
কখনো বিপরীত লিঙ্গের দুটো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব বড্ড দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। মুখে মুখে নিজেদের মতামত নিজেরাই নির্ধারন করে অন্য মানুষের কাছে নিজের একটা আলাদা পরিচয় /পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর থাকি সর্বদা আমরা। এটাও একটা খেলা। বড্ড মারাত্মক মস্তিষ্ক প্রসুত চতুর খেলা। মুখ ও মুখোশের মতো। যাবতীয় বন্ধুত্বের দাবিদার আমরা নিজেরাই নির্ধারন করি বন্ধুত্বের পরিসীমা। একসাথে চললাম বহুবার, বহু বেহিসেবি দিন রাত্রির অগণিত ভালোলাগা মুুহুর্ত। দিন শেষ হবার আগে দিনলিপি লিখতে গিয়ে কিছু অংশ বার বার ভাবি কোন শব্দে প্রকাশটা বসাবো সঠিক অক্ষর দিয়ে! আমার চারপাশ ভরে আছে সবুজের ক্যানভাসে। আমি বরং কংক্রিটের এপার থেকে দেখে যাই দেয়ালের ওইপারে উড়ছে ফড়িং, উড়ছে প্রজাপতি…..। হিসেবের খাতাটা আমি খুঁজে বের করতে পারিনা কখনো। ক্যাসেনটা, এ্যালজেব্রার হিসেব কষার গনিতজ্ঞ হতে হলে উল্টে যাবে ডায়রীর পাতা। ভরে যাবে অর্থের হিসেবে। ব্যাংক ব্যালেন্সের হিসেব নিয়ে ভাবতে বসলে পায়ের তলায় শিশির ভেজা ঘাসের স্পর্শ পাওয়া হবে না আমার কখনো। আমি ক্যালকুলেট করে তরিৎ হিসেবটা নামিয়ে নেই সময় বাঁচাতে। দিগন্ত তা নয়, পারফেকশনিস্ট হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে নিয়েছে অল্পসময়ে কপোরেট শাখায় হোক আর ব্যাক্তিজীবনেই হোক। দিগন্ত কলিগ হিসেবে সহ্য করার মত অন্তত বলাই যায়। দীর্ঘদিন ধরে একই কর্পরেট শাখায় আছি বলে সহকর্মি থেকে একটু ওপরে এগিয়েছে আমাদের এই সম্পর্ক। তাকে অন্তত আমি বন্ধুত্বের সম্বোধনে সংজ্ঞায়িত করিনা নিজ মন থেকে। কোনো সম্পর্কের নাম থাকতেই হবে এমন কেন হবে? না….. কোনো নাম নেই। বরং স্বাচ্ছন্দ্য থাকুক অফিস কলিগ পরিচয়ে। কতগুলো হলুদ অলকানন্দা ফুল জড়ো হয়েছে এই দশ তলা অফিস ক্যান্টিনের থাই গ্লাসে ঢাকা জানালার ওইপারে। লাঞ্চটাইমে আজ দিগন্ত আমার জন্য খাবার অর্ডার করলো। নিষেধ করলেও শুনবে না জানি ভেবে দুবারের বেশি বারন করিনি। সামনের মাসেই আমার জন্মদিনে দিগন্তকে আমি ট্রিট দিয়ে শোধ করে দেব ভেবে নিয়ে আপাতত চুপ চাপ হলুদ অলকানন্দায় মনোনিবেশ করা যেতে পারে। খাওয়া শেষে দুজনার জন্য দুকাপ কোল্ডকফি নিয়ে এসে মুখোমুখি বসলো…..
