আমি যে ঘটনা লিখবোঃ
রিদি। গ্রামের ক্লাস ফোরের এক শিশু। ভালো স্বচ্ছল পরিবারের আদরের শিশু। তিন ভাই বোন। রিদি বড়। গ্রামের মফস্বলে বিদ্যুত পৌঁছালেও রাস্তায় কোনো আলো কেউ কোনোদিন হয়ত দেখেনি সন্ধ্যার পরে। কেন সরকারের উন্নয়নের এই সুবিধাটা দিতে এতো গাফিলতি ? ধুর আমি কোথা থেকে কোথায় গেলাম!
রিদি, হেসে খেলে দূরন্ত শৈশব কাটানোই তার বয়সের ধর্ম। রিদির মা শীতের পিঠা তৈরী করেছিলো। রিদির ফুফু থাকতো তাদের বাড়ি থেকে বিশ গজ দূরে। রিদির আবদার হল, সে তার ফুফুকেও পিঠা খাওয়াবে। চলল, চির চেনা গ্রামের পথ ধরে। মা, বলল,” রিদিমা আসার সময় মোড়ের দোকান থেকে কেরোসিন তেল নিয়ে আসিস, বোতলটা ধরে যা”। রিদি লক্ষি মেয়ে, বোতল হাতে হেলতে দুলতে চলে গেলো। মা তাকিয়ে রইলো মেয়ের চলার পথে। রিদি ফুফুকে বাড়ির দরজা থেকেই বলল, ” ও ফুফু আমাগের বাড়ি চলো, মা পিঠা বানাইছে”। ফুফু বলল,”বস একটু, এতো হাঁপাচ্ছিস, জিরো একটু”।
ফুফুর তার যাওয়ার দেরি দেখে, অস্থির হয়ে বলল,” শোন ফুফু, আমার স্কুল আছে, বার্ষিক পরীক্ষা। তাই তেল নিয়ে বাড়ি যাব। তুমি পরে আসো”। নির্ভয়া কিশোরী বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা রবি টকটকে লাল হল। এখুনি ঐ দিগন্তে ডুব দিবে।
মোড়ের দোকানে পৌঁছালো রিদি। দোকানদার যে তার গ্রামের ভাই। চির রোগা, অভাবের মরা, একে আবার ভয় কি ? কিন্তু রিদিকে দোকানদার জোর করে দোকানের ভিতর ঢুকিয়ে নিলো। চারিদিকে ফাঁকা। শুনশান নিরবতা। দোকানদার দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে দিলো। এদিকে সন্ধ্যা হয়, রাত হয় রিদি বাড়ি ফেরে না। মা ভাবে, ফুফুর বাড়িতে দিব্যি আছে রিদি, ফুফু ভাবে রিদি তার মায়ের কোলে।
কখনো মনে হয় মানুষ কি এতো নরপশু হতে পারে ? কেন এতো নির্মম মানুষ? আসলে তারা মানুষ নয়। মানুষ নামের পশু।
অবশেষে একসময় রিদির ফিরে আসার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে গেলে জানা যায় যে রিদি ফুফুর বাসায় নেই। যথা সম্ভব স্থানে খোঁজ নেয়ার পরে রিদির বাবা মেয়ের খোঁজ না পেয়ে, থানায় গেলো সাধারণ ডায়রি করতে। সেকেন্ড অফিসার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে, তাৎক্ষনিক গাড় নিয়ে রওনা দিল। একে তো শীতের রাত, তার উপর গ্রাম। থানা থেকে গাবগাছী গ্রামটা বেশ দূরেই ধরতে গেলে। গ্রামে পৌছে পুলিশ এবং স্থানীয় লোকজন নিয়ে রিদিকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। কিন্তু রিদিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। মোড়ের দোকানদারও ব্যাকুল হয়ে রিদিকে খুঁজতে লাগলো। অফিসার অবশ্য বার বার বলছিল, এই দোকানটা কার, এই দোকানটা খুলুন। রিদির বাবার বিশ্বাসের কারণেই দোকানটা খোলানো গেল না। এর বদলে রিদিকে খোঁজা হল, বনে বাদাড়ে। অফিসার ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসল।
