরবর্তীতে এদের অভ্যাস, বিচরন ও খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়ায় পাখি বিজ্ঞানীরা এই পাখিকে ভিন্ন একটি গোত্রে ও পরিবারে আলাদার করেন। যদিও এদের malaccaপরিবার থেকে আলাদা করেছে তারপরও এখন পর্যন্ত এই গোত্রীয় পাখি নিয়ে ব্যাপক গবেষনা চলছে। গবেষনার শেষ ফলাফল না জানা পর্যন্ত এই পাখিটিকে গবেষকরা এস্ট্রিলিডি পরিবারে ভাগ করেছেন। যার জন্য এখন পর্যন্ত এই পাখি নিয়ে বিস্তর কোন তথ্য প্রকাশ হয়নি। তবে এদের প্রজনন,বিচরন,অভ্যাস ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাওয়ায় সেই নিয়ে গবেষকরা একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন। পরবর্তীতে আমরা এই পাখিটি নিয়ে বিস্তর জানার সুযোগ পাবো
এদের মাথা কালো,বুক সাদা ও পিঠ সম্পূর্ন খয়েরী রঙের। ঠোঁট স্লেট-কালো। বুকের সাদা অংশ থেকে দেহের নীচতলা পর্যন্ত কালো। পা ও পায়ের পাতা কালো। চোখ কালো রঙের। লেজের অগ্রভাগ উজ্জল খয়েরী।
ত্রি-রঙ্গা মুনিয়া ছোট ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গলা ও কাঁশবনে বিচরন করে। এরা অন্যান্য মুনিয়ার সঙ্গে একই ঝাঁকে থাকে। যদিও এরা অন্যান্য মুনিয়া মতন খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত নয়। এদের খাবারে কিছুটা ভিন্নতা আছে। এরা শুস্ক খাবার খায় না। ঘাসের বিঁচি, শস্যদানা ও জংলী ছোট জাতের ফলের রস এদের প্রধান খাবার। সেপ্টম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে মেয়েপাখি তৃণলতা,ছন ও খড়কুটা দিয়ে ছোট্ট করে বাটির মতন বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখি ৬-৮টি ডিম দেয়। মেয়ে ও ছেলেপাখি উভয়েই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়। ১৯-২১দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে। বাবা ও মা দুজনেই বাচ্চাদের পরিচর্যা করে থাকে। জন্মের ২৩ দিন পর ছানাগুলি বাসা ছেড়ে চলে যায়।
বাংলাদেশের ঢাকা,সিলেট,রাজশাহী সহ বেশ কয়েকটি জেলায় এদের দেখা যায়। ইহা ছাড়া ভারত,মালদ্বীপ,শ্রীলংকা,পাকিস্তান, নেপাল ভুটান সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা জুড়ে এদের বিস্তৃত রয়েছে।
ত্রি-রঙা মুনিয়া চমৎকার লাগলো। ৬ প্রজাতির মুনিয়া আছে তথ্যটি জানতে পারলাম। একই ঘরানার হলেও এদের জীবন বৈচিত্র্য কিছুটা ভিন্ন। অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
১২টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ত্রি-রঙা মুনিয়া চমৎকার লাগলো। ৬ প্রজাতির মুনিয়া আছে তথ্যটি জানতে পারলাম। একই ঘরানার হলেও এদের জীবন বৈচিত্র্য কিছুটা ভিন্ন। অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো দিদিভাই।
রোকসানা খন্দকার রুকু
৬-৮ টি ডিম দেয়। বাচ্চারা এত তারাতারি বড় হয়ে যায়। পাখিরা কি সুন্দর। অনেক পাখির খবর জানা হল।
শুভ কামনা ভাইয়া। শুভ সকাল।
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্যও রইলো শুভ কামনা।
আলমগীর সরকার লিটন
সত্যই খুব সুন্দর পাখি প্রিয় শামীম দা
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ কবি দা।
আরজু মুক্তা
কতো মুনিয়া! কতো অজানাকে জানলাম।
শামীম চৌধুরী
জানাতে পেরে খুব আনন্দ লাগছে আপু। শুভ কামনা রইলো।
প্রদীপ চক্রবর্তী
৬ জাতের মুনিয়া নিয়ে বিস্তারিত লেখনী।
খুবি ভালো লাগলো,দাদা।
আপনি সবসময় সেরা।
এমন ভালো ভালো ছবি ও লেখা আপনিই উপহার দেন
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ দাদাভাই।
তৌহিদ
সব মুনিয়া নিয়েই চমৎকার একটি ধারাবাহিক লেখা পড়লাম ভাই। এসবই পাঠকদের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে অবশ্যই।
শুভকামনা সবসময়।
শামীম চৌধুরী
শুভেচ্ছা নিও।