
এখনো আহে নাই? কই গেল আমার নাতিডা? কাইলথন সব জায়গায় খুজ্জি। ওর বন্ধু বান্ধপ সবাইরে জিগাইছি, কেউই কইতে পারেনাই। ঢাকা মেডিকেল, পঙ্গু হাসপাতালেও আইজ সারাদিন তন্নতন্ন কইরা খুইজ্জা বেড়াইলাম। ওর লগের পোলাপাইন কইলো অয় কাইল সন্দাপন্ত এইহানেই আছিল। অগো লগে কাম করছে , তারপর সবাই বাইত গেছিলগা।
অহন খালি থানাত যাওন বাকি। আপনেরা কেউ আমার লগে এট্টু থানায় যাইবেন?
বলা শেষ হয় না, বৃদ্ধলোকটির কান্না তার গলায় আটকে থাকে।
– আরে বুড়ামিয়া এত পাগল হয়োনের কী আছে! যান বাইত যান, আমরা আগে খুইজ্জা দেহি। না পাইলে তহন থানায় যামুনে…কর্কশ গলায় জবাব দিলো মালিক প্লাস হেডমিস্ত্রি তপন মন্ডল।
বৃদ্ধলোকটি আপাতত চলে যায়..
দরজার এপার থেকে মতি সবই শুনতে পেল। তার নানা তাকে খুঁজতে এই পর্যন্ত কয়েকবার এসেছে, এখানে। প্রতিবারেই এই মানুষ গুলো বলেছে তারা জানে না মতি কোথায়।
মতি বুঝতে পারছে না এখন দিন নাকি রাত! গতকাল সন্ধ্যায় সবাইকে ছুটি দেয়ার পরে ওরা তাকে গ্যারাজের পিছনে এই ছোটো ঘরটায় এনে ঢুকিয়েছে। ঘরটা নামে স্টোররুম। গ্যারাজের প্রয়োজনীয়/অপ্রয়োজনীয় কোন জিনিসপত্রই এখানে রাখা হয় না। বিশেষ অতিথি আপ্যায়ন এবং সবার অগোচরে করা লাগে এমন কিছু কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। এমনিতে মতিদের এই ঘরে প্রবেশাধিকার ছিল দরজা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
প্রথমে দুইচারটা কিল ঘুসি,, গালাগালি।
সে কিন্তু আসলেই মোবাইলটা চুরি করেনি।
আরও যে জিনিসগুলোর কথা জানতে চাইছে সেসবের কিছুই সে জানে না। এটাও জানতো না মালিক তপন মন্ডলের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটা দেখতে ঠিক তারটারই মতো ছিল!
সে বলেছিল, ওরা বিশ্বাস করেনি।
হাত পা বাঁধার পরে ঠিক কতক্ষণ ধরে তাঁকে পেটানো হয়েছিলো ওর মনে নেই। প্রচন্ড মার খেতে খেতে ঘুমিয়ে (অজ্ঞান) পড়েছিলো এক সময়।
নানার কথা শুনে মনে হলো বন্দীদশায় কাল সারারাত আর আজকের দিন পেরিয়ে গেছে।
মতি উঠতে চেষ্টা করে। হাত পা এখন আর বাঁধা নেই, হয়তো কোন এক সময়ে কেউ এসে খুলে দিয়ে গেছে। কোমরের নীচের অংশ কেমন অসাড় আছে, ডানহাতটা একেবারেই নাড়ানো যাচ্ছে না। নড়াচড়া করতে গিয়ে অনুভব করলো যেখানে ও পড়ে আছে সেই জায়গায়টা ভেজা। কয়েকবার উঠে বসার চেষ্টা করেও সফল হতে পারলো না।
ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে দরজাটা খুলে যায়। কে যেন ওর সামনে এসে বসে, আস্তে আস্তে ডাকে।
– মতি, ও মতি বাঁইচা আছস?
