
ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র সহ বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের নদী অববাহিকার মানুষের প্রাণের গান ভাওয়াইয়া। এই ভাওয়াইয়া এ অঞ্চলের সংস্কৃতিকে করেছে বেগবান। ভাওয়াইয়াকে সারা বিশ্বে পরিচিত এবং এর অস্তিত্ব ধরে রাখতে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদেরই একজন খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট।
যখন আমরা খুব ছোট। মাইকে গান বাজতো ” ফাঁন্দে পরিয়া বগা কান্দে রে। ” গলা শুনেই বুঝতাম সম্রাট ভাই গাইছেন। আর দল বেঁধে দৌড়।
তাঁর জন্ম সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। ১৯৫৭ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারী কুড়িগ্রাম জেলার ব্যাপারী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মৃত আলহাজ্ব মনির উদ্দীন এবং মাতা মৃত সহরজান নেছা। কট্টর মুসলিম পরিবার এবং তাঁর বাবা এম. এ করেছেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাদীস নিয়ে। এমন পরিবারে সঙ্গীত চর্চা কল্পনাতীত। তাইতো চুরি করেই সঙ্গীত ভুবনে আসা। তাঁর হাতে খড়ি হয় বাবু উপেন্দ্র নাথ এবং ওস্তাদ সামছুল হকের কাছে। পরবর্তীতে ভাওয়াইয়া যুবরাজ কছিম উদ্দীনের কাছে গান শিখেন। তাঁর সাথে কথা বলে জানা যায়, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডে ” আগা নাওয়ে ডুবো ডুবো পাছা নাওয়ে বইসো” এই গান শুনে তাঁর ভাওয়াইয়া প্রীতি বাড়ে।
কুড়িগ্রামের স্কুল কলেজের গণ্ডী পেরিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম. এ করেন। এছাড়া, রংপুর পলিটেকনিক থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেন। বর্তমানে তিনি রেডিও ও টেলিভিশনের গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। সেইসাথে চলছে গবেষণাও। তিনি ২ হাজার ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি ৫ শত, লোকগান ১ শত, আধুনিক গান ২ শত লিখেছেন। এছাড়া পালাগানও লিখেছেন পাঁচ খণ্ডে। তাঁর লিখা প্রথম ভাওয়াইয়া গান হলো :
“ও মোর দয়ার ভাবি
ও মোর গুণের ভাবি
এইবার বিয়া না দিলে মোক
যাইম বাড়ি ছাড়ি।”
এই গানটি ১৯৭৪ সালে লিখেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রোগ্রাম করেন ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে।
১৯৭৪ সালে মোগলবাসা ইউনিয়নে যাত্রাপালা হবে, নাম ” আলোমতি প্রেম কুমার “। এই যাত্রার প্রেম কুমারের চরিত্রে অভিনয় করবেন তিনি। বাবা হাজি, রাজী না। লুকিয়ে লুকিয়ে অভিনয় চালিয়ে গেলেন। রীতিমতো শো এর আগের দিন মাইকিং, যাত্রা যাত্রা যাত্রা….এক ঝাঁক ডানা কাটা পরীর সাথে আজকের আলোমতি প্রেম কুমার এর নাম ভূমিকায় অভিনয় করবেন মনির হাজির ছেলে সম্রাট। আর যায় কই? গ্রামবাসী হাজির। হাজির ছেলে এই কাজ করলে ধর্ম শেষ। কেয়ামত নাযিল। হাজি সাহেব রাগে গজগজ করতে করতে ছেলেকে ধরে এনে ঘরে দিলেন তালা। পাহারাদার বসালেন দরজায়। দস্যি ছেলে। মন তার পরে আছে যাত্রায়। তাকে পায় কে? জানালা কেটে যাত্রা মণ্ডপে অভিনয় করে ভোরে এসে ঘুমাতেন। আবারও গুনগুন শুরু গ্রামের লোকদের। সম্রাট কাজটা ঠিক করলো? মাথা কাটা যাবে হাজি সাহেবের। হাজী সাহেব তালা খুলে তাঁকে রিমান্ডে নিলেন। দস্যি ছেলের ব্রেন আবার ভালো। বললো, ঘরে তো তালা। গ্রামের এক মুরুব্বি বললো, তোমার মুখে তাহলে পাউডার কেনো? যাহ্। গত রাতে মুখ ধোয়ার কথা মনে ছিলো না তাঁর। সবার সামনে এক লাফ দিয়ে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে ফুপুর বাড়ি।
