৫ম পর্ব (সত্য ঘটনা অবলম্বনে):
আরে, রশি যতো টানি ততো চলে আসতেছে কেন? তাহলে কি জাহাজ থেকে ওরা রশি ছেড়ে দিয়েছে? হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা ছোৎ কেরে উঠলো! আমি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। মনে হলো এই প্রথম বারের মত আমি কিছুটা হলেও ভয় পেলাম। এখন কি হবে? আমি এমন অবস্থানে আছি জাহাজের কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না, আবার সংকেতও দিতে পারছি না। লাইফ জেকেটের বাঁশীও নেই যে আমার উপস্থিতি এবং অবস্থান ওদেরকে জানাবো। জাহাজ বন্ধ বলে পিছনের পাঁখা না ঘুরারই কথা। কিন্তু আমি শুনেছি চলন্ত পানির ধাক্কায়ও পাঁখা ঘুরতে থাকে। তাছাড়া চলন্ত পানির মাঝে কিছু দাঁড়িয়ে থাকলে তার বিপরীত দিকের পানি এমনিতেই ঘুরতে থাকে। জাহাজের পিছনের পানিও ঘুরছিলো।
আমি চিন্তা করতেছি, এ অবস্থায় থাকলে বিপদের সম্ভাবনা ষোল আনাই থেকে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে জাহাজ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ওরা হয়তো আমার বিপদ বুঝতে পেরেই রশি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে ফেলে তো আর চলে যাবেনা! এটা মনে হতেই আমি প্রথমে হাতে এবং পরে পায়ে জাহাজের গায়ে জোরে ধাক্কা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলাম। এবার পানিও আমাকে পিছন দিকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। প্রায় পঞ্চাশ ফিটের মতো ভেসে চলার পর জাহাজের তৃতীয় তলা থেকে লোকেরা আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠলো। ততক্ষণে রশিও পানির উপরের দিকে ভেসে উঠেছে। আমি লক্ষ্য করলাম উপরের বাম দিক থেকে রশি পিছনের দিকে চলে আসছে। তাহলে ওরা শেষ পর্যন্ত রশি ছাড়েনি! আমি বুঝতে পারলাম আমার নিরাপত্তার জন্যই রশি ঢিলে করে দিয়েছিলো। উতাল-পাতাল ঢেউ আমাকে ক্রমাম্বয়ে ঘুরিয়ে জাহাজের বাম পাশ থেকে ডান পাশে নিয়ে গেলো। আমি প্রথমে যে দিকে লাফ দিয়েছিলাম এখন ঠিক তার বিপরীত দিকে অবস্থান করছি।
এদিকে জাহাজের আড়াল হওয়ায় ঢেউ অপেক্ষাকৃত কম মনে হচ্ছে। আমি জাহাজের লোকদের ইশারা করলাম তৃতীয় তলা থেকে রশি দ্বিতীয় তলার লোকদের দেওয়ার জন্য। ওরা রশি নামিয়ে দিলো। আবার দ্বিতীয় তলার লোকদের ইশারা করলাম রশি নীচের তলার লোকদের হাতে দেবার জন্য। রশি যখন নীচের তলার লোকদের হাতে চলে এলো তখন তাদের ইশারা করলাম জাহাজের মধ্যখানে যেখানে সিঁড়ি আছে সেখানে আসার জন্যে। আমার বাম হাত বন্ধ থাকলেও ডান হাতে ইশারা করতে কোন অসুবিধা হচ্ছিলো না। ওরা যখন সিঁড়ির কাছে চলে এসেছে তখন ওদেরকে রশি টানার জন্য সংকেত দিলাম।
আমার মুখে তখন বিজয়ের হাসি, চেহারায় প্রশান্তি। কারণ আমার উদ্দেশ্য প্রায় সফল হলো বলে। আমার সাথী যারা অসুস্থ অবস্থায় ঘুমাচ্ছিলো, ছাদের উপর তাদেরকেও দেখতে পেলাম। তাদের কারো চেহারাই প্রসন্ন ছিলো না। আমার মুখে হাসি দেখে ওদের মুখে হাসি ফুটল বটে কিন্তু ওরা আমার জন্য এতই উদ্বিগ্ন ছিলো যে এর জন্য অর্থাৎ আমার বাহাদুরির জন্য পরে আমাকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। কামাল ভাইতো আমাকে হারিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে আমার আম্মাকে কি জবাব দেবেন এই চিন্তায় অস্থির ছিলেন। বড়শি খাওয়া বড় মাছকে যেমন সূতা টান দিয়ে আবার ঢিলে করে দিয়ে মাছকে হয়রানী বা দূর্বল করা হয়, তেমনি বড় ঢেউ আসলে আমার রশিও ঢিলে হয়ে যায়। পর মূহুর্তে আবার টানা শুরু হয়।
