তিনটি অণুগল্প পোষ্ট করছি…
একঃ সময়সীমা মধ্যরাত
>>>>>>>>>>>>>>>>>
সময় তখন মধ্যরাত।
দুই বাচ্চাকে পাশে নিয়ে জেসমিন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। কি মায়া নিয়ে ওরা তিনজন ঘুমের ভিতরেও শিহাবকে আকর্ষণ করে চলে। সে চোখ আর ফিরাতে পারে না। কিছুক্ষণ আগে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক লেনদেন এর সময় ও এই মায়াটা দেখতে পায় নি শিহাব। তখন আসলে দেখার কিছু থাকে ও না। মায়া হয়তো ঠিকই ছিল!
ল্যাপটপটা শিহাবের বুকের উপরে রয়েছে।
ওটার থাকার কথা কোলের উপরে। কিন্তু এমন পজিশনে সে শুয়ে আছে যে বুকের উপরেই পারফেক্ট। একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে সে।
নীলা…
রত্নের মতোই এই মানবী নীলা ওর জীবনে ‘স্যুট’ করে নাই। আগে ও না… এখনো করবে না… আর ভবিষ্যত? সেটা ও কি বর্তমানই নির্ধারণ করবে?
একসময় পাগলের মতো নীলাকে ভালবেসেছে। সে ও প্রথম দিকে ওর সাথে তাল মিলিয়েছে। কিন্তু পরে ওকে ছেড়ে ইকবালের হাত ধরে ঘর বেঁধেছে। এখন আবার ওর কাছে সে ফিরে আসতে চাইছে। সেদিন নীলার সাথে ইকবালের এখনকার ‘বিহেভিয়ার’ সব ই ওকে নীলা অকপটে জানিয়েছে। কি যন্ত্রণার ভিতর সে আছে সেটা ও শিহাব বুঝতে পারছে।
কিন্তু আজ নীলার জন্য ওর হৃদয়ে আসলে কোনো কিছুই নেই। এটা সে একটু আগে বুঝতে পেরেছে। হৃদয় একটা নরম জিনিস হলেও সেটা বার বার কাউকে দেয়া যায় না। ওর হৃদয়ে এখন শুধুই জেসমিন… ঘুমন্ত জেসমিনের দিকে তাকিয়ে শিহাব ওর হৃদয়ের গভীরতাকে আরো ভালভাবে অনুধাবন করে। একটু ধরতে ইচ্ছে করে… ঘুম থেকে জাগিয়ে বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করে!!
কিছুক্ষণ আগে মাঝরাত পার হলো। নীলা শিহাবের মোবাইলে ফোন করেছিল। ওর ‘ ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট অ্যাক্সেপ্ট’ করার জন্য দ্বিতীয়বার অনুরোধ করেছে। আচ্ছা দেখি বলে ফোন রেখে দিয়েছে শিহাব।
ওর সামনে নীলার পেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট…
পাশে ঘুমন্ত জেসমিন…
মনের চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পায় সেখানে দাঁড়ানো পিছনে নীলার অতীত…
বর্তমানের নীলা এক অসহায় নীলা। সে জীবনের এই প্রান্তে এসে তার হৃদয় যে মানুষটিকে দিয়েছিল বিশ্বাস করে- তার দ্বারাই নিঃশেষ হচ্ছে প্রতি নিয়ত। এখন আবার ফিরে আসতে চাচ্ছে ওকে যে ভালবাসতো তার কাছে। কিন্তু সে যে এখন আর তার নেই। জেসমিন নামের আর এক ফুলের সাথে সে জড়িয়ে আছে… ভালবাসার বন্ধনে।
যে বাঁধন নীলা ইচ্ছে করেই খুলে পালিয়েছিল।
আজ তার হৃদয়ে আদৌ কি কারো জন্য ভালবাসা রয়েছে?
এক হৃদয় ক’জনকে ভালবাসতে পারে?
শিহাবের হৃদয়ে নীলার জন্য এখন এক বিশাল শুন্যতা ছাড়া কিছুই নেই।
ওর ফেসবুক আইডিতে নীলা নামের একজনের ‘পেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট’ থেকেই যায়… সময়সীমা পার হলেই নীলা বুঝে যাবে। ফিরে যাবে নিজের কুহকী প্রহর মাঝে।
.. … ….
দুইঃ একজন লীলাবতী
>>>>>>>>>>>>>>>
বন্ধুর খোলসে সে কাছে আসে। এরপর তাঁর নিজের ধ্যানধারণা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা। একটু লোভ দেখায়… নিজের প্রকৃতিদত্ত সম্পদকে কাজে লাগানোর চেষ্টা ও করে। প্লাস তো মাইনাসের দিকেই ছুটবে। এরপর শুরু হয় আসল খেলা। ভালোবাসাকে একটা দুর্ভেদ্য কাঁচের গোলকে আবদ্ধ করে দূর থেকে দেখিয়ে দেখিয়ে শুধু ছুটিয়ে বেড়ানো।
এরপর…
ক্লান্ত-বিপর্যস্ত এক রিক্ত মুসাফিরের মতো খড়কুটো কে আঁকড়ে ধরে পথে চলার চেষ্টা। ঠিক সেই সময়ে আবারও হাজির হয় কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে। এক পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অর্পণ করা ভালোবাসাকে তাঁর কালো মনের ভিতরে সে কীভাবে নিবে?