: তুমি কি করে জানলে আমার এখন ঠাণ্ডা একমগ কফি খুব দরকার ছিলো! দিগন্ত শুধু ঠোঁট বিস্তৃত করে একটা স্নিগ্ধ হাসি ছুঁড়ে দিলো এক পশলা ভেজা হাওয়ার মত। ইদানীং দিগন্ত মাঝে মাঝেই চিন্তার দরজায় এসে কপাট আগলে দাঁড়ায়। মন এবং মস্তিষ্কে চিন্তার ব্যায়াম চলে কিছু সময়। তারপর আবার অন্য চিন্তা এসে দখল নেয় মন মস্তিষ্ক। দুটো চিন্তা নিয়ে একসাথে ব্যায়াম সম্ভব হয়না। কিছু যোগবিয়োগ জরুরী হয়ে পড়ে তখন। এক চিন্তা থেকে একটা নিয়ে, আরেক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তা বাদ দিয়ে যোগবিয়োগের এই ব্যায়ামিক কসরৎ আমি মনোজগতে একা একাই করি। আমার মুখাবয়বে ছায়া ফেলতে দিইনা। যে ছায়ায় দিগন্ত কোনো জানালা বা দরজার হদিস পেয়ে যেতে পারে।
মাঝে মাঝে চোখ চলে যায় দেয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়ির পেন্ডুলামের দিকে। আলস্যে হলেও ঝুলতে ঝুলতে ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে সময়ের শেষ সীমায়। তবু আমার আলস্যি ছাড়েনা চিন্তায়।
– আমি জানি
: কি জানো?
– এই তোমাকে!
: কী জানো?
– বললাম তো! জানি….
: কিইইই জানো? সেটাই তো জানতে চাইছি
– এই যে! তুমি কেমন সেটাই….
: কেমন আমি?
– জানি…..তোমার অভ্যাসগুলো,তোমার স্বভাব তোমার পছন্দ এইসব
: হা হা হা হা হা……..
– হাসছো কেন?
: স্বভাব,অভ্যাস, পছন্দ এগুলো জানো বলেই আমাকে জানা হয়ে গেলো?
– আর কী লাগে একজনকে জানতে?
: আচ্ছা,,, তুমি আকাশ দেখো?
– হঠাৎ এ প্রশ্ন?
: আকাশ দেখো!
– ওইতো আকাশ! দেখব না কেন?
: কি দ্যাখো?
– কি আশ্চর্য! আকাশের আবার কী দেখব?
: এটা হচ্ছো তুমি…..
– মানে?
: বুঝে দেখো!
– বুঝলাম নাতো!
: এবার তো বোঝা উচিত তোমার নাম আর ওই আকাশটার মধ্যে পার্থক্যটুকু বোঝার মত সময় নাওনি কখনো সময়ের কাছ থেকে।
– হেয়ালি ভরা কথার মানে কে বুঝেছে কবে?
: আমি কি জানি জানো?
– বলো শুনি….
: যে হেয়ালি শব্দটার মানে জানে! সে অবশ্যই হেয়ালি করতেও জানে। আমি বরং হেয়ালি শব্দটার সঠিক শব্দার্থ জানিনা। আমি যা/ যেভাবেই বলে প্রকাশ করি! আমার মনে হয় সেটুকুর কিছু অংশে আমি নিজে বাস করি…… সে জায়গাটাকে তোমার মত অনেকেই হেয়ালি বলে অবলিলায় নাম দিয়ে যায়
– আমার নাম আর আকাশের ব্যাবধান নিয়ে কি যেন বললে?
: তোমার নাম কী?
– দিগন্ত!!
: এখনো বলে বোঝাতে হবে ব্যাবধান?
– আমি বুঝিনা….
: এটাই হচ্ছে জানা এবং বোঝার সাংঘর্ষিক পার্থক্য বুঝলে? তোমার নাম ধরে যে ডাকে! সে নিজেও জানেনা সে ডাকলো কেবল একজন ভূমি বা বনভূমির শেষপ্রান্ত কে। আর আকাশ ছড়িয়ে আছে পুরো পৃথিবীটা জুড়ে।
– তুমি কোন কথা থেকে কোন কথায় জাম্প মারলে তাইতো বুঝলাম না কিছু!
