
ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি মাথায় এলেই মাথায় আসে হিজরাদের কথা। বাস, ট্রেন, লঞ্চে ভ্রমণকারী মানুষমাত্রেই নানানরকম নেতিবাচক স্মৃতি ধারণ করে আছেন এই হিজরা জনগোষ্ঠীর মানুষদের সম্পর্কে। তাদের দেখলে অনেকে নাক সিটকাই, মুখ ফিরিয়ে নেই। বোধকরি এর পিছনে মুল কারন হিজরাদের নানান বিরক্তিকর কর্মকাণ্ড। আমি একবার শুনেছিলাম এরাও নাকি সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হয়ে নানান অপকর্মে লিপ্ত। সত্যমিথ্যা জানিনা, তবে তাদের নেতিবাচক কর্মকান্ডে এমনটা ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ অনেকেই জানিনা হিজরা এবং ট্রান্সজেন্ডার এক নয়।
এতো গেলো আমাদের কথা। একবার তাদের দিকটাও ভাবুনতো! একজন ছেলে বা মেয়ে যখন নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছে যে তার ভেতরে বিপরীত লিঙ্গের তীব্র অনুভূতিগুলো দিনকেদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে? পরিবার সমাজ থেকে নানান বঞ্চনা সহ্য করে একসময় তাকে এসবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়, একঘরে করা হয় তাকে।
তখন আশ্রয়হীন সেই মানুষটির জায়গা হয় অবহেলিতদের মাঝে। আমাদের কটুদৃষ্টি উপেক্ষা করে না পারে কাজ চাইতে, না পারে হাত পাততে। বাধ্য হয়েই অসহায়ের মতন জীবনযাপনের টাকা উপার্জনের জন্য তাকে নানাবিধ কাজেকর্মে নিজেকে সঁপে দিতে হয়। হ্যা, আমি স্বীকার করছি যে এদের অনেকেই ইচ্ছেকৃত হিজরা সেজে টাকা উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে হয়তো। কিন্তু যারা সত্যিকারের ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি আসলে যে তারাও সব সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত এটা অনস্বীকার্য।
ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সরকার, সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই বর্তমানে এই জনগোষ্ঠীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করে চলেছে। তাদের দেয়া হচ্ছে সামাজিক স্বীকৃতি। কর্মসংস্থান করা হচ্ছে, তাদের নিজেদের পরিচয় দেয়া হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রে। সকলের এই সমন্বিত উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা এখনো আমাদের সমাজে আশানুরূপ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এর কারন আমাদের অনেকের নেতিবাচক মনোভাব। এই মনোভাব একদিন নিশ্চয় পরিবর্তিত হবে। আশার কথা হচ্ছে সমাজের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেরাও নিজেদের আর্থসামাজিক অবস্থান পরিবর্তনে আজ সোচ্চার হচ্ছে। পড়াশুনা করছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছেন অনেকেই যার অন্যতম জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো তাসনুভা আনান শিশির।
তাসনুভার বাড়ি বাগেরহাট। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় থাকা শুরু করেন। বর্তমানে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কর্মরত বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামক একটি এনজিওতে প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন তাসনুভা। এর আগে তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও কাজ করেছেন।
তাসনুভা সমাজকর্ম বিষয়ে এমএ করেছেন। ২০০৬ সাল থেকে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে বটতলা থিয়েটার দলের সদস্য। এ ছাড়া ছোটবেলা থেকেই নাচতেন তাসনুভা আনান শিশির। সমাজ এবং পরিবারের নানান বঞ্চনাকে পাশ কাটিয়ে যিনি আজ মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছেন।
সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এই মার্চ মাসেই ‘নারী দিবস’ উদযাপনের প্রাক্কালে তাসনুভা আনান শিশির হচ্ছেন প্রথম একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী যিনি বৈশাখী টিভিতে নিয়মিত খবর পাঠ করবেন। নজিরবিহীন এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য আমিও বৈশাখী টেলিভিশন চ্যানেলকে সাধুবাদ জানাই।
সকল প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে সকল ট্রান্সজেন্ডার মানুষ একদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
[ছবি- সংগৃহীত]
২০টি মন্তব্য