ভোর রাতেই সাধারণত জুলু বাসায় ফিরত। বাসায় এসে শোয়ার কিছু পরেই ড্রাইভার এসে বলল,
” স্যার রিদির লাশ পাওয়া গেছে”।
জুলু খুবই দ্রুত বের হয়ে গেলো। আমি সাধারণত থানার কোনো ব্যাপারেই নাক গলাই না। ভাবলাম, চরে পদ্মায় প্রায়ই লাশ পাওয়া যায়। এটা হয়ত তাই। আমি নিরাপদ নাগরিক, শান্তিতে ঘুমাতে গেলাম।
সারাদিন গেলো। জুলু আসল সন্ধ্যায় বাসায়। আমি ওকে জীবনে অনেক মামলার প্রেক্ষিতে লাশ দেখতে দেখেছি। এতো বিচলিত হতে দেখিনি। এ যেন কেমন জুলু? আমি ঘরে বসে বাইরের কিছুই জানার কথা না। জুলি গোসল করে বারান্দায় বসলে, বললাম কি হয়েছে? বলল “আমি যদি কখনো চাকরি ছেড়ে দেই তুমি মেনে নেবে “? আমি খুবই অবাক হলাম। পায়ের কাছে মোড়া নিয়ে বসলাম। সত্যি, আমি এই জুলিকে দেখিনি কখনো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। রাতের রিদির ঘটনা খুলে বলতে লাগলো। বলল,”গতকাল একটা বাচ্চা মেয়ে হারাইছে, জানো”? আমি বললাম,”হ্যাঁ, শুনছিলাম তুমি ফোনে বলছিলে।”
ও বলল,”মেয়েটিকে যে কীভাবে মেরেছে, রীতু তুমি দেখলে সহ্য করতে পারবে না।
-খুলে বলো।
– (জুলির ভাষায়) আমরা যখন রিদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলাম। তখন মেয়েটা আমাদের আশেপাশেই ছিলো। দোকান ঘরে। ওর বাবার কারনে দোকানঘরটি খোলা হল না। ইশশ, যদি খুলতাম, ভেঙ্গে ফেলতাম, অন্তত বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতো।
– খোলোনি কেন ?
– আসলে দোকানদার লোকটার একটা ছেলে আছে, ছোট। বউটা আবার প্রেগনেন্ট। দোকানদারের মা ধূর্ত শিয়াল। আমি যখন দোকানটা খুলতে বলছিলাম তখন ঐ দোকানদার ছিলো না। ও প্রথমে গ্রামবাসীর সাথে রিদিকেও খোঁজার নাটক করেছে। ওর আবার রক্তের সমস্যা আছে। তাই ঔষধ আনতে হয় পাবনা থেকে। ও ওষুধ আনার কথা বলে, পুলিশ যাওয়ার পরপরই সরে যায়। এতো লোকের ভিড়ে পুলিশের এটা খেয়াল করা মুশকিল, যে কোন লোক গেলো কোন লোক থাকলো। তাও অন্ধকার রাত।একে তো গরীব মানুষ, তার উপর রিদির বাবার বিশ্বাস, না এই ছেলে এই কাজ করতে পারে না। তাই তখন ওর দোকানটা খুলে দেখা হয় নি। অথচ ওর মা সবই জানতো।
লাশ পেলে কোথায় ?
