
অসময়ের ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সারোয়ার কবীর ছাতা মাথায় বৃষ্টিতে ভিজতে নেমে গেলেন। আমারও তার হাত ধরে নেমে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি তা করতে পারছি না। বরং সরকারী কর্মকর্তার মতো ‘পোড়া আলু‘ মুখ করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে একজন প্রেস সচিবের বৃষ্টি বিলাস দেখছি। কি সুন্দর করে তিনি গান গাইছেন আর ভিজছেন। কবীরের সাথে মনে মনে আমিও গান গাইছি- এই, এসো ভিজি আজ বৃষ্টিতে।
এসময় তাঁর আহ্বানের আশায় মন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়। ভাবনায়, আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তার সাথে থৈ থৈ করে ভিজতেও থাকি। যেন কবীর এসে কোমরে আলতো হাত রেখে আমাকে ঘোরায়! আমি বৃষ্টির শব্দের মতো মিলে মিশে হাসি।
মধুর দৃশ্য হতে পারতো। অথচ আমার কিছুই করা হয়ে ওঠে না। কোন কারণ নেই শুধু আমি সহজ হতে পারিনা। মানুষটা আমার, আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, সম্মান করে তারপরও তার সাথে সহজ হতে পারি না। ভীষণ রাগ লাগে নিজের উপর।
একসময় কবীর বৃষ্টি বিলাস শেষ করে। পাশ কাটিয়ে কানে কানে বলে যায়, ওটাই ভালো এমন করে মনে মনে ভেজো আর গান গাও। চোখে- মুখে উথাল- পাথাল বৃষ্টি প্রেম অথচ আমি টেনে নামাচ্ছি না বলে তুমি নামবে না তা তো হয় না। নাহিদ শারমিন, ‘ এ বৃষ্টি, আমি ও তোমার জীবন, সব তোমার। তাকে নিজের মতো উপভোগ করার দায়িত্বও তোমার।‘
আমি কেন এমন তার কোন ব্যাখ্যা নেই। ইচ্ছেগুলো কেন যেন ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে রাখি। যেমন- কোন কোন রাতে আমার ভীষন ইচ্ছে করে কবিরকে জড়িয়ে বুকে শুতে। পাশেই আছি অথচ মাথাটা তুলে তার বুকে দিচ্ছি না। সে বুঝতে পারে কিনা জানিনা, ঠিক সে সময়ই সে আমাকে কাছে টেনে নেয়। তখন ভীষন ইচ্ছে করে ওর গালে একটা চুমু দেই। মন বলে, যদি আদিখ্যেতা ভাবে। কিভাবে কি করবো এ ভাবতে ভাবতে উসখুস করতে থাকি তার বুকে। কবীর বুঝতে পারে হয়তো, আমার কপাল স্পর্শ করে। তার গাঢ় চুম্বনে নিজেকে ভীষন অপরাধী মনে হয়।
কবীর অদ্ভুত মানুষ; কেমন করে যেন সব বুঝে ফেলে। আর অতি সহজ ও সাধারণ একজন মানুষ। আমার ধারনা ‘পোড়া আলু‘ শব্দটা কবীরের মতো মানুষের বেলায় ভুল। কবীরের মতো রোমান্টিকরা আছে বলেই আমার মতো মন পোড়া রোমান্টিক, জেন্ডার স্পেশালিস্ট এর সাথে ক‘বছর ধরেই পথ মসৃণ করার আপ্রান প্রয়াস চলছে। দাম্পত্যে সবাই আমাদের অতি সফল বলেই মানে। তবে কতোটা সফল সে জানিনা আমার মনে হয় সে সফল না। কবীর আমাকে বিয়ে করে ভুল করেছে। আমি তাকে যথেষ্ট সুখী করতে পারিনি। একটা মানুষ একা সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাবে তা হয়? অথচ সে টানছে।
সবাই বলে, জেন্ডার গবেষণা, সেমিনার, নারীর অগ্রগতি এসব করতে করতে আমি কিরকম নারীবাদী হয়ে গেছি। আসলে তেমন কিছুই নয়। জন্মগতই আমি অনেকগুলো বদ অভ্যাসে গড়া মানুষ। যেমন- আমি ভীষন জেদী। জেদের কারনে যদি আমার বড় কোন ক্ষতিও হয়ে যায়, আমি মেনে নেই। এবং ওই এক জায়গাতেই অটল থাকি। কেন যেন জেদকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা ভাবতেই পারি না।
এছাড়া টপাটপ ‘ সরি’ বলার অভ্যাসও আমার নেই। ‘সরি‘ বলাটা আমার কাছে রীতিমতো অপমানজনক ও অপরাধের পর হাতে- পায়ে ধরার মতো লাগে। আমার মতে, হাতে- পায়ে ধরার ব্যাপারটি রাতে কিংবা নিরিবিলিতে ঘটানো উচিত। একেবারে সবার অন্তরালে। যেহেতু অন্তরাল ব্যাপারটা প্রেমিক বা হাজব্যান্ড ছাড়া সবার সাথে ঘটে না। তাই অপরাধের পর আমি কাউকে নিরিবিলিতে পাইও না, আমারও আর ‘সরি‘ বলে হাত-পা ধরাও হয় না।