এই হলো আমাদের প্রাণের সম্রাট ভাই। সাধারণ বেশেই তাঁর চলাফেরা। নিরহংকার সাদাসিধে একজন। দারুণ সদালাপী। শিল্পীদের অসম্ভব সম্মান করেন। কোন শিল্পী বিপদে পরলে তিনিই আগে ছুটে যান। মানবিক গুণে গুণান্বিত। কুড়িগ্রামের ঐতিহ্যবাহি শিদল আর ঠাকরীর ডাল তাঁর পছন্দের খাবার। ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জনক। তারাও গান চর্চা করে। তাঁর সহধর্মীনি মারুফা বেগম একজন গৃহিণী।
তিনি ভাওয়াইয়া একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং বিশ্ব ভাওয়াইয়া পর্ষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। যার কার্যালয় কোলকাতায়। ৩১ টি দেশ এর সদস্য।
তাঁর প্রকাশিত কয়েকটি বই হলো : ” প্রাণের সুর ভাওয়াইয়া” ” প্রাচীন লোকসঙ্গীত” ” ছোটদের ছড়া”। তিনি বিভিন্ন পুরস্কার এ ভূষিত হয়েছেন। যেমন: ভাওয়াইয়া একাডেমী রংপুর, পশ্চিমবঙ্গ লালন একাডেমী, লোক সঙ্গীত গোষ্ঠী নদীয়া, কোলকাতা নাট্য গোষ্ঠি ইত্যাদি।
ভাওয়াইয়া সঙ্গীত যেনো নিজস্বতা ধরে রেখে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে তাঁর কাজের মাধ্যমে এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার। তিনি সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে আরও বহুদিন আমাদের মাঝে থাকুন এই কামনা করি।
তাঁর বিখ্যাত একটা গানের লিংক দেয়া হলো।
২৬টি মন্তব্য
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলি — “ভাওয়াইয়া সঙ্গীত যেনো নিজস্বতা ধরে রেখে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে তাঁর কাজের মাধ্যমে এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার। তিনি সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে আরও বহুদিন আমাদের মাঝে থাকুন এই কামনা করি”।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি না লিখলে কিছুই জানা হতো না।
গানের লিংক জুড়ে দিয়েন।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই।
লিংক দেয়া হয়েছে।
ছাইরাছ হেলাল
গুড, ভেরি গুড।
আলমগীর সরকার লিটন
সুন্দর লেখেছেন কিছু জানলাম আপু অনেক শুভেচ্ছা রইল
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
আল্লাহ তাঁকে আরও সুন্দর সুন্দর গান রচনা করার সুজোগ দিন। আমি ১৯৯৮ সালে কারমাইকেল কলেজে সোহাগ নামে একটি প্রায় ১০ বছরের ছেলের ভাওয়াইয়া গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। জানিনা সে আজ কতদুর ভাওয়াইয়া গানে আছেন।
আমিও হেলাল ভাইয়ের মতো বলতে চাই কিছু গানের লিংক দিবেন।
আরজু মুক্তা
ভাওয়াইয়া গান চটুল এবং জীবনের কথা বলে।
লিংক দেয়া হয়েছে।
ধন্যবাদ ভাই
মোঃ মজিবর রহমান
ধন্যবাদ আপু।
প্রদীপ চক্রবর্তী
লোকটাকে এমনিতে টিভির পর্দায় দেখতাম।
কিন্তু এ গুণী মানুষের এতকিছু জানতাম না।
খুবি ভালো লাগলো দিদি অজানা বিষয় উপস্থাপন করার জন্য।
তাই কৃতজ্ঞতা জানাই।
আরজু মুক্তা
দাদা, আসলেই উনি গুণি।
ধন্যবাদ আপনাকে