– কিছু দূরে এক ঝোপের ভিতর। লাশ বোলো না,বাচ্চা বলো।
– স্যরি।
– এমন বীভৎস ভাবে বাচ্চাটাকে ফেলে রাখছে ! মুখে মুড়ি গুজে দেওয়া ছিলো। এতটুকু বাচ্চার যোনিতে কাঁথা মুড়ে দিয়ে রাখছে।
– আর শুনতে চাইনা।
-ছেলের মাকে ধরে নিয়ে এসেছি। মাই ছেলেকে সাহায্য করেছে, বাচ্চাটাকে দোকান থেকে ঝোপের আড়ালে রেখে আসতে। ছেলের রক্তমাখা কাপড় ধুইয়ে দিয়েছে। ছেলেকে গরম পানি করে দিছে গোসল করতে। জানো রীতু, বাচ্চাটার ঘাড়টা মটকে দিছে। প্রথমে ছেলেটি শিশুটিকে মুখে কাপড় গুজে রেপ করে। পরে মেরে ফেলে। বাড়িতে গিয়ে ওর মাকে বলে।
দিন যায় ছেলেটি আর ধরা পড়ে না। কোথায় যে হাওয়া হয়েছে কেউ জানেনা। কোনো ক্লু ই পুলিশ খুঁজে পায় না। দিনের পর দিন পুলিশের লোক ঐ ছেলের বৌ এর বাপের বাড়ি পাহারা দেয়, তাও পায় না। ঢাকার প্রতিটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে তার ছবি পাঠানো হয়, রোগের বিবরন দিয়ে। আজ এতো বছরেও তাকে পাওয়া যায়নি।
স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা যখন আমার বাসার সামনে মিছিল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমি এতো বেশি অসহায় বোধ করতম যা ভাষায় প্রকাশে অক্ষম। মনে হত আমি হতভাগা মা, আমি অসহায়, আমি ব্যার্থ সমাজের নাগরিক।
এমন অপরাধী্দেরকে ধরতে পুলিশের তাৎক্ষনিক লোকবল হয়ত দায়ী। পর্যাপ্ত সময় হয়ত দায়ী। তদন্তকারী কর্মকর্তার হঠাৎ বদলির কারনে এমন গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো শেষ করা যায় না। মামলাগুলো শেষ করতে হলে তদন্তের এইসব অফিসার মামলা পুরো শেষ না হওয়া পর্যন্ত বদলি হবে না, সিনিয়র অফিসাররা মামলার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা। রাজনৈতিক চাপ মুক্ত রাখতে হবে মামলায়। মামলার ভুল হলে কোর্টে জবাব দিহির ব্যাবস্থা থাকতে হবে।
১৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
আমি ভাবতেই পারিনা মানুষ এত নির্মম কিভাবে হয়?
একজন মানুষ এতবড় একটি জঘন্য ঘটনা ঘটিয়ে কিভাবে সে বাঁচার জন্য আবার পালিয়ে বেড়ায়?
একটি শিশুকে ধর্ষন ও হত্যা করার অনুশোচনায় মানুষ হলে তার অপরাধ স্বীকার করে নিজকেই বিচারের আওতায় আনা উচিৎ।
এই সমস্ত নরপশুদের একটিই বিচার কাম্য হতে পারে- জাষ্ট ক্রস ফায়ার।
মৌনতা রিতু
এগুলোর ক্রসফায়ার হলে মানবাধিকার কর্মিরা যে ধেই নেই করে নাচতে নাচতে পুলিশের গুষ্ঠি উদ্ধার করে। মানবাধিকার ! অবাক একটা সংস্থা বাংলাদেশে।
কাজের সময় কখনোই কথা বলতে দেখিনা। টাকা ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করতে দেখা যায় পাবলিক প্লেসেই।
ব্লগার সজীব
ঘটনাটি মনে হয় পত্রিকায় পড়েছিলাম। এত বিস্তারিত ছিল না পত্রিকায়। ঘটনার বীভৎসতায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আপু। অপরাধী ধরা পরলো না দেখে কষ্ট আরো বৃদ্ধি পেলো।
