সাঁইজির গান বোঝার ক্ষমতা এখনো হয় নি। যতটুকু অনুভব করি ততটুকুই লিখার চেষ্টা করলাম। আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে ভুল-ভ্রান্তি থাকলে ধরিয়ে দিবেন। ☺
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কি?— প্রতীকী গানটিতে দুইটি চাঁদের কথা বলা হচ্ছে। দুটি চাঁদ হচ্ছে মাতা-পিতা তথা পুরুষ নারীর সূক্ষ্মস্বত্বা যা সৃষ্টির সৃষ্টির শুরু। ‘চাঁদের গায়ে’ বলতে ‘মাতৃরজ ডিম্বাণু’ এর গায়ে ‘চাঁদ লেগেছে’ অর্থাৎ ‘পিতৃরজ শুক্রাণু’ লেগেছে।এখানে পুরুষ নারী মিলনে নতুন সৃষ্টির প্রতীকী ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তারে তোমরা বলবে কি?— ‘মায়ে-ঝিয়ে’ কথাটি বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত আছে। এখানেমা বলতে মা কে এবং ঝি বলতে কন্যাকে বোঝান হয়। যেমন মায়ে-ঝিয়ে মিলে সকাল থেকে কাজটি করে শেষ করলাম।প্রচলিত মতে মায়ের পেটে ঝি তথা কন্যার জন্ম হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে উল্টো বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন? এখানে একটু গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে। সন্তান জন্ম নেওয়ার আগে কি কাউকে মা বলে? বলে না। তাহলে সন্তান জন্ম দেওয়ার সাথে সাথে মা শব্দের সৃষ্টি হল। তাহলে ‘মা’ এই শব্দটির জননী কে হল? যে জন্ম নিল, সে। অর্থাৎ ঝি। সে জন্য বলা হল ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম’। এখন ‘তারে তোমরা বলবে কি?’ কাকে কি বলা হবে? মায়ের জন্ম হয়েছে ঝিয়ের পেটে। অর্থাৎ যে মায়ের জন্ম হল ঝিয়ের পেটে, তাকে তোমরা কি বলবে? ঝিয়ের পেটে তো ‘মা’ এর জন্ম হল, তাহলে ঝিকে কি বলবে অর্থাৎ ঝি কি হবে? এখানে বলা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে এই ঝিও সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে নিজে মা হবে। এটাই বলা হল। এটাসৃষ্টির ধারার চক্র।ছয় মাসের এক কন্যা ছিল, নয় মাসে তার গর্ভ হল— সাধারণত (বিজ্ঞানের ভাষায়) ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত হওয়ার ফলে যে জাইগোট উৎপন্ন হয় তাতে ছয় মাসে প্রাণ সঞ্চার হয়। অর্থাৎ এক কন্যা বা জননীর উৎপত্তি হল। এবং আমরা জানি যে নয় মাসে সন্তান প্রসব হয়। এখানে ঐ ছয় মাসের কন্যাটি ‘মা’ শব্দটি প্রসব করছেন। এবং নিজেও ঝি রূপে পৃথিবীতে আগমন করে।এগার মাসে তিনটি সন্তান, কোনটা করবে ফকিরি?— ‘এগার মাসে তিনটি সন্তান’ কি কি? এগার মাস অর্থাৎ ভ্রূণ মিলনের এগার মাসের কথা তথা কোন শিশু ভূমিস্ট হওয়ার দুই মাসের কথা বলা হচ্ছে। আমরা জানি বা বিজ্ঞান বলে যে, দুই মাসের শিশু প্রথম চিন্তে শেখে, বা উপলব্ধির ক্ষমতা অর্জন করে। ভাবুকের ভাষায় এই সময় প্রথম শিশু চিন্তা করে ‘আমি কে’, ‘তুমি কে’ এবং ‘আমায় কে সৃষ্টি করেছে’। লেখকের ভাষায় এই তিনটি চিন্তা তিনটি সন্তানস্বরূপ। এখন ‘কোনটা করবে ফকিরি?’ এর মাধ্যমে বলতে চাচ্ছে, এই তিন চিন্তার কোনটি প্রবল হলে ফকির হওয়া যায় বা ফকিরি করা যায়। এখানে বলা যেতে পারে যার ‘আমায় কে সৃষ্টিকরেছে’ এই চিন্তা যার প্রবল হয়, সে ফকির হতে পারে।ঘর আছে তার দুয়ার নাই, লোক আছে তার বাক্য নাই।