তাই সে হতে পারেনা একজন বউ… কিংবা প্রিয়তমা…একজন মা… আদরের ছোট বোন… কিংবা নিজের অতি আদরের কন্যা।
এখন সে কেবলই একজন ৪ আকৃতির রক্ত মাংসের ছিড়ে-খুবলে নেয়া যায় এমনই এক লীলাবতী ছাড়া আর কিছুই না।
হতে ও পারে না। সে হতে চায় ও না।
এমনই সে।
একজন লীলাবতী…
.. … ….
তিনঃ মায়ের নাইয়র
>>>>>>>>>>>>>
একদিন আমান হেঁটে হেঁটে চলেছিল। গন্তব্য উদ্দীশ্যহীন। ঝুপড়ি এক চা’র দোকানের সামনে ছোট্ট একটি পানের দোকান। খোলা পান বিক্রী হয় সেখানে। সাথে ‘সাদা পাতা’ এবং চুন সুপারি। বেশ উচ্চ স্বরে গান বাজছে।
‘কাজল নদীর জলে
ভরা ঢেউ ছলছলে’… …
নিজের ভেতর থেকে আমান যেন হঠাৎ বের হয়ে আসে। ফিরে যায় অনেক আগে। নৌকায় করে বাগেরহাট থেকে নানাবাড়ি যাচ্ছে। আব্বা-আম্মা, ছোট ভাই, আর ছোট খালু। নদীর পানিতে মাঝির বৈঠা র সংঘর্ষে কোমল-মৃদু আওয়াজ। পানির নিজস্ব রঙ নেই জানে সে। কিন্তু পানির কি নিজস্ব ঘ্রাণ আছে?
ছোট খালু খুব ভালো গাইতে জানতেন। নৌকায় বসে তিনি এই গানটি গাইছিলেন! এক অপূর্ব সুরলহরীতে সেই সময়টা কত্তো আনন্দে কেটে যেত!
নৌকার ছইয়ের ভেতর মায়ের আঁচলের নরম পেলবতায় হৃদয় ছুঁয়ে যেত আমানের। একটা গান মধুমতি নদীর সেই প্রবল যৌবনের বুক চিরে চিরে ঢেউয়ের তালে তালে স্রোতের অনুকূলে নেচে বেড়াতো! মায়ের নরম হাতের ছোঁয়া আজ আমান এখনো ওর কপোলে অনুভব করে। ভাবলেই কেমন ঘুমে বুজে আসে চোখ। হৃদয়ে তখন প্রশান্তির শ্যামল ছায়াময় অনুভূতি বিরাজ করে।
এক খুচরা পানের দোকানের সামনে বিহ্বল আমান ওর ছেলেবেলার সব থেকে প্রিয় জায়গায় বেড়ানোর সুখস্মৃতিতে উদ্বেলিত হয়। তখন সেটা ছিল জীবনের সব চেয়ে মধুরতর সময়। নানা বাড়ি বেড়াতে যাওয়া।
কিন্তু সেটা যে ওর মায়ের ‘নাইয়র’ ছিল! তখন বুঝে আসে নাই। একজন মা- একজন নারী এবং একজন মেয়ে ও বটে। সন্তান হিসাবে আমরা কেবল তাকে মা ই দেখি। আজ আমানের নিজের মায়ের সেই নাইয়র যাত্রা সময়ের ঘ্রাণে ভেসে ভেসে ওর হৃদয়কে প্রহ্লাদে নাচিয়ে তোলে!
একটা কষ্ট অনুভব করে আমান। মা কে কেবল মা ই দেখবার জন্য। তাঁর ভিতরের একজন বালিকা-যুবতী-বাবার প্রিয়তমা স্ত্রী- অন্য এক বাবা মায়ের মেয়ে এসব রুপগুলিকে কত অবহেলায় সে ফিরিয়ে দিয়েছে… দেখতে চায় নাই। কেবল মা হিসাবে তাঁর অপুর্ণতা ই চোখে পড়েছে। মায়ের সেই অপুর্ণতাকে ব্যর্থতার ডালিতে নিপূণভাবে সাজিয়েছে। অভিমানে কষ্ট পেয়েছে-কষ্ট দিয়েছে।
আজ এক বিষণ্ন বেলাভূমে একজন আমান বড্ড তীব্র যন্ত্রণায় নিজের মা কে মনে করে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে বোবা হয়ে যায়।
সে কষ্ট পায়-হারানো সময়ের বিবর্ণতায়… মধুমতি নদী মরে যাওয়ায়… কাজল কালো জলে পানি-শ্যাওলা আর ঝরা পাতার আঁশটে ঘ্রানে উদ্বেলিত হৃদয়ে একটা গানের অনুরণনের অনুপস্থিতিতে!
আমান কষ্ট পায় নিজের মা কে চিনতে না পারার কারণে!
হৃদয় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে নিজের এবং পৃথিবীর প্রতি চরম ঘৃণায় একটা ই মাত্র শব্দ-
ওহ! মা!
.. … ….
৪টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
শুধু লেখা দিলেই হয়না। বিভিন্ন জনের পোষ্টেও যেতে হয়।
আবু খায়ের আনিছ
সহমত
মামুন
সহমতের জন্য আপনার ধন্যবাদ প্রাপ্য। দিলাম আপনাকে ও।
মামুন
আরো কিছুদিন উদ্দেশবিহীন ঘুরাঘুরি করতে চাই। কিছুটা সময় প্রয়োজন।