৬ষ্ট পর্ব(সত্য ঘটনা অবলম্বনে):
আমাকে বলা হলো সমস্ত শরীর ঢিলে করে দিতে। আমি কেবিনে প্রথম শ্রেনীর বিশেষ ধরনের আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। ততক্ষনে উপর থেকে আমার বন্ধুরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকেরা আমার পায়ের আঙ্গুল থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত মেসেজ করে দিচ্ছিলো। কেউ হাত, কেউ পা, কেউবা মাথা- মনে হয় কার আগে কে ভাগ্যবান হবে তার প্রতিযোগিতা দিচ্ছে। অথচ এই লোকদের মতই আরেকজন বা কয়েকজনে ঐ লোকটিকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করতে আহত অবস্থায় ভয়ঙ্কর সাগরে ফেলে দিয়েছিলো। একই আল্লাহর একটি দুনিয়ায় কত বিচিত্র রকমের সৃষ্টি যে আছে তা ঐ আল্লাহই ভালো জানেন।
আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের আন্তরিকতা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমাকে নিয়ে ওদের তৎপরতার হিড়িক দেখে আমার বিশ্বকাপ ফুটবল হিরো ম্যারাডোনার কথা মনে পড়লো। খেলার বিরতির সময় ম্যারাডোনাকেও এভাবে শরীর মেসেজ করে দিতে দেখেছিলাম টিভির পর্দায়। ওদিকে আমাকে নিয়ে ততক্ষণে উপছে পড়া দর্শকদের প্রশ্নের মিছিল শুরু হয়ে গেছে। কি নাম? বাড়ী কোথায়? কি করে? থাকে কোথায়? ইত্যাদি হরেক রকমের প্রশ্ন। আমি মোস্তফা কামাল ভাইকে ইশারা করলাম ওদের প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য। কারণ এত লোকের প্রশ্নের জবাব এক সঙ্গে দেয়া আমার জন্য সত্যিই কষ্টকর ছিলো। কামাল ভাইয়ের মুখে জবাব শোনে কেউ লিখে নিচ্ছে, আর কেউ শুনেই তৃপ্তি পাচ্ছে।
কামাল ভাইয়ের মুখে আমার নাম শুনে কেউ কেউ মন্তব্য করলো বা: বা: দেখতে হবেনা নামটা কেমন! আমার মূল নাম আহমদ রশিদ বাহাদুর হলেও সবাই শেষের অংশটিই ডাকত। তবে বিশেষ মূহুর্তে আমার আব্বা আমাকে বাহার বলে ডাকতেন। নাম শুনে কেউ কেউ বলল সত্যিই ও নামের একেবারে বাস্তব প্রতিমূর্তি, বাহাদুরই বটে! দারুণ সাহস! এভাবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হল।
এতক্ষণ পর্যন্ত যাদের বাহুতে জোর ছিলো কেবল তারাই আমার কাছে আসতে পারছিলো। ঝামেলা একটু কমলে এবার মুরব্বীরা আসতে শুরু করলো। কেউ বলল- বেঁচে থাকো বাবা, জানিনা কোন মায়ের সন্তান। আল্লাহ তোমার হায়াত দারাজ করুক। কেউ কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। একজন বললেন- তোমার বাড়ী কোথায় বাবা? আমি বললাম- সাতকানিয়া। অন্যজন বলল- আমি বলছিলাম না, এ ঢাকার ছেলে হতেই পারেনা। এ আমাদের চাটগাঁর ছেলে, আমাদেরই ছেলে। মনে হলো মুরব্বির বুকটা যেন গর্বে এক বিঘত পর্যন্ত ফুলে উঠেছে। উল্লেখ্য যে, আমাদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/শিক্ষক মিলে পনের বিশ জনের একটা ত্রাণ কমিটি কুতুবদিয়া যাচ্ছিলো। সে কমিটির সু-পন্ডিত ছাত্ররা চঞ্চলতায় ইতিমধ্যেই জাহাজের যাত্রীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। আমি সাগরে যে সুইমিং জেকেট ব্যবহার করেছি সেটা তাদেরই ছিলো।
আমি যখন লোকদের সাথে কথা বলছিলাম ও সেবা নিচ্ছিলাম তখন জাহাজের সহকারী নাবিক এসে আমাকে বললেন- চলুন, সাগরের লবণাক্ত দুষিত পানি আপনার শরীরের ক্ষতি করতে পারে। পরিস্কার পানি দিয়ে গোসল করা দরকার। গেল সপ্তাহের ঘূর্ণীঝড়ে হাজার হাজার মরা মানুষ ও জীব জন্তুর মরা গলিত দেহ পানিতে মিশে আছে বলে পানিকে দুষিত বলা হচ্ছে। অন্যথায় সাগরের পানি হচ্ছে সচ্ছ, পরিস্কার এবং পবিত্র। নাবিক সাহেব আমাকে ধরে মহিলাদের বিশেষ স্নানাগারে নিয়ে গেলেন। সাপ্লাইতে পানি নাই দেখে কন্ট্রোল রুমকে বলে পানি নিলেন। আমাকে ঝরণার নীচে দাঁড় করিয়ে ইংরেজী সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নতুন পরিস্কার তোয়ালে দিয়ে গা মুছে দিলেন। তিনি নিজ হাতেই সব করলেন। আমি লক্ষ্য করলাম আগের সেই বড় তোয়ালে দিয়ে গা মুছলেন না। কারণ ঐ তোয়ালেতে জীবানু থাকার সম্ভাবনা আছে। গোসল শেষ করে তিনি আমাকে রুমে পৌছে দিয়ে গেলেন।
