সাড়ে পাচ বছর প্রায় আমি এই কন্ডেম সেলে। মৃত্যুর অপেক্ষায়।
সাড়ে পাচ বছর ঠায় কারো বা কিছুর জন্য অপেক্ষা করা তোমার কাছে কেমন মনে হয়?
মরছিলাম আমি প্রতি পলে পলে। মুহুর্তে। ঘন্টায়.. প্রতিটি সুর্যোদয় এবং সুর্যাস্তে!
দুর্ভাগ্য আমার। একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে আমি আয়েশ করে, একটা সুর্যোদয় কিংবা সুর্যাস্ত দেখতে পারিনি.. বিগত বছরগুলিতে।
নিজের সেলে একাকী। দুপুরের খাবার শেষ করে একটু ঝিমানি মত এসেছিল কেবল। ভাত ঘুমে ঢলে পড়া কোনো ক্লান্ত প্রহর কল্পনায় আনতে চাইছিলাম বোধহয়।
এমন সময় ওনারা এলেন। সমন নিয়ে। সময় হয়েছে। অবসান হয়েছে অপেক্ষার। আমি হাসলাম তাদের মুখের ওপর। স্বস্তির হাসি 🙂
একজন ডাক্তার এলেন। অনেক কিছু পরীক্ষা করে কেন জানি আমার বাম হাতের বৃদ্ধ আংগুলটিতে বেশী সময় লাগালেন।
আমাকে কি যেন পড়ে শুনালেন। আমি শুনলাম। ঘোরের ভিতর। আমার তখন ঘোর লাগা ঘোর! কয়েদি নাম্নার ৪৪০৮৮৭ এর ঘোর।
আসলে আমি তখন আমার ভিতরের পাহাড়, নদী আর সাগরকে বিদায় জানাতে মগ্ন ছিলাম।
সময় বয়ে চলে একসময় সন্ধ্যা পেরিয়ে মধ্যরাতকে সাথে নিয়ে এলো..
আমি নিজে শুদ্ধ হলাম।
একজন কিছু পাঠ করেছিলেন। আমি নির্ণিমেষ চেয়েছিলাম তার ঠোঁটের দিকে। মুগ্ধ হয়েছিলাম কিনা?
পাগল নাকি!
মুগ্ধ হবার ওটা যথার্থ সময় ছিল কি? এই শেষ সময়ে ও আমার মেজাজ বিগড়ে দিও না তো।
আমাকে শেষ ইচ্ছের কথা জানাতে বললেন কতৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন। ডেপুটি জেলার হবেন হয়তো। কারণ জেলার সাহেবকে চিনি আমি। আসলেই কি চিনি?
কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা জানতে চাওয়া হলেও নিশ্চুপ ছিলাম আমি। তারপরও কিছু একটা হাতে করে এনেছিল এক রক্ষী। আমি ফিরেও চাইলাম না সেদিকে।
সবশেষে প্রার্থণা করার সুযোগ দিতে চাইলে প্রশ্নকর্তার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কাছে করব?’ তিনি নিশ্চুপ রইলেন।
একসময় জল্লাদরা এলো। আমার হাত পেছনে ভদ্রভাবে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো। বলল, ‘চলুন স্যার!’ আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেও, তারা ছিল নিস্প্রাণ। পাথরের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে। জল্লাদদের চোখ পাথরের-ই হতে হয়।
আমাকে যম টুপি পরাতে চাইলে, প্রথমবারের মত আমি সরব হলাম। বললাম, ‘ আমার এত বছরের থাকার পরিচিত জায়গাটুকু আমি খোলা চোখে যেতে চাই। আমাকে বধ্যভূমির প্রবেশদ্বারের আগে পরিয়ে দিও।’
আইনে নেই। তাই পরতেই হল। আমার দু’পাশে দু’জন জল্লাদ আমাকে শক্ত করে ধরে হাটিয়ে নিয়ে চলল। আমার আপন আধার ঘোর অন্ধকারের দিকে আমাকে টেনে নিয়ে চলল!