তবে মনে মনে তাকে হাজার বার ‘সরি’ বলি ‘হাত- পা’ ধরি। তবুও যেহেতু তাকে মুখে বলতে পারি না তাই আর ক্ষমাও পাওয়া হয় না। এ কারনেই খুব সহজেই কারও সাথে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। প্রিয় মানুষরা একেবারে নীরবেই আমার জীবন থেকে চলে যায়। তবে আমি তাকে জীবনেও ভুলতে পারি না। সারাজীবনই তাকে চুপি চুপি ভালোবেসে যাই।
কবীরের সাথে আমার একটা জেন্ডার কনফারেন্সে পরিচয়। এরপরই সে আমাকে বিয়ের কথা বলে। আমাকে কিছুটা জোর করতে থাকে বিয়ের জন্য। আসলে তার কোন সমস্যা নয়। আমি বিয়ে করতে চাইনি কারন আমার ধারনা কাউকে সুখী করার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা আমার নেই। এরপরও কেমন করে যেন আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়।
বিয়ের রাতে ফুলশয্যায় সব বউদের মতো আমি বিছানায় নেই। বারান্দায় ঘাপটি মেরে বসে আছি। বিয়ে কেন করলাম এজন্য মেজাজ খারাপ। কবীর হয়তো জানতো না, মন খারাপ বা কোন কিছু নিয়ে ক্ষেপে থাকলে আমি একা থাকি। এবং সেটা যতোক্ষন ইচ্ছে করে ততোক্ষন থাকি। কবীর এসে আমাকে ডার্টি জোকস শুনিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছে। বারবার ঘুমানোর জন্য ডাকছে। অনেকবার বলার পরও সে বিছানায় যেতে খুব জেদ শুরু করলে আমার প্রচন্ড রাগ হয়। হঠাৎই আমি রেগে গিয়ে তাকে থাপ্পর মেরে বসি। এরপর নিজের বোকামীর জন্য বাকিরাত বসে বসে কাঁদি।
কবীর কিছুই হয়নি এমন ভান করে পরদিন লাল গাল নিয়ে সবার সাথে গল্প করে বেড়ায়। তার এ অবস্থায় বাড়ীর সবাই আমাকে নারীবাদী, মহাবদ মেয়েমানুষ ইত্যাদি নানা ভাবে ফিসফাস করতে থাকে। এছাড়াও বলাবলি চলতে থাকে আমার কিইবা যোগ্যতা আছে একজন সচিবের বউ হবার।
কবীরকে ভালোবেসে ফেললাম কিনা কে জানে! এরপর শুধুই মনে হতে লাগলো এমন গুরুতর অপরাধে কবীরকে আমার হাতে- পায়ে ধরে ‘সরি‘ বলে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এটা করার জন্য সারাদিনই তাকে মনোযোগ আকর্ষণের অনেক চেষ্টা করলাম। দু’একবার চোখাচোখি ছাড়া বিশেষ কোন স্কোপই খুঁজে পেলাম না। রাত হতে হতে বাড়িতে লোকে গিজগিজ করতে লাগল। এমন অবস্থা, শোবার জায়গা পর্যন্ত নেই।
ভাবলাম, পরদিন সবাই চলে গেলে দেখা যাবে। পরদিন কবীর সুন্দর করে সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল শুধু আমাকে ছাড়া। সে চলে যাওয়ার পর মনে হল তার ফোন নম্বরও তো আমার কাছে নেই। কারও কাছে চাইলেই হয় কিন্তু আমার ব্যক্তিত্বে সেটা চরম অনুচিত কাজ। আর আমি জানি যার কাছে চাইবো সে আমাকে নম্বর দিয়ে বাড়ির সবার কানে কানে রটিয়ে দেবে নাহিদ শারমীন প্রায় অপরিচিত এক লোকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই ভয়ে আর কিছুই করা হলো না। শুধু মনের খচখচানি নিয়ে তার অপেক্ষায় কাটতে লাগল। অবশেষে মি: কবীর শশুর বাড়ি এলেন। এতোদিন রাগ করে ছিলেন, না ছিলেন না তাও জানা হলোনা। কারণ সচিব সাহেব আমার সাথে কথা বলছেন না। আমার মতোই বারান্দায় বসে আছেন। তাকে চা অফার করছি, কফি অফার করছি, শরবত, তিনি কিছুই নেবেন না।
জানতে চাইলাম- আপনি এভাবে বারান্দায় বসে কেন? ঘুমোবেন না?
উত্তর দিলেন- এর জবাবে আপনাকে আমার থাপ্পর মারা উচিত কিন্তু আমি এমন কিছু করতে জানিনা। এটা আপনি ভালো পারেন!
