হন্ডুরাস নিয়ে বেশ ভালো মাতামাতি শুরু হয়ে গেছে গতকাল থেকে। বিশ্বকাপ ফুটবলের আর মাত্র কটা দিন বাকী, পুরো দেশ বিভক্ত হয়ে গেছে দুই শিবিরে। একপাশে ব্রাজিল আর আরেক পাশে আর্জেন্টিনা। কিছুদিনের মধ্যেই রাস্তাঘাট দোকানপাট থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির ছাদ-বারান্দা সবখানে শোভা পেতে থাকবে দুই দেশের পতাকা।
কিন্তু শুধু দুই দেশ নিয়ে এই বোরিং মাতামাতি একেবারেই পছন্দ হচ্ছিলো না কিছু মানুষের। কিছুটা বিরক্তি আর কিছুটা মজা করার উদ্দেশ্যেই ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে তারা ঘোষণা দেয়, চুলোয় যাক ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা! আমরা হন্ডুরাসের সাপোর্টার
এরপর যা হলো তা তো ইতিহাস। সবাই গণহারে সেখানে গোয়িং দেয়া শুরু করলো। কিভাবে কিভাবে একটা সময় সেই স্রোতে যুক্ত হয়ে গেলো হন্ডুরাসের মানুষজনও! নাহ! ব্যাপারটা আর নিছক ফান থাকলো না। বরং দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের এক অদ্ভুত এক মাধ্যম হয়ে গেলো সেই ইভেন্টটি। (ছবিতে লিঙ্ক)
এই যে এখন আমরা হন্ডুরাস হন্ডুরাস করছি, এই দেশটার মানুষজন ফুটবল খেলা নিয়ে কতটা ক্রেজি – সে খবর কি আমরা রাখি? একটা ফুটবল ম্যাচ নিয়ে আমরা বাঙ্গালীরা আর কতই বা কাইজ্যা লাগাতে পারি? খুব বেশি হলে পাড়ায় পাড়ায় বা মহল্লায় মহল্লায় সংঘর্ষ হয়। অথচ ষাটের দশকে একটা ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র এল সালভেদরের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলো এই হন্ডুরাস। ইতিহাসে ‘ফুটবল ওয়ার’ আখ্যা পাওয়া সেই যুদ্ধের গল্পটা বলছি এখন…
১৯৬৯ সাল। বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব চলছে, ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের মূল পর্ব। মুখোমুখি দুই দল হন্ডুরাস এবং এল সালভেদর। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা, কে ছিনিয়ে নেবে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার টিকেট।
৬ই জুন ১৯৬৯। ইনজুরি টাইমে গোলের সুবাদে প্রথম ম্যাচে সালভেদরকে ১-০ গোলে পরাজিত করে হন্ডুরাস। নিজের দেশের এই পরাজয় সহ্য করতে না পেরে আমেলিয়া বোলানোস নামে ৮ বছর বয়সী এক সালভাদোরান কিশোরী আত্মহত্যা করে সেই রাতে। পরদিন খবরটি খুব গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছিলো পত্রপত্রিকায়। এতোটাই গুরুত্ব পেয়েছিলো যে স্বয়ং দেশটির প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে মন্ত্রী-আমলা এবং ফুটবল দলও তার শেষকৃত্যে উপস্থিত হয়েছিলো। সেখানে আমেলিয়াকে রীতিমতো “শহীদ” আখ্যা দেন সালভেদরের প্রেসিডেন্ট।
পরবর্তী ম্যাচটি ছিলো ১৫ই জুন, ভেন্যু সান সালভেদর। আমেলিয়া ইস্যুতে তখনো উত্তপ্ত সালভেদরের বাতাস। হন্ডুরাসের প্লেয়ারদের হোটেলের জানালায় সারা রাত ধরে ইট, পচা ডিম, আর মরা ইঁদুর নিক্ষেপ করে ক্ষুব্ধ সালভেদর সমর্থকরা। রীতিমতো সামরিক প্রহরা দিয়ে মাঠে নিয়ে আসতে হয় নির্ঘুম ও দুঃসহ রাত কাটানো হন্ডুরাসের প্লেয়ারদেরকে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গ্যালারীতে পতাকার চাইতে বেশি শোভা পাচ্ছিলো আমেলিয়ার ছবি। আর সেই সাথে রক্তের বদলা নেয়ার শপথ।