: জেনে রাখো, কখনো সব কথার মানে জানতে নেই,শুধু কিছু কথা নিয়ে মন এবং মস্তিষ্কের ব্যায়াম করা যেতে পারে। ওতে নিত্য নতুন জানার জগতটায় জোনাক পোকার মত নীলচে আলো এসে অন্ধকার দূর করে আবছায়া কিছু আলো পাওয়া যেতে পারে।
– আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে, মনে হয় চিনি না তোমারে…
: কখনো তোমার মনে হয়েছিলো চেনো আমাকে?
– তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে এখন ভয় পাচ্ছি
: হা হা হা হা…… তাহলে ভয়টা কিসের তা তুমি একটু হলেও বুঝতে পারছো…..
– এটুকু বুঝতে পারছি,,,, জানা এবং বোঝার বিষয়টা কখনো এককথায় প্রকাশ্য নয়।
: আমি বুঝতে পারছি তোমার মন এবং মস্তিষ্ক ব্যায়াম করতে শুরু করে দিয়েছে। এটা শুভ লক্ষন।
– আর কখনো কাউকে বলব না” আমি তোমাকে/ আপনাকে জানি”
: এই কথাটা তুমি উচ্চারন না করলেও পারতে
– কেন? উচ্চারন করে কী ভুল করলাম?
: তুমি কি করবে বা না করবে সেটা নিজেকে নিজে আগে বিশ্বাস দিয়ে বলবে। কাউকে বলে করতে হবে কেন? মানুষ বলে এক করে আরেক…. এখানেই মানুষ নিজেদের কাছে নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে যা নিজেরাও জানে না। অন্য মানুষের চোখে তখন সেই মানুষটা মূল্যবোধহীন এক অ-মানুষ রূপে পরিচিত হয়ে ওঠে। তুমি ভাবতে পারো তখন কেমন লাগবে নিজের কাছে নিজেকে? মানুষই একমাত্র প্রাণী যে মিথ্যা বলতে পারে। গাছ, ফুল,পাখি,প্রজাপতি,মৌমাছি,ভ্রমর, আকাশ,চন্দ্র,সুর্য, নদী,জল,হাওয়া,ইট,পাথর,ধুলো,বালি এরা কেউ মিথ্যা বলে না। এরা এদের নিজ নিজ চরিত্রও বদলায় না; পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে পৃথিবীর শেষ অব্দি এরা এদের চরিত্র কখনো বদলাবে না। এরা একই রকম থাকে/ থাকবে। এরা কখনো কাউকে বলেনা আজ থেকে এটা করব না ওটা করব না, তারপর আবার ভুলে গিয়ে স্বভাবে ফেরেনা পুনরায়। ভেবে দেখেছ কখনো দিগন্ত?
– তুমি কী নীলা?