আমি হেটে যেতে যেতে, পাহাড়-নদী-ঝর্ণাদের মনে মনে ডাকলাম, ওরা দূর থেকে আবছা প্রচ্ছায়ার মত নিশ্চুপ রইলো। কাছে এলোনা।
তখন আমি কাছের মানুষদেরকে মনের চোখে দেখার চেষ্টা করলাম। বরাবরের মত আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তারা আরো দূরে সরে গেলেন আমাকে দেখে। যেন একমাত্র অচ্ছুত মানুষটি যেন আমি।
সহকারী জল্লাদরা আমাকে সাথে নিয়ে, অল্প ক’টি ধাপ পার হয়ে- আমাকে প্রধান জল্লাদের হাতে হ্যান্ডওভার করল।
আমার কাছের মানুষদেরকে শেষবারের মত ভাবলাম। ‘আমি যাদের যাদের এই জীবনে সবচেয়ে বেশী ভালবেসেছি, সবচেয়ে বেশী আঘাত আমাকে তারা-ই দিয়েছে’, আমার গলায় ফাঁসির নট যথাস্থানে বাধার সময়ে এই কথাই মনে পড়ল।
সব চুপচাপ। সময় থেমে আছে। নির্দিষ্ট ক্ষণের অপেক্ষা করছে সময়কে ঘিরে অন্যরা।
‘কেবলমাত্র তোমাদের ঘৃণা অবহেলায়ই আজ ঝুলে যেতে হলো আমায়!’ পতনের নিম্নগতির প্রথম অণুমুহুর্তে এই ছিল কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭ এর অণুভাবনা।।
#মামুনের_অণুগল্প_কয়েদি_নাম্বার_৪৪০৮৮৭
★ ছবি: ফাসির মঞ্চের
★★ পরিস্থিতি দেখে কয়েক জায়গার চন্দ্রবিন্দু ভয়ে পালিয়েছে।
১৩টি মন্তব্য
শাহানা আক্তার
গল্পটি পড়ার সময় ফাঁসির মঞ্চ চোখে ভেসে উঠছিলো… কেবলমাত্র তোমদের ঘৃনা অবহেলায়ই আজ ঝুলে যেতে হলো আমায়”…লাইনটি মাথায় ঘুরছে…
মামুন
আপনার সুন্দর অনুভূতি আমাকে আপ্লুত করলো।
শুভকামনা ফইলো।
অলিভার
দারুন অনুগল্প! অবশ্য আপনার গল্পগুলো বরাবরই ভিন্নরকমের আকর্ষনীয় হয়।
হয়তো নিশ্চিত করে মৃত্যুর খবর যারা জানে, তারাই এমন করে সম্পর্ক গুলোকে আরও নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষন করতে পারে, চাইতে পারে আকূল ভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সান্নিধ্য।
মামুন
ধন্যবাদ ভাই অলিভার।
আপনার ফেসবুক একাউন্টটি কি এখনো রয়েছে?
আপনি কিভাবে হারিয়ে গেলেন জানি না।
আপনার অনুভবের সাথে সহমত পোষণ করছি।
ভালো থাকুন।
শুভেচ্ছা..
অলিভার
ফেসবুক একাউন্টটি এখনো রয়েছে, তবে তা শীতনিদ্রায় ডুবে আছে 😛
হারিয়ে যাই নি, এই তো আছি এখানে সেখানে। মাঝে মাঝে আপনার পাবলিক পোষ্ট গুলো দেখি, ভালো লাগে 🙂
অলিভার
নীলাঞ্জনা আপুর মন্তব্যে আপনার প্রতি্ত্তোরটি দেখে লেখাটির লেখবার কারণটি জানলাম 🙁 খুবই দুঃখ জনক ঘটনা 😓
কর্পোরেট লেভেলের কাজ গুলো বরাবরই এমন কিছু ঘটনার জন্ম দেয়। আশা হারাবেন না। বলা হয় সম্ভাবনার একটি দরজা বন্ধ হলে আরও দশটি দরজা খুলে যায়। হয়তো তা প্রতীয়মান ভাবে থাকে না, হয়তো অপ্রতীয়মানেই হয় তাদের অবস্থান। তবুও অপেক্ষায় তাদের দেখা মেলে।
শুভ সময়ের কামনা থাকবে আপনার জন্যে -{@
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
অনু গল্পকে সংক্ষিপ্ত করে দেয় এই গল্পই হতে পারতো আরো বিস্তারিত।সুন্দর প্লট সুন্দর সাবলিল উপস্থাপনা।ধন্যবাদ মানুষ ভাই আপনার গল্প বা লেখা বরাবরই আমার নিকট খুবই প্রিয় -{@
মামুন
ধন্যবাদ মনির ভাই।
হ্যা, আপনি সত্য বলেছেন।
আসলে আমি ডান হাতের বৃদ্ধ আংগুলি দিয়ে মোবাইলে লেখি। তাই অণুগল্প-ই বেশী লেখা হয়। চাইলেও বড় লেখায় যেতে পারি না। আর ব্লগগুলিতে মোবাইলের বড় লেখাগুলিও কপি করে পোষ্ট করতে গেলে, সবটুকু পোষ্ট হয় না। তাই লেখার ক্ষেত্রটিকে ই ছোট করে নিয়েছি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
গল্প নয় যেনো চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছিলো।
মনে হচ্ছিলো কয়েদী নম্বর ৪৪০৮৮৭ আমি নিজেই নইতো!