আপনার লেখা গুলো বাস্তব কাহিনীর উপর ভিত্তি করে লেখা। এধরনের মামলার অপরাধী ধরা না পরার এবং মামলা অসমাপ্ত থাকার প্রতিবন্ধকতা উপসংহারে খুব সংক্ষেপে সঠিক ভাবে বর্ণনা করলেন। খুবই ভালো একটি ব্লগ পোষ্ট এটি।
মৌনতা রিতু
সজীব এসব অপরাধী ধরা না পড়ার অনেক কারণ। যেমনঃ তাৎক্ষনিক মোবাইলের লোকেশন ট্রেস না করতে পারা, পুলিশের উপর স্নায়ু চাপ, থানার গাড়ির অভাব, পর্যাপ্ত সময়ের অভাব, এক তদন্ত অফিসারের থানার অন্যান্য কাজ, এক মামলায় দীর্ঘ মনোনিবেশ দেবার সময় না পাওয়া।
হ্যাঁ, পেপারে এসেছিলো বেশ কয়েকদিন। তারপর অন্যান্য খবরের মতো এই খবরেও ধুলো পড়ে গেছে। আর একটা জিনিস কি, বাংলাদেশের মিডিয়া এই বিষয়গুলোতে কাজ করে না। এই বিচার পাওয়াতে মিডিয়ার অবদান রাখতে পারলে, পুলিশের উপরও চাপ থাকত, রাজনৈতিক প্রভাবও কম হত।
ব্লগার সজীব
এমনি কত মামলা চাঁপা পরে যায়, এক রিদি মরে যায়, এরপরে আবার আর এক রিদি আসে, আবার আবার 🙁
মৌনতা রিতু
একে বলে সজীব ধামাচাপা। কিন্তু আর কতো ?
ইলিয়াস মাসুদ
কি বলবো কোন ভাষা পাচ্ছিনা, একবারে শেষ পর্যন্ত পড়তে অনেক কষ্ট হয়েছে।
জিসান ভাইয়ের সাথে এক মত, এই সব পশু গুলোকে সমূলে নির্মুল করতে হবে সমাজ থেকে।
জেনে ভাল লাগছে অনেক ভাল অফিসার এখনো আছে পুলিশে,যা কিনা অনেক দুর্লভ
এত নিচ,মানুষ হয়!!! শুধু শুধু পশুকে দোষ-দি, কোন পশু কি এতো নিচ অত পিচাশ হয় ? জানি না, মন টা খুব বিষন্ন হয়ে গেল ……
মৌনতা রিতু
খুবই বিভৎস এইসব চিত্র। কারো সাথেই যেন এমন ঘটে। সব বাচ্চাই নিরাপদে থাকুক।
রিমি রুম্মান
লেখাটি পড়ছি আর বার বার মনে পড়ছিল আমার ছোটবেলার খেলার সাথী “রানি”কে। ওকেও সেই ছোট্টবেলায় মেরে ফেলা হয়েছিল। প্রতিবেশী ছেলেটি রানিকে মেরে লাশ বস্তায় ভরে বৈঠকখানার ছাদে স্টোররুমে ফেলে রেখেছিল। হন্যে হয়ে খুঁজেছিল সবাই। অবশেষে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরায় খুঁজে পাওয়া যায়। অতঃপর এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ…
খুনিকে আমরা হেঁটে যেতে দেখতাম দাপটের সাথে। রানি হত্যার বিচার হয়নি আজও। 🙁
মৌনতা রিতু
বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত এইসব ব্যাপারে কাউকে ফাঁসি হতে দেখলাম না। একমাত্র ইয়াসমিন হত্যা ছাড়া। কিন্তু এই ইয়াসমিন হত্যায় একজন নিরাপদ পুলিশেরও ফাঁসি হয়।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমায় দিয়ে মন্তব্য হবে না আপু। ওটুকু বাচ্চা। উফ!
মৌনতা রিতু
নীলা আপু, ঐ সব নরপশু আমাদের আশপাশেই ঘুরে বেড়ায়। কেন যে তাদের আমরা চিনতে পারি না !
খসড়া
এ দায় আমাদের। রিতু শিরোনাম এর দায় বানান টা ঠিক করে দাও।
এই পোস্টে মন্তব্য নিঃস্প্রয়োজন।
মৌনতা রিতু
আমি তো খসড়ায় দিছিলাম। হা হা হা সব দোষ জিসান ভাইয়ের।
তুমি জান তো, তোমার রিতু ভুল করতেই পারে না। :p আমি তোমার সোনা বোন না ?