তারপর জাহাজের মাষ্টার এসে আমার সুবিধার দিকে বিশেষ নজর দেবার জন্য কর্মচারীদের বলে গেলেন। তিনি আমার সাথে কৌশল বিনিময় করলেন। কিছুক্ষণ পর আমার সাথে যিনি দেখা করতে আসলেন তিনি হচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। উনারাও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে কুতুবদিয়া যাচ্ছিলেন। স্যারের পরিচয় পেয়ে আমি পাশের সিটে গিয়ে আমার সিট খালী করে স্যারকে বসতে দিলাম।
আমার পাশে বসেই স্যার আমাকে ঝাঁপটে ধরলেন এবং বললেন- যুবক, তোমার সৎ সাহস দেখে আমি খুবিই খুশি হয়েছি। আরো অনেক্ষণ কথা বলার পর স্যার মানিবেগ থেকে দু’টো ভিজিটিং কার্ড বের করে আমাকে দিলেন। তারপর বললেন- বাহাদুর, এই কার্ড দুটো তুমি রাখ। এতে একটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং অপরটা চট্টগ্রাম শহরে আমার ঠিকানা। তিনি আরো বললেন- জানিনা আমি তোমার কোন উপকার করতে পারব কিনা, কিন্তু যদি তুমি মনে কর আমি তোমার কোন উপকারে আসবো; তাহলে আজ নয়, এক বৎসর বা দুই বৎসর নয়, দশ বৎসর পর হলেও তুমি যদি আমার কাছে আসো তাহলে আমি তোমার জন্য সম্ভব সব রকম চেষ্টা করবো। স্যারের কথা আমার বেশ ভাল লাগলো এবং আমি মনে মনে বেশ উৎসাহ বোধ করতে লাগলাম।
তিনি আরো বললেন- তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমাকে বড় ভাই মনে করেই তুমি আমার কাছে আসিও। আমি ধন্যবাদ দিয়ে স্যারের কার্ড দু’টো গ্রহণ করলাম।
স্যারের নাম ছিল অলক রায় এবং বাসা ছিল চট্টগ্রাম শহরের মোহাম্মদ আলী রোডে। স্যারের দু’টো কার্ডেই একটি করে কাঠের খুঁদাই করা শিল্প কর্মের ছবি ছিলো। পরে শুনেছিলাম ঐ শিল্প কর্মের জন্যে উনি স্বর্নপদক পেয়েছিলেন।
সাগরের এই ঘটনা যখন আমি লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিই তখন স্যারের সাথে চিঠিতে যোগাযোগ করেছিলাম। স্যার উত্তরও দিয়েছিলেন। তবে স্যারের কথামত কোনদিন স্যারের বাসায় যাওয়া হয়নি। সেদিন স্যার আমাকে ফিরতি চিঠিতে লিখেছিলেন-
‘‘স্নেহের বাহার,
তোমাকে ভুলিনি। জীবনে এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ সচরাচর ঘটেনা। এই সাহসী যুবকের কথা অনেককেই বলেছি। তোমার সেদিনের অনুভূতি লিখতে চাচ্ছ জেনে খুশী হয়েছি। টেলিফোন করে যে কোনদিন সন্ধ্যার পর আসতে পার।
জানিনা তোমার দেয়া ঠিকানায় আমার এ চিঠি পৌছাবে কিনা। যা’হোক, তোমার সাক্ষাতের অপেক্ষায় রইলাম।
শুভ কামনা রইল।
অলক স্যার,
১৮/০৯/১৯৯৬/চট্টগ্রাম ’’
জাহাজের ভিতরে অনেক্ষণ পর্যন্ত লোকের বেষ্টনির মধ্যে বন্ধি অবস্থায় ছিলাম বলে অশ্বস্তি বোধ করছিলাম। ওরা আমাকে বের হতে দিচ্ছে না আমার কষ্ট হবে বলে। প্রায় দু’ঘন্টা পর যখন দ্বিতলায় উদ্ধারকৃত লোকটিকে দেখতে গেলাম তখনও ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলাম-ওর অবস্থা এখন কেমন? একজন বললো- এই মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। আমি দেখলাম লোকটি একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে তখনো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে।………
(চলবে)
#আগামী পর্বে সমাপ্ত।
৮টি মন্তব্য
ইঞ্জা
রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেলাম, সত্যিই আপনি বাহাদুরই বটে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সব আল্লাহর ইচ্ছা। মানুষের প্রতি আমার সর্বোচ্চ ত্যাগ করার স্বদইচ্ছা এখানে ফুটে উঠেছে।
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। -{@
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা
নীলাঞ্জনা নীলা
ইস লোকটার জন্য মায়া হচ্ছে।
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সেদিনও শত শত মানুষের মনে লোকটির প্রতি মায়া হয়েছিলো। হয়তো যারা ফেলে দিয়েছিলো তাদেরও মায়া হয়েছিলো।
ধন্যবাদ আপনাকে পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
নীলাঞ্জনা নীলা
সত্যি বলতে কি আমি অমন টাইপ মানুষদেরকে পছন্দ করিনা। মাছের মায়ের পুত্রশোকের মতো ব্যাপার আর কি!
মেহেরী তাজ
লোকটার পরিচর্যা কেমন হয়েছিলো সেটা জানার ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
পুরের পর্ব এসেছে। পড়ে ফেল সেটা।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
জাহাজে মেডিকেল টিম ছিলো। তড়িৎ চিকিৎসা পেয়েছে।
ধন্যবাদ আপনাকে পড়ে মন্তব্য করার জন্য।