খাদিজাতুল কুবরা
শত অভিযোগ অনুযোগের মাঝে ও এই পদক্ষেপটি অত্যন্ত আনন্দের।
মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া সমাজের অন্যতম দায়িত্ব। ধন্যবাদ বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা রইল ভাইয়া।
তৌহিদ
আপু অনেকদিন পরে আপনাকে পেলাম। আশাকরি ভালো আছেন।
আমরা এখনো মানবতার বুলি আউরে যাই অথচ মানবতা বন্দী কাগজে কলমে। এই অবস্থার উত্তরণ হবে একদিন।
শুভকামনা জানবেন।
শামীনুল হক হীরা
জাস্ট অসাধারণ।।আর কিছু বলার নেই
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাই, ভালো থাকুন আপনিও।
রেজওয়ানা কবির
আমরা প্রত্যেকেই আল্লাহর সৃষ্টি,আল্লাহ চাইলে আমরাও এরকম হতে পারতাম! তাই আমাদের উচিত প্রত্যেক সৃষ্টিকে সম্মান করা।এরকম অনেক তাসনুভা আশেপাশে রয়েছে,এভাবে তাদের এগিয়ে আসার সুযোগ করে দিলে মানুষে মানুষে আর ভেদাভেদ থাকবে না কখনো, শুনতে হবে না আমি কমন জেন্ডার।।।ভালো উদ্যোগ দেখে ভালো লাগল। শুভকামনা তাসনুভা। আর ভাইয়া অনেক ধন্যবাদ সমসাময়িক বিষয় তুলে ধরেছেন।
তৌহিদ
একদম ঠিক, সকল শুকরিয়া মহান আল্লাহ্র।
জগতের সকল মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাক এটাই প্রার্থণা। ভালো থাকুন আপনিও।
শুভকামনা রইলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সব নেতিবাচক, খারাপ মনোভাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশে রূপান্তরিত করাই মানব ধর্ম। তাসনুভার জন্য অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে আজকের অবস্থানে আসার জন্য। সে অন্য হিজরা বা কমন জেন্ডার দের জন্য অনুপ্রেরণা ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বৈশাখী চ্যানেল কে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন সুন্দর ও মানবতার আদর্শ হয়ে কাজ করার জন্য।
আপনার জন্য ও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
তৌহিদ
ধন্যবাদ দিদিভাই, সুন্দর বললেন। একদিন সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করে নেবেন এটাই কাম্য।
শুভকামনা রইলো।
পপি তালুকদার
অসংখ্য ধন্যবাদ এই পোস্ট দেয়ার জন্য।আমাদের সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের উপর পজিটিভ ধারন তৈরি হোক সেটাই আশা করি।তারা আমাদের অংশ তাদের ও ন্যায় সংগত অধিকার পাওয়ার অধিকার আছে। তারা যোগ্যতা দিয়ে সামনে এগিয়ে আসুক।
তৌহিদ
সুন্দর বললেন আপু। মন্তব্যে প্রীত হলাম।
আরজু মুক্তা
স্যালুট তাসনুভা। এগিয়ে চলো, বীরদর্পে।
তৌহিদ
ধন্যবাদ অশেষ। ভালো থাকুন আপু।
স্বপ্ন নীলা
সমাজে হিজড়া শব্দ শুনলেই সকলে ভয় পায়। তাদের বিভিন্ন আচরনে মানুষ একটু বিরক্ত বৈকি ! কিন্তু এই হিজরাগণ তাদের অধিকার পায় না (পরিবার, সমাজে)। তাই তারা বেঁচে থাকার তাগিদেই এহেন আচরণ করতে বাধ্য হয়। হিজরাগণ সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাক, তারা এগিয়ে যাক——– তবে এখানে সকলেরই জানা উচিত যে ইসলাম ধর্মে হিজরাদেরকে পুরুষদের মত আচরণ এবং পোশাক পরতে উৎসাহিত করা হয়েছে —
তৌহিদ
মন্তব্যে শিক্ষণীয় কথা থাকলে ভালোলাগা তৈরি হয় যার প্রমাণ আপনার এই মন্তব্যটি।
ধন্যবাদ অশেষ।
স্বপ্ন নীলা
”তবে এখানে সকলেরই জানা উচিত যে ইসলাম ধর্মে হিজরাদেরকে পুরুষদের মত আচরণ এবং পোশাক পরতে উৎসাহিত করা হয়েছে —” দয়া করে এই অংশটি ডিলিট বলে গণ্য করিয়েন। লিখতে চেয়েছিলাম নারী হিজরাগন নারীদের পোশাক এবং পুরুষ হিজরাগণ পুরুষদের পোষাক পরবে——–
তৌহিদ
ওকে, আপু বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ
প্রদীপ চক্রবর্তী
স্যালুট তাঁকে।
ওরাও তো মানুষ।
এগিয়ে চলুক তাসনুভার মতো আরও যারা আছে।
.
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ভালো তুলে ধরেছেন,দাদা।
তৌহিদ
ধন্যবাদ দাদা, মন্তব্যে ভালোলাগা অনেক।
নার্গিস রশিদ
খুব ভালো লাগলো তাদের কষ্ট বোঝার জন্য । আমার মতে তারাও তো মানুষ । তবে এতো কেন লাঞ্ছনা গঞ্জনা । তারাকে কেন সমাজ থেকে বের করে দেয়া হয় ? ইসলাম ধর্মে এটা তো বলা হয় না ? আশা করবো এরকম আরও লেখা , যা দিয়ে সচেতনা বৃদ্ধি হয় ।
তৌহিদ
মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক দিকগুলি কিছুটা হলেও জাগ্রত রাখা উচিত, আমি সে চেষ্টাই করি আপু।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।