আমি ক্রমশ: জাহাজের কাছে চলে আসতে লাগলাম। জাহাজ হিসেবে সিঁড়ি মোটেই সুবিধের ছিলো না। দুই দিকে রশির গিঁট দিয়ে বেঁধে কতগুলো তক্তা পর পর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, এটাই সিঁড়ি। ডক থেকে পানি ১০/১২ হাত নীচে হওয়ায় তক্তার সিঁড়ি দিয়ে বেহুশ লোকটিকে উপরে তোলা যাচ্ছে না। এমনিতে অচেতন দেহগুলো হয় ভারি, তার উপর পানি খেয়ে লোকটির হলুদাভ শরীরটা আরো ভারী হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে ঢেউয়ের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়েছে বলে আমার বাহু দুটোও দূর্বল হয়ে পড়েছিলো। অনেক কষ্টের পর আমার সর্বশক্তি ব্যয় করে লোকটিকে জাহাজের লোকদের হাতে ধরিয়ে দিলাম। ওরা কয়েক জনে ঝুকে পড়ে লোকটিকে উপরে তোলার পর আমি বললাম- এবার আমাকেও তুলুন। কারণ তখন তক্তার সিঁড়ি বেয়ে নিজে নিজে উপরে উঠার মত শক্তি আমার অবশিষ্ট ছিলোনা।
অবশেষে আমি যখন ডকে উঠে দাঁড়িয়েছি তখন বিজয়ের উল্লাসে আমার সমস্ত ক্লান্তি নিমিষে দুর হয়ে গেলো। অত:পর আমার পুরো গায়ে একটা বড় তোয়ালে জড়িয়ে দিয়ে কয়েক জনে ধরে আমাকে আমার কেবিনে নিয়ে এলো। ঐ অর্ধমৃত লোকটিকে আগেই দু’তলার মেডিকেল টিমের কাছে পৌছে দেয়া হয়েছে। আমি এমনিতে তত দূর্বল ছিলাম না। কিন্তু ওদের সেবা করার আগ্রহ দেখে আমি যেন আরো বেশী ক্লান্তি বোধ করছিলাম। আমার সেবায় একজন ২৩/২৪ বৎসরের যুবক ছিলো বেশ অগ্রগন্য। সে নিজের বড় তোয়ালে দিয়ে আমার সমস্ত শরীর মুছে ফেলার পর ঐ তোয়ালে আমার গায়ে জড়িয়ে রাখলো। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিলো যেন আমার সেবা করে সে নিজেকে ধন্য মনে করছে। ঐ ভাইটিকে এখন পেলে আমি বুকে জড়িয়ে নিতাম।……..
(চলবে)
(3 (3 (3 আগের পর্বগুলোর লিংক:
-{@ ৪র্থ পর্ব:
-{@ ৩য় পর্ব:
-{@ ২য় পর্ব:
-{@ ১ম পর্ব:
#সিরিজটি ৭ পর্বের
১৪টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আল্লাহ্র রহমত ছিলো আপনার উপরে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
অবশ্যই আল্লাহর রহমত ছিলো। অন্যথায় এমন কাজটি করা সম্ভব হতো না। আপনাকে ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্যে।
আপনার জন্য শুভ কামনা। -{@
ইঞ্জা
শুভকামনা
জিসান শা ইকরাম
আপনি এই পর্বটি আর একবার দিয়েছিলেন যতটা মনে পরে। পূর্বের পোস্ট কি করলেন?
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আমার চশমার মিসটেকের কারণে ২৪ ঘন্টা পার হওয়ার ৯ মিনিট আগেই ঐ পোষ্ট দিয়েছিলাম। রাত ৯টা ৩৫ মিনিটকে আমি ৯টা ০৫ মনে করে ৯টা ২৬ মিনিটে পোষ্ট করেছিলাম।
কিন্তু পোষ্ট দেওয়ার ৩ ঘন্টা পরে দেখি সেখানে আপনি মন্তব্য করেছেন আমার পোষ্টটি ২৪ ঘন্টা পার হবার আগেই দেয়া হয়েছে। আপনি সেখানে এটাও বলেছিলেন যে ২৪ ঘন্টা পার হবার ১মিনিট আগে দিয়েছেন বলে মডুরা আপনার পোষ্টও সরিয়ে দিয়েছিলো। রাত ১টার দিকেও আমার পোষ্টটি ছিলো। কিন্তু সকালে আর পোষ্টটি দেখিনি। মনে করেছিলাম মডারেশানটিম পরে আমার পোষ্টটি প্রকাশ করে দিবেন। প্রথম দিকে না জেনে এরকম হলে আমার একটি পোষ্ট সরিয়ে মেয়াদ পার হলে আবার প্রকাশ করে দিয়েছিলো। বর্তমান পোষ্টটি আমার টাইম লাইনে না পেয়ে আবার রিপোষ্ট করেছি।
জিসান শা ইকরাম
বুঝেছি।মডুরা খুবই নির্দয়।
তবে আইনের বাস্তবায়ন অন্য কোথাও না থাকলেও এখানে আছে, এটি ভাবতেও ভাল লাগে, কি বলেন আপনি?