— এখানে মাতৃগর্ভে সন্তানের অবস্থা বোঝানো হচ্ছে। মাতৃগর্ভ একটা ঘর। এটাতে একটা সন্তান আছে। সেই সন্তানের জন্য কোন পথ খোলা নেই অর্থাৎ দরজা নেই। তাকে সর্বত ভাবে তার মায়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সে কোন কথা বলতে পারে না।আবার কে তাহারে আহার যোগায়? কে দেয় সন্ধ্যাবাতি?— মাতৃগর্ভের এই সন্তানকে কে আহার দেয়? আমরা জানি যে মাতৃগর্ভে সন্তান মায়ের থেকেশক্তি গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। সে নিজে কোন আহার করতে পারে না। আবার ‘কে দেয় সন্ধ্যাবাতি?’ সন্তান চায় মাতৃগর্ভ থেকে বের হতে। কিন্তু সময় না হলে, ভূমিস্ট হতে পারে না। সন্ধ্যাবাতি জালানো অর্থাৎ আগমনরত আঁধারকে দূর করা। এখানে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন তাকে কেরক্ষা করছে অর্থাৎ আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছেন, তার সাধারণ জিজ্ঞাসা। এখানে আসলে সৃষ্টিকর্তার মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। কারণ মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সব বিপদে আপদে সেই একমাত্র ভরসা।ফকির লালন ভেবে বলে, ছেলে মরে মাকে ছুঁলে— ‘ছেলে মরে মাকে ছুলে’ কি বোঝানো হয়েছে এখানে? এখানেও সন্তান জন্মদানের কথা বলা হয়েছে। মৃত্যু মানে বিচ্ছেদ।এখানে মা এবং সন্তানের বিচ্ছেদের কথা বলা হচ্ছে। যখনই সন্তান জন্ম দানের সাথে মাতৃ শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে, তখনই সন্তান তার জন্মদাত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, অর্থাৎ প্রসব করাকে বোঝানো হয়েছে। প্রসব করার সাথে সাথে সন্তান তার আশ্রয়দাত্রী মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় অর্থাৎ মা’ শব্দ সৃষ্টির সাথে সন্তান মায়ের গর্ভ থেকে প্রসব হচ্ছে। তাই বলা হল, ‘ছেলে মরে মাকে ছুলে’।আবার এই কয় কথার অর্থ নৈলে, তার হবে না ফকিরি।।— এখানে বলা হয়েছে, উপরে বর্ণিত কথা গুলোর অর্থ যদি কেউ না জানতে পারে, তার ফকির জীবন সার্থক হবেব না। কে ‘মা’, কে ‘ঝি বা সন্তান’, কাকে কে জন্মদিচ্ছে। এই যে সৃষ্টিতত্ত্ব একে জানলেই তবে ফকিরি সার্থক হয়। 🙂
৩টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
নাহ অনেক ভালো বলেছেন। এভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝিয়েছেন যারা এ গানের সাথে পরিচিত নয়, তারাও এ গানের মানে বুঝবে।
অনেক ছোটবেলায় এ গানটা প্রথম শুনি আমার বড়ো মামার কন্ঠে। যখন হাইস্কুলে পড়ি তখন এ গানটির মানে আমার দিদিমা বুঝিয়ে দিয়েছিলো। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, লালন ফকির সেই যুগে এমন আধুনিকমনস্ক লেখা কিভাবে লিখেছিলেন? এবং শুধু তাই নয় গানের সাথে এমনভাবে সুর মিলিয়েছিলেন যা অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে গেছে সকলেরই।
ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি পোষ্টের জন্য।
অরুনি মায়া অনু
এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। আপনার পোস্ট নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিল।
মোঃ মজিবর রহমান
বাপরে কঠিন যুক্তি অনেক জানলাম শান ভাই।
অনেকবার পড়তে হবে।