: আমি নীলা…… আর নীলা সবার সয় না……
১১টি মন্তব্য
রেজওয়ানা কবির
প্রথম হয়ে নিলাম। কিছু সম্পর্কের নাম হয় না, আবার হলেও নিজেই আমরা সেই সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা তৈরী করি যাতে করে ইমোশনাল হয়ে না পড়ি কারন বাস্তবে তা আমার জন্য সঠিক না আবার সঠিক হলেও অনেক সময় সম্পর্কের ছায়া মাথায় বা সামনে আসলেও অনেক যুক্তি দিয়ে তাকে দমন করি।
অপরদিকে দিগন্তের কাছে প্রকাশভঙ্গী সহজ আর অবলীলায় সবকিছু সহজভাবে মেনে নেয় তাই তার কাছে আরেকটি মানুষকে ভালোবাসা মানে তার পছন্দ অপছন্দ এইসব জানা।
এটা বোঝা গেল যে দুজনেই জানে তাদের সম্পর্ক কি?বা অনুভূতি কেমন? তবে গল্পের নায়িকা নিজেই দ্বিধান্বিত থাকে সম্পর্কের নাম দিতে তার বাস্তবিক কারনে। তবে অনুভূতি তারও আছে।
“মন এবং মস্তিষ্কে চিন্তার ব্যায়াম চলে কিছু সময়। তারপর আবার অন্য চিন্তা এসে দখল নেয় মন মস্তিষ্ক’
।
বেশি ভালো লেগেছে এই বিষয়টা। শুভকামনা আপু।
বন্যা লিপি
প্রথম হওয়ার জন্য আপনাকে স্যালুট।
এই মিনি গল্পে আমি যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি, আপনি তার এককাংশ মাত্র নজরে এনেছেন। তাতেও। গল্পের নারী চরিত্রে নীলা কিন্ত দ্বিধান্বিত নয়। আমি চাইছি আপনি পাঠক হয়ে মস্তিষ্কের ব্যায়াম করুন গল্প পড়ে। তাহলেই আপনিও আবছা জোনাক আলোর দেখা পাবেন। উদ্দেশ্য ছাড়া গল্প কবিতা একান্ত অনুভূতি লেখা সব অহেতুক।
আপনার ভালোলাগাই আমার গল্পের স্বার্থকতা।
শুভেচ্ছা জানবেন।
রেজওয়ানা কবির
ধন্যবাদ আপু। মস্তিষ্কের ব্যায়াম আসলেই জরুরী,করব এই ব্যায়াম। শুভকামনা
আলমগীর সরকার লিটন
গল্পটা চমৎকার লাগল প্রিয় লিপি আপু অনেক শুভেচ্ছা রইল
বন্যা লিপি
আপনাকেও শুভেচ্ছা লিটন ভাই।
হালিমা আক্তার
একদম সত্যি বিপরীত লিঙ্গের দুটো মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব দুষ্প্রাপ্য। বন্ধুত্ব ছাপিয়ে কখন দিক পরিবর্তন করে মনের কোণে ঢেউ খেলে যায় কেউই বুঝতে পারেনা। নীলা সবার সয়না। তবু আকাশ নীল কে জড়িয়ে রাখে। দিগন্তের সীমা রেখা ছুঁয়ে থাকে নীল আকাশ। শুভ কামনা রইলো।
বন্যা লিপি
মূল থিম আরো ব্যাপক এই গল্পে। আপনাকেও শুভেচ্ছা।
আরজু মুক্তা
এই বন্ধুত্বটা কেউ বুঝতে চায় না। মেয়েটি নীলা বলেই না। বোঝার মন নাই এই পুরুষদের।
আমি অবশ্য ভাগ্যবতী আমার এরকম একজন বন্ধু আছে ত্রিশ বছর ধরে। অন্তত কিছু না হোক দুখের কথা শেয়ার করতে পারি।
ভালো লাগলো অনুগল্প।
ভালোবাসা সবসময়
বন্যা লিপি
বোঝার ব্যাপারের সাথেও আরো কিছু থাকে….. নীলা আসলেই কারো কারো জন্য উপযুক্ত নয়।
ভালবাসা
সাবিনা ইয়াসমিন
কথায় কাজে অমিল থাকা স্বাভাবিক মানুষের প্রতিচ্ছবি। এখানে জোর খাটে না। একটা সময়ের পর বিপরীত লিঙ্গের সাথে সুলভ-সাবলীল বন্ধুত্ব দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে, কিন্তু সমলিঙ্গের সাথে বন্ধুত্ব আরও জটিল।
বন্যা লিপি
এটা ঠিক…. সমলিঙ্গের বন্ধুত্বেও জটিলতাগুলো হ্যাপা বলে মনে হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। মানুষ বৈচিত্রের নামান্তর এর চেয়ে বেশি আর কিইবা বলার আছে!