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভাইয়া অনেক মজার মানুষও বটে। খন্দকার বাড়ির ছেলের এমন কান্ড করতে তাকে অনেক খড় কাঠ পোডাতে হয়েছে। তার জন্য দোয়া রইলো।
আপনি আমাদের এলাকার এমন গুণী মানুষকে তুলে ধরলেন এজন্য ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আপনি ব্লগের পোস্টে পাবেন, ধরলা নদী এবং শ্রদ্ধেয় কছিম উদ্দীন কে নিয়ে লেখা। সময় করে পড়ে আসবেন নিশ্চয়।
দোয়া করবেন আমার জন্য।
ধন্যবাদ আপনাকে
হালিমা আক্তার
ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গানের প্রতি দুর্বলতা আছে।এ গানের মধ্যে গ্রাম বাংলার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আপনার পোস্টের মাধ্যমে একজন গুনী শিল্পী সম্পর্কে জানা হলো। অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
জি আপা এই গানগুলিই মাটির গান।
ধন্যবাদ আপা
নার্গিস রশিদ
রংপুর আর রংপুরের মাটি, আবহাওয়া, প্রকৃতি , গাছপালা, বৃষ্টি আমার জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। আসলে যেখানে একটা মানুষের শৈশব , কৈশোর কাটে যেখানে মানুষ বড় হয়ে উঠে সেই জায়গাকে খুব বেশী আপন লাগে। রংপুরের ভাওইয়া গান শুনলে মনে হয় চলে গেছি সেই বোন বাদাড়ে, শঠি গাছ, কোঁচ ফুল, ঢেঁকি শাক এর বনে । ঘাগট নদী, তিস্তা, চিকনাই এর ধারে।
শুনবো এই গান গুলো। অনেক ধন্যবাদ ।
আরজু মুক্তা
আপনার বর্ণনা শুনে আমিও ঘুরে এলাম। আমার বাড়িও রংপুর। আসেন একদিন। ভাওয়াইয়া গান হলো প্রাণের গান, মাটির গান।
ধন্যবাদ আপা
সুরাইয়া পারভীন
আপনার এই পোস্ট পড়েই জানতে পারলাম তাঁর সম্পর্কে। চমৎকার লিখেছেন আপু। অনেক অনেক ধন্যবাদ রইলো
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
শুভ কামনা
রেজওয়ানা কবির
ছবিতে শ্রদ্ধেয় সম্রাট স্যারের পাশে সফি আংকেল, ভাওয়াইয়ার আর একজন প্রতিভা। সম্রাট স্যার আমাদের কুড়িগ্রামের গর্ব,আমাদের অহংকার। তাকে আরও অনেক ভালো ভালো গান আমাদের দেয়ার সুযোগ দিক আল্লাহর কাছে এই দোয়া করি,সুস্থ থাকুক,ভালো থাকুক।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপু কুড়িগ্রামের এক রত্নকে সোনেলায় উন্মোচনের জন্য।
আরজু মুক্তা
শ্রদ্ধেয় কছিম উদ্দীনকে নিয়ে আমার একটা লেখা আছে। সেই সাথে ধরলা নদী নিয়েও। সময় করে পড়িয়েন।
অবশ্যই, ভাইয়ার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
শুভ কামনা সবসময়
রেজওয়ানা কবির
ও আর একটা কথা যে পিকটা দিয়েছেন সেদিন আমি আর আজাদও ঐ প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলাম। প্রোগ্রামটি এপার বাংলা ওপার বাংলার ভাওয়াইয়া সংবর্ধনা ছিল,স্থানঃ স্টেডিয়াম কুড়িগ্রাম।
আরজু মুক্তা
খুব ভালো লাগলো শুনে। এবার কিন্তু দেখা হলেই দুজনার গান শুনবো।
সাবিনা ইয়াসমিন
গান শুনলাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এমন একজন গুণী শিল্পীর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য, তাকে এত সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য।
তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, তিনি তার গানের জগতে আরও উজ্জ্বলতম হয়ে উঠুক।
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
আপনাকে ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে কমেন্ট করার জন্য। উনি সবার মাঝে এভাবেই আলো ছড়াক।
শুভ কামনা আপা