
আজ ০৫ অক্টোবর- বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে আজকের এই দিনটি পালিত হচ্ছে। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আপনাদের কাছে আমার অন্যতম প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় কুদ্দুস স্যারের কথা বলবো।
———————
আমি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তৃতীয় শ্রেণি থেকে এসএসসি’র এই পুরো সময়টা আমার ছাত্রজীবনের স্বর্ণকাল ছিল। কত স্মৃতিগাঁথা লেখা রয়েছে জিলা স্কুলের আঙিনার সেইসব অশ্বত্থ আর বট গাছ গুলোর প্রতিটি পাতায়! স্কুলের পিছনের পুরানো বিল্ডিংয়ে হয়তো এখনো রয়েছে আমার পায়ের ছাপ। সেই পুকুর কি এখনো আগের মতই আছে যেখানে আমরা গোসল করতাম? বিশালাকৃতির খেলার মাঠে উদ্যাম খেলাধুলা, ঝাল-মুড়িওয়ালা মান্নান মামা, ক্লাসের বেঞ্চগুলি, টিউবওয়েল, লম্বা বারান্দা, শিক্ষকদের টেবিলে কলম খেলা, বাথরুমের নিষিদ্ধ সব মজা আরো কত কি? সে সবকিছু আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
আমার আজও মনে দাগ কেটে আছে বন্ধুদের সাথে এবং শিক্ষকদের সাথে কাটানো কিছু অমূল্য সময়। শিক্ষকদের কথা আরেকদিন বলব, আজ বলি আমাদের সে সময়ের প্রধান শিক্ষক কুদ্দুস স্যারের কথা। উত্তরাঞ্চলে তার মতন কড়া শিক্ষক যার আদর্শ, মহানুভবতা, শাসন, আদর আর বুদ্ধিমত্তা এসব কিছু আজও সব ছাত্র এবং শিক্ষকদের কাছে আদর্শ ।
একদিনের কথা বলি, এসেম্বলি ফাঁকি দেওয়া আমার নিত্যদিনের স্বভাব। এ কারণে বাসা থেকে ঠিক সময় বের হয়েও এসেম্বলি’র সময় স্কুলের দেয়ালের পিছনে কিংবা ক্লাসের দরজার পাশে লুকিয়ে থাকতাম যাতে এসেম্বলিতে যেতে না হয়। কিন্তু বিধিবাম, কথায় বলে- দশ দিন চোরের একদিন গেরস্থ। ধরা পড়লাম একদিন!কুদ্দুস স্যার কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শক্তির মানুষ তা সেদিন বুঝেছিলাম। যথারীতি সবাই অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে তখন আমি স্কুলের গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম বীরের বেশে। সেদিন বারান্দা থেকেই আমাকে দেখেছিলেন তিনি। পিয়ন দিয়ে আমাকে তার রুমে ডেকে নিলেন। আমার তো অবস্থা খারাপ, ভাবছি আজই শেষ। আত্মারাম খিঁচে গেলো, পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ক্লাসের ধর্ম বই থেকে শেখা সব দোয়া দরুদ পড়া শুরু করেছি তখন। স্যারের রুমের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার রুমে আরো তিনজন শিক্ষক ছিলেন -আপেল স্যার যিনি বর্তমান প্রধান শিক্ষক, সুবোধ স্যার এবং মান্নান স্যার। কুদ্দুস স্যার তাদের সাথে কথা শেষ করে তাদের বিদায় দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। হয়তো অন্য শিক্ষকদের সামনে আমায় লজ্জা দিতে চাননি।
– স্যার আসবো?
– আয়।
ভিতরে প্রবেশ করলাম আমি।
-কিরে তুই অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়াস না?
মিথ্যা বলার সাহস তার ব্যক্তিত্বের সামনে সেদিন হয়নি, আমি বলতে পারিনি। ভাবলাম হয় এসপার নয় ওসপার। দুষ্টু ছিলাম ঠিকই কিন্তু স্যারেরা আমাদের তাদের সামনে মিথ্যা বলার শিক্ষা দেননি।
– না স্যার।
তার মানে তুই প্রায়ই ফাঁকি মারিস। সামান্য এসেম্বলি যদি ফাঁকি মারিস, জীবনের জটিল সব পরীক্ষাগুলোতে তুই তো পালিয়ে বেড়াবি। তখন কি ভিক্ষা করবি রাস্তায়?