শুভ ব্লগিং।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
যতদুর দেখে এসেছি ব্লগাররা খুবিই অভিমানী ও সেনসেটিভ। স্বাধীনচেতা এবং উদার। বন্ধুসুলভ এবং পরউপকারী।
অনেক ব্লগারকে দেখেছি যারা একসময় ধুমায়ে ব্লগিং করেছেন তারা সামান্য বিষয়ে রাগ করে তাদের প্রিয় ব্লগ ত্যাগ করেন। অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে আর ব্লগ মুখো করা যায় না। আইনের বাস্তবায়নেও অনেক সময় কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
কিছু মনে করবেন না, কিছু বেশী বলে ফেলেছি। আপনার জন্য শুভ কামনা।
হৃদী ব্লগিং। -{@
জিসান শা ইকরাম
ব্লগাররা অভিমানী হন এটি ঠিক।
যতসুর জানি আমি, এই সোনেলা ব্লগ দ্বারা আয়ের সামান্যতম পরিকল্পনা নেই ব্লগ পরিচালকগনের। তাই আইনের বাস্তবায়নে কোনো সংকোচ নেই। ব্লগার/ লেখকগন আসবেন যাবেন, এটিই স্বাভাবিক নিয়ম। যতটা সম্ভব নমনিয় হয়ে সব কিছু করা হয় এখানে।
মডারেটরদের প্রতি অনুরোধ থাকলো, এ বিষয়ে একটি পোস্ট দেয়ার। যাতে অফ লাইনে থেকেও নির্দিস্ট সময়ে পোস্ট দেয়া যায়।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ভালো লাগলো আপনাদের আন্তরিকতা এবং নিঃস্বার্থ ত্যাগ। তবে আমার পছন্দ হয়নি আপনাদের একটি বিষয়। তা হলো ব্লগের মাধ্যমে আয়ের পরিকল্পনা না থাকা। বেঁচে থাকার জন্য টাকার গুরুত্ব সীমাহীন। কোন কিছু অর্গানাইজ করতে গেলেও টাকা লাগে। বসে খেলে রাজার ধনও ফুরায়। আর টাকা আছে বলেই শুধু খরছ করে যেতে হবে এমন কোন কথা নেই। অলাভজনক কাজে একসময় ধ্বস নামে। আমি জানি না খরছ করার জন্য আপনাদের আয়ের সোর্স কী? যদি কোন প্রতিষ্ঠান বা বড় ব্যবসা থেকে নির্দিষ্ট কিছু ফান্ড ব্লগ চালাতে ব্যয় করেন তাহলে ভিন্ন কথা। এখন যারা ব্লগে সেবা হিসেবে দিচ্ছেন তাঁরা একসময় ব্যস্ত হয়ে যেতে পারেন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক সমস্যা থাকতে পারে।
আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম ব্লগকে গুগল এডসেন্সের অধিনে নিয়ে আসলে সমস্যা কোথায়? যেখানে গুগল থেকে প্রতি মাসে ইনকাম আসতো!
বুঝলাম আপনারা ব্লগ দিয়ে ইনকাম খেতে চান না। কিন্তু খরছ চালাবার জন্য হলেও তো এডসেন্মের আওতায় যেতে পারেন। ব্লগে প্রতিদিন ১৪৪০ মিনিট নজর রাখতে হয়। যেহেতু ব্লগাররা যখন যা ইচ্ছা পোষ্ট করে দিতে পারে, তাই এই নজরদারীর প্রয়োজন। আর এমন দায়িত্বশীল নজরদারীর জন্যই কিছু অতিরিক্ত খরছের দরকার।
বেশী বলে ফেললে ক্ষমা করবেন। (3
মেহেরী তাজ
ফাইনালি উঠেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
আপনার অবস্থা তো বুঝলাম কিন্তু সেই ছেলের কি অবস্থা?
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আলহামদুলিল্লাহ!
পরের পর্বে আরো ক্লিয়ার হবে আশা করি।
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
যাক নিরাপদে পৌঁছোতে পারলেন।
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি চাই।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
জি, পরের পর্ব তাড়াতাড়ি দেয়া হবে।
২৪ ঘন্টার পর। -{@ (y)
নীলাঞ্জনা নীলা
ধন্যবাদ! 🙂