কে বলে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ইদ নেই, ইদের আনন্দ নেই! ইদের কেনাকাটা অর্থাৎ বাচ্চাদের পাঞ্জাবী, নিজের জামা এসব কিনতে গিয়ে তীব্র ভিড় ঠেলে ঢুকতে হয়েছে দোকানে। দোকানীরা তুমুল ব্যস্ত কাস্টমার সামলাতে। পুরো রমযান মাস নির্ধারিত সময়ের চেয়েও বেশি সময় খোলা থাকছে অধিকাংশ দোকান। বাঙালি, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি কাপড়ের দোকানগুলোতে ইদ উপলক্ষে মূল্যছাড়ের অফার দিয়েছে। ব্যস্ততার কারনে প্রায় দর্জিবাড়িগুলো অর্ডার নেয়া বন্ধ রেখেছে ইদের আগ অবধি। গ্রোসারিতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিতে হচ্ছে। ইদ পূর্ব প্রস্তুতিতে পার্লারগুলোতেও ভিড়। কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফিরবার সময়টাতে কেবলই এই দূর পরবাসের প্রথম দিকের ইদের কথাই মনে পড়ছিল। সেও আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগের কথা। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস তখন ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানিদের দখলে ছিল। কম সংখ্যক বাঙালি ছিল যদিও, কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
সেসময় ইদের দিন বলে বিশেষ কোন দিন ছিল না আমাদের। প্রতিদিনের মতই খুব ভোরে সকালের আলো ফোটার আগেই কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতাম।ফিরতাম সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে। রোজকার নিয়মে ব্যস্ততম দিনের শুরু এবং শেষ হতো। দিনভর মনের ভেতরে একটিই আনন্দ হতো এই ভেবে যে, কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেশে বাবা-মা’র সাথে কথা বলবো। এই কথা বলাটাই যেন একমাত্র বিনোদন ছিল। আমাদের ইদশেষের রাত মানে বাংলাদেশে ইদ শুরুর সকাল। আব্বা ফোন ধরে হরহর করে টুকটাক কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই বলতো, ” নামাজের দেরি হইয়া যাইতাসে, নে, তোর আম্মার সাথে কথা ক “। এরপর আম্মার সাথে কত কথা! কী শাড়ি পরেছে, কী রেঁধেছে, আমার বন্ধু এবং পাড়া প্রতিবেশি কারা কারা আসবে, ইত্যাদি। আম্মা উচ্ছ্বাসের সাথে আমার সকল কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতেন যদিও, কিন্তু ফোন রাখার আগে আমার দেশে অনুপস্থিতি নিয়ে বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস নিতেন। ফোনের দুইপ্রান্তেই আমাদের মা-মেয়ের মাঝে নেমে আসতো ভীষণ এক নৈঃশব্দ্য। এরপর অশ্রুজলে স্মৃতি হাতড়ে কেটে যেতো বাকিটা রাত। চোখের সামনে ভেসে উঠত ছোটবেলায় গ্রামে দাদার বাড়িতে কাটানো ঈদগুলো। বাবার হাত ধরে ইদ্গাহে যাওয়া, চাচা-ফুপুদের সালাম করে সালামী আদায় করা। একটু বড় হবার পর আমাদের শহুরে ইদ। চাঁদরাত থেকেই পুরো পাড়া রংবেরঙের লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠত। মাইকে কিশোর কুমারের গান বাজত রাতভর। ইদের দিন বন্ধুদের বাসায়, পাড়ায় এঘর ওঘর ঘুরে খুব দ্রুতই যেন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতো সেইসব ইদগুলোতে। আমরা আমাদের বিশালাকৃতির কাঠের বাক্সে থাকা ফিলিপস্ টিভি সেটের সামনে বসতাম ঈদের দিনের শেষ বিনোদনটুকু পাবার জন্যে। “ইদ চলে গেলো” এই ভেবে তীব্র মনখারাপ নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতাম। ইদ বিদায়ে বিষণ্ণ হতাম। রাতে ঘুমোতে গিয়ে বাতাসে নড়ে উঠা পর্দার ফাঁক ফোকর গলিয়ে বাইরের আকাশ দেখেও হাহাকার লাগতো। দিনটি শেষ হয়ে গেল! আর ইডেনে পড়ার সময় হোস্টেল থেকে ইদে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি। খরচ বাঁচিয়ে নিউমার্কেট আর গাওসিয়া মার্কেট ঘুরে ঘুরে দরদাম করে কেনাকাটার অনুভূতি ভুলার নয়। এমন কী ঘরের কাজে সহায়তাকারী ছেলেটি কিংবা মেয়েটির জন্য নতুন জামা কেনাও বাদ যেতো না। অতঃপর ভিড় ভাট্টা ঠেলে চাঁদপুরগামী লঞ্চ “ঈগল” এ উঠা। লঞ্চের ভেতরে তিল পরিমান জায়গা নেই, তবুও পুরোটা পথ কেবিনের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরাও অপার আনন্দের ছিল।