– হ
– একলা উঠবার পারবি? আয় আমারে ধইরা উঠ।
কাদির মিয়া খুব সাবধানে মতিকে ধরে ধরে বাইরে নিয়ে আসে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুই চোখের একটা পুরোটা বন্ধ, আরেকটা আধবোজা চোখ মেলে সে বাইরের পৃথিবী দেখার চেষ্টা করছে। দুই পায়ে হাজারো পেরেকের খোঁচা খাওয়ার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও একবার, জীবনে প্রথমবার মতি উপলব্ধি পেল বেঁচে থাকার..মুক্তি পাওয়ার আনন্দ-অনুভূতির কাছে সব যাতণা-বেদনা তুচ্ছ।
মতির পা টলে। টলতে টলতে এক সময় গড়িয়ে পড়ে রাস্তার মধ্যে।
– আরেকটু কষ্ট কর বাপ। কুনোমতে একটা রিক্সা যোগাড় কইরা লই।
– ধুর শালা তুমি রিক্সা ছাড়াই আমারে লইতে আইছো? এর লেইগাই আমি বুড়ামানুষ দেখবার পারি না।
উনিশ বছরের মতির মুখে শালা সম্বোধনটা খারাপ লাগে না কাদির মিয়ার। ষাটোর্ধ কাদির মিয়া মতির নানার বয়সী আরেকটা বুড়ো। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে তপন মন্ডলের গ্যারাজে কাজ করতো। যতটা না গ্যারাজে কাজ করতো তারও বেশি তাকে বাইরের কাজে পাঠানো হতো। দশ বছর আগে গাড়ি সারাইয়ের কাজ শিখতে মতি যখন এই গ্যারাজে এসেছিল তখন থেকেই মতিকে স্নেহ করে কাদির মিয়া। প্রথম প্রথম কাদির মিয়া মতিকে শালা ডাকতো, মতি ডাকতো নানা।
এখানে কাদির মিয়া সবার চেয়ে বেশি বেতন পেতো, অথচ তাকে খুব একটা কাজ করতে কখনোই দেখা যেত না। কিন্তু হঠাৎ কী হলো, দুই সপ্তাহ আগে এই গ্যারাজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তপন মন্ডলের গ্যারাজের পাশে নিজেই একটা ছোটমোটো গ্যারাজ দিয়ে দিলো। মতিদের মালিক সবাইকে বলেছিল কেউ যদি কাদির মিয়ার কাছে যায় তাহলে পিটিয়ে হাড় গুড়ো করে দিবে।
মতির খুব ইচ্ছে করতো ছুটির পর কাদির নানার কাছে যেতে, তার সাথে আড্ডা দিতে।
কাদির মিয়া গেল সপ্তাহে এসে ওর হাতে একটা দামী মোবাইল ফোন গুঁজে দিয়েছিলো। বলেছিল,
– যখনই ইচ্ছা করবো মিস কল দিবি। এটার মইদ্যে সীম লাগাইন্না আছে। ইন্টারনেট দেয়া আছে। ফোনের টাকা শেষ হইয়া গেলে আমারে কইবি।
কাদির মিয়া মতিকে আপন নাতির মতো স্নেহ করতো।
পরদিন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ এসে তপন মন্ডল এবং তার কয়েকজন সহকারীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। গ্যারাজের পিছনের স্টোররুম থেকে কিছু অবৈধ অস্ত্র সহ প্রচুর পরিমানে নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই তপন মন্ডলের গ্যারাজটা প্রায় পরিত্যক্ত রুপ পেল।
মতি এখন কাদির মিয়ার গ্যারাজে যোগ দিয়েছে। দিনরাত খাঁটে। সময় পেলে তপন মন্ডলের পরিত্যক্ত গ্যারেজের পিছনে ঢুঁ মারে। ওর ইচ্ছে নিজে একটা গ্যারাজের মালিক হবে।
বিঃ- মোটর মেকানিকরা গাড়ির ওয়ার্কশপ গুলোকে ওয়ার্কশপ না বলে গ্যারাজ বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। গল্পের প্রয়োজনে প্রচলিত ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।
* ছবি – নেট থেকে।
১০টি মন্তব্য
বন্যা লিপি
হাজিরা দিয়ে গেলাম।
সাবিনা ইয়াসমিন
হাজিরা গ্রহণ করা হলো, এবার চাইলে মন্তব্য দিতে পারেন 🙂
বন্যা লিপি
ওরেব্বাবা!!!!! এ কতকাল আগের পোষ্ট???
সাবিনা ইয়াসমিন
বেশিকাল আগের না, ২০২২শে-ইতো লিখেছি 🥴
মোঃ মজিবর রহমান
এভাবেই প্রবাহিত হই মানব জিবন । যখন যেখানে তখন সেই রুপেই চলা লাগে। সেটা হোক মন্দ/অইচ্ছা নইতো ানন্দ বা প্রফুল্ল।
সাবিনা ইয়াসমিন
মানবজীবন এমনই। আনন্দ ব্যথা সুখ দুঃখ সবই মেনে নিতে হয় ইচ্ছায়,আর বেশিরভাগ অনিচ্ছায়।
ধন্যবাদ ভাইজান, শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
এরিস্টটল বলেছিলেন দাস প্রথা ছাড়া সমাজ অচল। এক শ্রেণী সবসময় দাসত্ব করবে। তার ফলেই সমাজ সুন্দর হবে। তবে দাসত্ব ও হবে সম্মানের সাথে।
আদিকাল থেকে এখনো আমরা দাসত্ব করতে দেখি সম্মান হারিয়ে। তাদের আমরা চোর ছ্যাচড বলেই গণ্য করি। অপরাধ না করেও তারা অপরাধী হয়!!
আশা করি মানসিকতা ও সময়ের পরিবর্তন আসবে!!!
সাবিনা ইয়াসমিন
দাসত্বের মাঝে সম্মান খুঁজে পাওয়া আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। মানসিকতার হয়তো পরিবর্তন ঘটবে কিন্তু বৈষম্য বিমোচনের সুযোগ নেই।
সুন্দর করে বলার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শুভ কামনা 🌹🌹
হালিমা আক্তার
আমাদের সমাজে অনেক মতি আছে। আছে তপন মন্ডলের মতো মানুষ। মতিরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখুক। সমাজের বাস্তব চিত্র। শুভ রাত্রি।
সাবিনা ইয়াসমিন
অনেক ধন্যবাদ সুপ্রিয় ব্লগার।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