আমি চুপ হয়ে সব শুনলাম। আর যেন এ ফাঁকিবাজি কোনদিন না দেখি বা না শুনি, যা ক্লাসে যা। সেদিন লজ্জায় অপমানে ক্লাসের সবার সামনে আমার মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল।
আর একবার স্কুল থেকে পালিয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু পিকনিক করতে গিয়েছিলাম। আমি প্রদীপ,সাব্বির,আম্মান সহ আরো কয়েকজন। সেদিনও ক্লাস টিচারের কাছে ধরা পড়েছিলাম। পরেরদিন স্কুলে এসে ভয়ে আর ক্লাস থেকে বের হইনি। ভাবলাম আজ নিশ্চিত গার্জিয়ান ডাকবে। কিন্তু না, সেদিনও আমাদের গার্জিয়ানকে ডাকা হয়নি।
কুদ্দুস স্যার আমাদের উদ্দেশে বলেছিলেন – তোদের বাবা মা অনেক কষ্ট করে এই সনামধন্য স্কুলে পড়াচ্ছেন। মনে রাখিস হাজার হাজার ছাত্রদের মধ্যে মাত্র গুটিকয়েকজন তোরা এই স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিস; এ সুযোগ হেলায় হারাসনা। অন্যান্য শিক্ষকরা আমাকে অনুরোধ করেছে তোদের বাবা মাকে এখানে ডেকে আনতে। কিন্তু আমি রাজি হইনি। তোরা যতক্ষন স্কুলে থাকবি ততক্ষনই আমার এখতিয়ারে থাকবি। তোদের ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের শিক্ষকদের। স্কুল চলাকালীন সময় তোরা যাই করবি তার দায়দায়িত্ব আমার উপরেই বর্তায়। যে ভরসায় তোদের বাবা আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তোদের বাপকে ডেকে তাঁর সেই ভরসা আর আস্থাকে আমি ছোট হতে দিতে পারি না।
আর আমাকে বললেন, তোর লজ্জা থাকলে আর কোনদিন কোন অকাম কুকাম এর বিচার নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াবি না; যা ক্লাসে যা।
সেটাই ছিল দুষ্টামির বিচার নিয়ে তার সামনে আমার শেষ দাঁড়ানো। আর কোনদিন আমাকে তার সামনে দাঁড়াতে হয় নি মাথা নিচু করে লজ্জা অপমান নিয়ে। তিনি জানতেন কিভাবে একজন পথভ্রষ্ট দুষ্টু ছাত্রকে লাইনে দাঁড় করাতে হয়, কিভাবে তার কুমতিকে সুমতির পথে আনতে হয়।
আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দেখে ভয় পায়নি এমন ছাত্র জিলা স্কুলে একজনও নেই এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। তিনি আমাদের আদর্শ ছিলেন, কেন? কারণ, কোমলে কঠোরে মেশানো কুদ্দুস স্যার ছিলেন ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের জন্য একজন অগ্রগামী সেনাপতি।
তিনি যেদিন অবসরে যান সেদিন তার সেই বিদায় অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। আমি পা ছুঁয়ে সালাম করতেই তিনি মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন- কিরে এখনো দুষ্টুমি করিস?
আমি স্মিত হাসি দিয়ে বলেছিলাম- না স্যার।
ভালো থাকিস বাবা। সৎ পথে চলিস, বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করিস আর শিক্ষক হিসেবে আমার শাসনকে আদর হিসেবেই নিস।
আমি বলেছিলাম- দোয়া করবেন স্যার।
তিনি আজ বেঁচে নেই। তবে আজ মনে হচ্ছে- আমার সীমা ছাড়ানো দুষ্টুমির সেসব ঘটনার পর আমার বাবা মাকে ডেকে অপমান করেননি বলেই তিনি আমার আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন নিশ্চয়ই। আল্লাহ আপনাকে জান্নাত বাসী করুন। ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
ছবি- রংপুর জিলা স্কুল।
১৮টি মন্তব্য
ইঞ্জা
মন ভালো হয়ে গেলো লেখাটি পড়ে, আপনার স্যার একজন যথার্থ ভালো মাপের শিক্ষক ছিলেন, উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
তৌহিদ
ধন্যবাদ দাদা, এমন শিক্ষকের কাছে দীক্ষা নিতে পেরে আম সত্যিই ধন্য।
ইঞ্জা
সত্যি তাই হওয়া উচিত ভাই।
আরজু মুক্তা
ওনার গল্প অনেক শুনেছি। ভালো থাকুন যেখানেই থাকুন।
তৌহিদ
উত্তরবঙ্গের অন্যতম আদর্শ শিক্ষক তিনি। তিনি ভালো থাকুন এটাই কাম্য।
ধন্যবাদ আপু।
মোঃ মজিবর রহমান
সকল স্যার সকল ছাত্রর ভাল চান। এটা নিশ্চিত। আমি বলছি ১০ কিংবা তার পুরবের শিক্ষকগনের কথা।
এই শিক্ককক্রাই জাতিকে মানুস কএয়ার আপ্রান চেস্টা করে গেছেন।
সব পড়া পড়ে খুব ভাল মনমুগ্ধ হলাম।
তৌহিদ
ভালো শিক্ষকের সংস্পর্শ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের বিষয়। তারা ভালো থাকুন এটাই কাম্য।
ধন্যবাদ বাই।
তৌহিদ
দুঃখিত, ভাই হবে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আল্লাহ কুদ্দুস স্যারকে ক্ষমা করে জান্নাত নসিব করুন, আমিন।
আপনার লেখাটি ভালো লেগেছে। আসলে ক্ষমা করে জানলে অনেক খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। আমরা সেটা বুঝিনা বলেই কথায় কথায় সন্তানদের শাস্তি দিয়।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাই। আল্লাহ যেন স্যারকে জান্নাত নসিব করেন।
শিক্ষক হিসেবে স্যার অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন।
নিতাই বাবু
কিছুদিন আগেও আমার প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষকের সাথে দেখা হয়ে গেল। তা ছিল আচমকা। আমি কল্পনাও করতে পারিনি স্যারের সাথে দেখা হবে। স্যারের বয়স আনুমানিক ৮০ থেকে ৮৫ বছর হবে। তবে স্যার এখনো ঔষধের দোকানে বসে ঔষধ কেনাবেচা করতে পারে। জয়তু স্যার। একজনের সাথে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে গিয়ে গ্যাস্টিকের একটা ট্যাবলেটের জন্যই স্যারের দোকানে ঢোকা। এমনিতেই চোখ গেল স্যারের দিকে। নমস্কার করতে গেলে পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় দিলাম। চিনলেন আমাকে। নমস্কার গ্রহণ করে আশীর্বাদ করলেন। সময় সময় দেখা করার জন্য বললেন। ট্যাবলেটের দাম আর রাখেননি। স্যার যাকে বলে! আমার চোখে তিনি পিতৃতুল্য।
তৌহিদ
আজকাল শিক্ষকদের মাঝে আর পিতৃসুলভ আচরন দেখা যায়না। যা আছে সেটা হচ্ছে দেনাপাওনা। এ কারনেই ছাত্ররা শিক্ষিত হয় তবে আদব কায়দা শেখেনা।
সকল শিক্ষক ভালো থাকুক এটাই কাম্য। ধন্যবাদ দাদা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আপনার শিক্ষক আপনার প্রকৃত শিক্ষাগুরু।
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো।
উনার বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করি।
সকল শিক্ষকের অগাধ শ্রদ্ধা রইলো
তৌহিদ
সকল শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ দাদা।
জিসান শা ইকরাম
শিক্ষা জীবনে অনেক শিক্ষককে পাই আমরা,
এর মধ্যে মাত্র কয়েকজন হৃদয়ের মাঝে স্থান নিতে পারেন,
স্মৃতিতে অম্লান থাকেন তারা।
আপনার কুদ্দুস স্যার তেমন একজন।
তিনি তার অপার শ্নেহ দিয়ে আপনাকে পালটে ফেলেছিলেন।
স্মৃতিক্রান্ত লেখাটি ভালো লেগেছে।
শুভ কামনা।
তৌহিদ
আমার জীবনে আচার আচরণেরর যেটুকু ভালো তা আমার শিক্ষাগুরুদের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম ভাই। স্যারের অনেক কথা আজও আমার কানে বাজে। ব্যক্তিজীবনে মেনে চলার চেষ্টা করি।
ভালো থাকবেন ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার জীবন ধন্য এমন মহামতি শিক্ষকের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন।
আল্লাহ তাঁকে বেহেস্তে দাখিল করুন।
এখনকার সময়ে অবস্থা ভিন্নতর।
তৌহিদ
সত্যি আমি ধন্য এমন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম বলে। সকল শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ ভাইজান।