নিউইয়র্কে আমাদের প্রথম দিকের নিরানন্দের ইদ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রচুর বাংলাদেশি ইমিগ্র্যাণ্ট হয়ে এদেশে আসায় বিগত কয়েক বছরে খুব দ্রুতই যেন বদলে গেছে দৃশ্যপট। এখন চাঁদরাতে জ্যাকসন হাইটসে রাস্তার দুই পাশে ফুটপাতে মেহেদি উৎসব হয়। জনমানুষের কোলাহলে তখন পুরো এলাকাকে জনসমুদ্র মনে হয়। নিউইয়র্কের বাইরের শহর থেকেও মানুষজন আসে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। এখন ইদ উপলক্ষে নিউইয়র্কের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে ভিনদেশি শিক্ষার্থীরা জানছে। স্কুল বন্ধ থাকায় আমাদের সন্তানরা বাবার হাত ধরে ইদের নামাজে যাবার সুযোগ পাচ্ছে। ইদের দিন দলে দলে পাঞ্জাবি, টুপি পরিহিত মানুষদের জায়নামাজ হাতে হেঁটে যেতে দেখা যায়। মসজিদে, খোলা রাস্তায়, স্কুলের মাঠে দফায় দফায় ইদের নামাজ আদায় করা হয়। দিনভর পরিপাটি সাজগোজে নারীদের বেড়াতে যেতে দেখা যায়। আমরা বাচ্চাদের নিয়ে বন্ধুদের বাসায় যাই। বন্ধুরাও সপরিবারে বেড়াতে আসে। ভিনদেশে আমাদের সন্তানরা এমন একটি উপভোগ্য ধর্মীয় উৎসবের দিন পালন করতে পারায় সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
এই শহরে সন্তানদের নিয়ে যদিও বেশ আনন্দে কেটে যায় ইদের গোটা একটি দিন, তবুও দিনশেষে রাতটিকে বিষণ্ণ, একলা মনে হয়। মনে হয় কয়েক হাজার বছর আমি বাড়ি যাইনি। উঠোনের আধো অন্ধকারে রাতের জোনাকি হাত ছুঁয়ে জ্বলে উঠেনি বহুকাল। বাবার হাত ধরে ইদ্গাহে যাইনি, মায়ের হাতের পায়েস খাইনি। কতকাল কেউ ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে বলে উঠেনি “নামাজের দেরি হইয়া যাইতাসে, নে, তোর আম্মার সাথে কথা ক “। কংক্রিটের এই ঝলমলে শহরে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা জীবন দেশ ছেড়ে, প্রিয়মুখ ছেড়ে আসা আমাদের প্রবাসীদের। ইদের পরদিন থেকেই আবারও সেই রুটিন জীবন। ব্যস্ততা। সকালে উঠার তাড়া।
ইদ শেষে রাতের অন্ধকারে ক্লান্ত দেহে ঘুমের দেশে হারাতে হারাতে মৃদুস্বরে আবৃত্তি করি,
” আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি ? ”
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৫টি মন্তব্য
ইঞ্জা
মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা, আপু আপনাকে আগাম ঈদ শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
দুইশতম পোস্টে আপনাদের সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
ইঞ্জা
অভিনন্দন আপু, ঈদ মুবারক।
জিসান শা ইকরাম
ইদে নিউইয়র্কের স্কুল বন্ধ থাকে এটি প্রথম জানলাম। নিউইয়র্কের ইদ তোমার লেখায় ভালই বুঝতে পারলাম।
তোমার ছোট বেলা বা কলেজ জীবনের ইদ আমাদের মতই ছিল।
পাল্টিয়েছে ইদ কিন্তু মনের গহীনে পাল্টেনি কিছুই।
আগাম ইদের শুভেচ্ছা নাও দিদি ভাই।
রিমি রুম্মান
এবার ইদ বানান এটাই লিখেছিলাম সব লেখায়। কিন্তু প্রথম আলো এডিট করে ঈদ করে দিয়েছে সবখানে!
জিসান শা ইকরাম
দেখতে দেখতে তোমার ২০০ পোষ্ট হয়ে গেলো।
অভিনন্দন তোমাকে ২০০ তম পোষ্টের জন্য দিদি ভাই। -{@ -{@ -{@
রিমি রুম্মান
সময় সুযোগ মত লিখলে এতদিনে তিনশত পোস্ট হতো নিশ্চিত।
জিসান শা ইকরাম
তা তো অবশ্যই। ট্রিপল সেঞ্চুরী করে ফেলতে এতদিনে।
আশা করি এবছরেই ট্রিপল সেঞ্চুরীর দেখা পাবো আমরা 🙂
মৌনতা রিতু
আমি রাতে জামাকাপড় রেডি করে রাখতাম। সকালে উঠেই পরতে হবে মনে করে। ঈদের আগের রাত যেনো শেষই হতো না। আমরা ঈদের অনুষ্ঠান দেখতাম মামার বাসায়। তখন প্রথম রঙ্গীন টিভি। ঈদের দিন ছায়াছন্দ! কতো আগ্রহ নিয়ে দেখতাম।
তোমার বর্তমান শহরের ঈদ দেখে আসলাম আপু তোমার লেখায়।
চমৎকার যেনো জীবন্ত উপস্থাপন সব তোমার।
না, যে দিন চলে গেছে, তা মনের কোনায় এখনো জীবন্ত আপু।
ভালো থেকো সব সময় আপু (3 -{@
রিমি রুম্মান
এখানকার ঈদগুলোও মন্দ নয়। শুধু সবাই ঘুমিয়ে গেলে মনের জানালায় ঘুরে বেড়ায় দেশের ঈদ এর স্মৃতিগুলো। ঈদের শুভেচ্ছা জেনো। -{@
মোঃ মজিবর রহমান
সব আছে আগের মত স্রিতিতে অমর
গেছে পাল্টিয়ে সময় ও আবেগ ধরে।
ভাল লাগলো।
রিমি রুম্মান
অনেক শুভকামনা এবং ঈদের শুভেচ্ছা … -{@
মোঃ মজিবর রহমান
ঈদের শুভেচ্ছা
নীলাঞ্জনা নীলা
যে দিন চলে যায়, রেখে যায় কিছু আনন্দমাখা দীর্ঘশ্বাস।
ভালো থেকো রিমি আপু। -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থেকো তুমিও, নীলা’দি।