অসাধারণ গল্প। :c
মামুন
ধন্যবাদ আপনাকে আপনার ভালোলাগার অনুভূতি জানানোর জন্য।
হ্যা, লেখার সময় আমার ও এমন মনে হয়েছিলো।
আপনাকে গল্পের পিছনের গল্পটি বলি তবে-
।
।
একটি গ্রুপের স্টোরেরস্টোরের দায়িত্ব পালন করে আসছিলামআসছিলাম গত সাড়ে পাচ বছর ধতে। একটা কম্পলায়েন্স অডিট আমার এক অধ:স্তনের ভুলে ফেল করে, এর প্রেক্ষিতে কোনো আগাম নোটিশ ছাড়া এবং কোনো ধরণের বেনিফিট দেয়া ছাড়াই গত ২৩ নভেম্বর আমাকে রিজাইন দিতে বাধ্য করা হয় 🙂
সেই দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ধাপে চলে আমাকে বের করে দেবার প্রক্রিয়া। সেটাই ফ্যাক্টরির গেট থেকে রিক্ত অবস্থায় বের হয়ে এক চা’র দোকানে বসে বসে এই গল্পটি রুপক অর্থে লেখি। তখনো ভাবছিলাম, ‘আমার বউকে কথাটা কিভাবে বলি?’
কর্পোরেট জীবনের রুড় বাস্তবতা নিয়েই গল্পটি লিখেছি।
এবার আপনি গল্পটি আরেকবার পড়ুন, দেখুন কিছু মিল খুঁজে পান কিনা এক মিড-লেভেলের কর্মকর্তার চাকরি হারানোর সাথে গল্পের কয়েদির জীবন হারানোর গল্প।
ভালো থাকুন।
শুভেচ্ছা নিরন্তর..
নীলাঞ্জনা নীলা
লেখার বেশীরভাগ ভাবনা তো জীবন থেকেই আসে। হুম এই কর্পোরেট জগৎ বড়ো ভয়ঙ্কর। গিলে খায়।
আমার এক আত্মীয় সেই আঙ্কেলের জীবনেও এমন হয়েছিলো। অসম্ভব সৎ একজন মানুষ যে কিনা কখনো একটা টাকা নিয়েও হেরফের করেনি, তাকেই চুরীর দায়ে চাকরী থেকে বের করলো তারই কলিগরা। যদিও পরে জেনেছিলো ম্যানেজমেন্ট। আঙ্কেলকে ডেকে নিয়েছিলো, কিন্তু আঙ্কেলের আত্মসম্মানবোধ এতোটাই প্রবল যে জয়েন করেননি ওখানে আর।
সততা মানুষকে অনেক ঝামেলায় ফেলে, কিন্তু সেই ঝামেলা থেকে উঠিয়েও নেয়। এমন অবস্থায় আপনাকে কি বলা উচিৎ আমি ঠিক জানিনা। তবে মন শক্ত রাখুন। ভাবীকে জানান। ভেঙ্গে পড়বেন না। কোনো এক ভালোর জন্যই আজকের এমন সময় এসেছে জীবনে। বিশ্বাস রাখুন আপনার জীবনে অনেক ভালো কিছু আসছে।
মামুন
ধন্যবাদ আপনাকে।
জি, জীবনের প্রতি এবং নিজের ওপর এখনো বিশ্বাস আছে, তাই লিখতে পারছি এখনো।
ভালো থাকুন আপনি সবসময়।
শুভ অপরাহ্ন। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ! জেনে খুব ভালো লাগলো।
শুভ সকাল আপনাকে।