সেই ম্যাচে ৩-০ গোলে জয়লাভ করে সালভেদর। ম্যাচের শেষে হন্ডুরাসের কোচ মারিও গ্রিফিন বলেছিলেন, “আমরা খেলায় হেরেছি তাতে আমরা খুশী, জীবিত ফেরত আসতে হলে এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিলো না।” (ঠিকই আছে! জান বাঁচানো ফরজ কাজ। কত বিশ্বকাপ আসবে যাবে!) যাহোক, সেদিনও খেলা শেষে দাঙ্গায় বেশ কিছু মানুষ মারা যায়।
তখন খেলায় গোল ব্যবধান হিসাব করা হতো না। তাই আরও একটা ম্যাচ খেলা বাকী ছিলো। তবে এবার আর হোম গ্রাউন্ডে না, ভেন্যু করা হলো মেক্সিকোতে। দুই দেশের জন্যেই এই খেলাটা হয়ে উঠেছিলো প্রেস্টিজ ইস্যু। খেলা দেখতে প্রায় হাজার পাঁচেক সমর্থক বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে রওনা দেয় মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ডেকে দুই দলের প্লেয়ারদের বলে দেয়া হয়েছিলো ভালো ভাবে খেলতে, যেন তারা জিততে পারে।
অসম্ভব সব ফাউল আর গ্যালারিতে পুনঃপুন সংঘর্ষের ভেতর ১৫ই জুন অনুষ্ঠিত এই খেলায় সালভেদর জয় পায় ৩-২ গোলে। খেলা শেষ হওয়ার ঠিক কয়েক ঘণ্টার মাথায় দাঙ্গা লাগানো আর উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগে হন্ডুরাসের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে এল সালভেদর।
এরপর ১৪ই জুলাই, খেলার ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। চারদিন ব্যাপী চলা এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় দুই হাজার মানুষ, লক্ষাধিক মানুষ হয় উদ্বাস্তু। ১৮ জুলাই দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় এবং ২০ তারিখে সেটা কার্যকর হয়। (২০শে জুলাই ১৯৬৯, ঠিক যেই দিনে চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং)
তবে দৃশ্যত ফুটবল ম্যাচ থেকে দ্বন্দ্বের শুরু হলেও, আসলে সেটা একটা উছিলা ছিলো বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদরা। দুই দেশের মধ্যে আগে থেকেই সীমান্ত সংক্রান্ত ঝামেলা ছিলো। এছাড়া ছিলো অভিবাসী সমস্যাও। যাহোক, তবুও সামান্য ফুটবল খেলা থেকে দুইটি দেশের মধ্যে এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নজির খুব কমই আছে পৃথিবীতে।
ঘটনাটা একটু পাগলামী মনে হতে পারে। ফুটবলের মাঠেই যে ব্যাপারটা সমাধান হতে পারতো, তার বিনিময়ে প্রাণ গেছে অসংখ্য সাধারণ মানুষের, অনেকে হয়েছে ঘরছাড়া। তবে সাথে তুলনায় বলতে হয়, বিশ্বকাপে হন্ডুরাসকে সাপোর্ট করা নিয়ে আমরা যে রক্তপাতহীন নির্দোষ পাগলামী শুরু করেছি, তার নজিরও কি খুব একটা পাওয়া যাবে ইতিহাসে? মনে তো হয় না!
৫টি মন্তব্য
মিসু
গো হন্ডুরাস গো।
মিসু
হন্ডুরাস জ্বরে আক্রান্ত কাল থেকেই। সারাদিন ঐ ইভেন্টের লেখাগুলা পড়তেছি। আপনার লেখা থেকে নতুন তথ্য জান্তে পারলাম। ওদের সরলতা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। ধন্যবাদ লেখাটার জন্যে।
রকিব লিখন
অজানা একটা ইতিহাস জানলাম।। ধন্যবাদ আপনাকে।। (y) -{@
খসড়া
অনেকদিন পর নতুন করে ইতিহাস টা পড়ে ভাল লাগলো।
জিসান শা ইকরাম
পুরানো ইতিহাসটা আবার সামনে নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ।
আমিও হন্ডুরাসের সমর্থক হয়ে গেলাম আজ থেকে ।