কি অদ্ভুত! পুরোনো রাগ তাহলে আছে? তাকে আমার ’সরি’ বলা হয়নি বলেই সে এমন করছে। আমি এজন্যই বিয়ে করতে চাইনি। এতো ফরমালিটিজ আমাকে দিয়ে হয়না। অবশেষে আমাকে কঠিন পরীক্ষায় এগুতেই হল। বাধ্য হয়ে, অতি কষ্টে, নিজের সমস্ত ইগো দমন করে তাকে দু’ পায়ে ধরে ‘সরি‘ বললাম। অনেকক্ষন পায়ে পরে থাকার পর তিনি শুধু বললেন- যাও, এতো করে যখন কাঁদছো মাফ করে দিলাম! তবে এ ভুল দ্বিতীয়বার করলে মাফ করা হবে না।
পরদিন সকালে চা খেতে রান্না ঘরে যাচ্ছি। যার সামনেই পরছি সেই আমাকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। ঘটনা কি? জানার জন্য ছোট ভাইকে জোর করে ধরলাম। মাথা নষ্ট!
ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না এমন ভান যে কবীর সাহবের। তিনি কোন ফাঁকে আমার পায়ে ধরার দৃশ্য পুরোটাই ভিডিও করেছেন। এবং তা মোটামুটি সবার ফোনে ফোনে। রাগে গা জ্বলতে লাগল। মি: কবীরকে এ সময় সামনে পেলে আলু ভর্তা বানাতাম কিন্তু তার ভাগ্য ভালো যে, কোথাও পাওয়া গেল না।
সেদিন খুব করে রাত হবার অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ মি: কবীরকে আবারও কষে দুটো থাপ্পর লাগাতে হবে। এবং এবার আর কোন পা ধরাধরি নেই, সরি নেই। অপেক্ষার পর যথারীতি রাতও এল কিন্তু মি: কবীরকে আর পাওয়া গেলো না। তিনি চিরকুট রেখে উধাও ‘ কেমন দিলাম সোনা বৌ।’
সেদিন কোন কারণ ছাড়াই আমি হাসলাম, খুব হাসলাম। এটাকেই বোধহয় প্রেম বলে! এরপর কতগুলো বছর কেটে গেল। আমাকে কবীর আগলে রাখে। আর আমি কিছুই বলতে পারিনা, দুরত্বে থাকি।
তবে সম্পর্কে একটু দুরত্ব থাকা খারাপ না। কারণ ” সম্পর্ক হলো ফুলের মতো। ফুল যতোই নাকের কাছে নেয়া হয়, গন্ধ ততোই ফিকে, হালকা হয়ে আসে। আর টবে সাজিয়ে দুরে রাখলেও যত্নের গন্ধ ঘরময় ছড়ায়।”
ছবি- কবীর শারমিন
৬টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
সব কিছু প্রকাশ হলে যেমন নিজেদের মাঝে দূরত্ব থাকে না, তেমনি সবই উন্মুক্ত করে দিলে সম্পর্কের মাধুর্যটাও ধরে রাখা যায় না। আমার কাছে সম্পর্কটা পোশাকের মতো। পোশাক কমবেশি যেটাই হোক দেহের সৌন্দর্য বাড়ায়। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু অংশ উন্মক্ত থাকলে ভালো/খারাপ লাগে, আবার ঢেকে রাখা অংশে আর্কষণ কাজ করে। কিন্তু সম্পূর্ণ পোশাক বিহীন দেহের মাঝে কোন সৌন্দর্য থাকে না। দাম্পত্যের মাঝে কিছুটা আড়াল থাকে বলেই একেকটা দম্পতি সারাজীবন একসাথে পাড়ি দিয়ে যায়। আগ্রহ, ভালোবাসা, পারস্পরিক পছন্দ/অপছন্দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, অব্যক্ত কথপোকথন বুঝে নেয়ার মানসিকতা সবই সাংসারিক জীবনের ছন্দকে গতিশীল রাখে।
গল্পটা ভালো লেগেছে। আপনার গল্প গুলোর আড়ালে অনেক মেসেজ থাকে, যা পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
শুভ সকাল❤️❤️❤️
এমন মন্তব্যের পর অনেক লিখতে ইচ্ছে করে। সময় হয়না। দারুন বললেন, সম্পর্ক পোশাকের মতো। আসলেই তাই।
অনেক ভালো থাকুন।। ভালোবাসা অবিরাম ম্যাম!!!
হালিমা আক্তার
সম্পর্কের জটিল সমীকরণ। একেক জন একেক ভাবে হিসেব করে চলে। এমন ভালোবাসা দিয়ে যদি ভালোবাসার মানুষটি আগলে রাখে। ভালোবাসা কোন দিনও ফুরাবে না। চমৎকার গল্প উপভোগ করলাম। শুভ কামনা রইলো। শুভ রাত্রি।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো আপা। ভালো থাকুন।
মোঃ মজিবর রহমান
সকল প্রাণে ভালোবাসা বজায় থাকুক। যে যেভাবে পারে সেভাবে। আনন্দ রাগ, অনুরাগে জিইয়ে থেক জিবন্ময়। বিভিন্ন আবেশে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকুন।