হায়াত এবং মউত মহান আল্লাহ্ সুবাহানা তায়লার হাতে। ইসলামে অকাল মৃত্যু আকস্মিক মৃত্যু বা অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু বলে কিছুই নেই। মৃত্যু অবধারিত নিশ্চিত এবং অবশ্যম্ভাবী বিষয় কেননা পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। [সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৩৫”]। তারপরেও আমাদের জীবনে আমরা এমন কিছু মৃত্যু দেখি যা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক অনভিপ্রেত এবং অগ্রহণ যোগ্য মনে হয়। পাশাপাশি অনেক সময়ে মানুষের এমন অবস্থায় মৃত্যু ঘটে যা বিবেকবান মানুষের হৃদয়-মনকেও নাড়া দিয়ে যায়। আমাদের পরিবারের নিকট তেমন একটা আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত দুঃখজনক মৃত্যু হচ্ছে আমার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবুর মৃত্যু।
১৯৮৬ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর মাসে আমার সেঝভাই মরহুম আকতারুল আলম বাবু ন্যাশনাল ব্যাংক জুবিলী রোড শাখা, চট্টগ্রামে অফিসার পদে যোগদান করেন। এর পূর্বে ১২৬, আন্দরকিল্লা (লালাদিঘীর উত্তর পাড়), চট্টগ্রামে আমাদের পারিবারিক এবং প্রাচীন ঔষধের দোকান “দি রয়েল ফার্মেসী” পরিচালনা করতেন। তিনি ব্যাংকে যোগদানের পর পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় ব্যবসার ধরণ পাল্টে নতুনভাবে অন্য ব্যবসা শুরু করা হবে। সে লক্ষ্যে ২১/০৯/১৯৮৬ সালে আমি বাবু দাদার সঙ্গে ঔষধের স্টক মিলানোর কাজ শুরু করি। সেদিন ছিল শুক্রবার। আনুমানিক সাড়ে এগারটা দিকে তিনি হঠাৎ বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুইটি এলমাসিল এম এস ট্যাবলেট চুষতে থাকেন কিন্তু তাতেও তাঁর বুকের ব্যাথার উপশম হয়নি। অগত্যা বারটার দিকে দুইজনেই বাসায় ফিরে আসি। সন্ধ্যার দিকে বুকের ব্যাথা না কমায় এবং অস্বস্থি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ফুফাতো ভাই ডাঃ আহমেদ মাহমুদ আরজু’র সঙ্গে কথা বলে তাঁর পাঁচলাইশের ফেয়ার হেলথ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। আমিও সঙ্গে ছিলাম। সকালে ভালো এবং বড় একটা কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। শনিবার দিন মোটামুটি ভালোই কাটে। রবিবার সকালের দিকেও তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল। ডাঃ ফজলুল কাদেরের অধীনে ছিলেন তিনি। রোবাবারে একটা ব্লাড টেস্ট করা হয়। কিন্তু কেউ সেই ব্লাড টেস্টের রিপোর্টটি চেক করে দেখেননি । আবার দুপুর বারটার পর থেকে প্রেসার এবং পালসও চেক করা হয়নি। বিকাল থেকে বাবু দাদার শারীরিক অবস্থা হঠাৎ করে অবনতির দিকে যেতে থাকে। তাছাড়া পেটের ব্যথার জন্য সকালে বাস্কোপেন ইনজেকশন পুশ করা হয়। ইনজেকশনের ভায়ালটি দেখে আমার মেঝ দাদার সন্দেহ হয়। কেননা সে সময় তাঁর গলব্লাডার স্টোন হওয়ায় প্রায়শ তাঁকে উক্ত ইনজেকশন দেয়া হতো। তাছাড়া আমাদের পারিবারিক ঔষধের দোকান থেকে থাকায় সেই হিসেবেও তাঁর কিছু অভিজ্ঞতা ছিল। সেই সুবাদে তিনি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে বাস্কোপেন ইনজেকশনটি নকল বলে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে এ বিষয়ে কেউ খুব একটা কর্ণপাত করেন নি। মাগরিবের পর থেকে রোগীর প্রেসার এবং পালস ক্রমশ কমে যেতে থাকায় নেফ্রোলজির ডাঃ ইমরান বিন ইউনুসকে কল দেয়া হয়। উনি অনেকগুলো ওরাডক্সেন ইনজেকশন মারেন। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছিল না। রাতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কামরুল হুদাও আসেন। রাত দুইটার পরে হঠাৎ করে বাবু দাদার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হতে থাকে। ঠিক সে সময় কী দুর্ভাগ্য তাঁর অক্সিজেন সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ায় স্টোর গিয়ে দেখা যায় রিফিল করা কনো অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। সবাই এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। এক পর্যায়ে কে যেন বলে উঠেন এ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। সবাই সেদিকে ছুটে যান। এখানেও ঘটে আরেক বিপত্তি অক্সিজেন সিলিন্ডারটি রশি দিয়ে এমন শক্তভাবে বাঁধা ছিল যে তা কেউ খুলতে পারছিলেন না। পরে চুরি এনে অর্ধেক ভর্তি অক্সিজেন সিলিন্ডার রোগীকে দেয়া হয়। ২২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর ভোররাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে হঠাৎ করে বাবু দাদা শোয়া থেকে উঠে বসেন। আবার দফ করে পেছনে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েন। এমতবস্থায় ক্লিনিক ভর্তি আমাদের সকল আত্মীয় স্বজনরা দোয়া দরূদ পাঠ করতে থাকেন। অল্প কিছুক্ষণ পরেই মাত্র ৩৩ বছর বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকগমন করেন। তাঁর সংকটজনক অবস্থা দেখে আমার মা ফেয়ার হেলথের সামনের বড় বারান্দায় সিজদায় পড়ে আল্লাহ্র দরবারে তাঁর পুত্রের জন্য দোয়া করতে থাকেন। আমাদের একমাত্র বোন লিলি আপা ফেয়ার হেলথের রেলিঙয়ে উঠে পড়েন নীচে লাফ দেয়ার জন্য। ক্লিনিকে থাকা আত্মীয় স্বজনরা কোনোমতে তাঁকে নিবৃত করতে সক্ষম হন। কোনো এক সময় আমিও বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাই। শুধুই মনে পড়ছিল নীচে ক্লিনিকের ইমারজান্সিতে নিয়ে আমাকে একটা ইনজেকশন দেয়া হয়। এরপর আমি কিছুই বলতে পারিনি। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দেখি বাসার দুই তলায় সাজু দাদার বিছানায় আমি শুয়ে আছি এবং সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। পরে সেদিনই ( ২৩ সেপ্টেম্বর’৮৬) আমাদের গ্রামের বাড়ীতে তাঁকে জানাজার পরে আমাদের নতুন পারিবারিক কবরস্থানে আমার বাবার কবরের পর এক কবর জায়গা আমার মায়ের জন্য রেখে দাফন করা হয়। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সঠিক চিকিৎসার অভাবে এবং অবহেলায় মৃত্যু বরণ করেন। বাবু দাদা যদি আজকে বেঁচে থাকতেন তাহলে আজ তাঁর বয়স হতো ৬৭ বছর। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ্ সুবাহানা তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আমীন।
ছবিঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবু ।
কত মর্মান্তিক ছিল ঐ সময়টা। ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভুল চিকিৎসায় তরতাজা একটা প্রাণ চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য কল্পনা করাও সম্ভব না।
প্রতিনিয়ত কত মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে, অথচ চিকিৎসকদের এই দিকটিতে নজরদারি নেই।
আল্লাহ তায়ালা আপনার ভাইকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
সেই সময়টা আমাদের পরিবার যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে বলার কথা নয়। আমার মা এবং একমাত্র পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে চিকিৎসকরা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের মানবিক দায়িত্ব পালন করেন তবে কারোই কিছু বলার থাকেনা। আপনার সহমর্মিতার অশেষ ধন্যবাদ আপু।
১৩টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবু প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই দোয়া কবি জান্নাত বাসি হুন আমিন
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমীন। ধন্যবাদ ভাইয়া।
মোঃ মজিবর রহমান
আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরসাউস দান করুন। আমিন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমীন। ছুম্মা আমীন।
মোঃ মজিবর রহমান
আমিন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। আমিন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমীন। ছুম্মা আমীন। ধন্যবাদ আপু।
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
হ্যাঁ ভাইয়া তা সঠিক। ধন্যবাদ।
হালিমা আক্তার
আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমীন। ভালো থাকবেন আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
কত মর্মান্তিক ছিল ঐ সময়টা। ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভুল চিকিৎসায় তরতাজা একটা প্রাণ চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য কল্পনা করাও সম্ভব না।
প্রতিনিয়ত কত মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে, অথচ চিকিৎসকদের এই দিকটিতে নজরদারি নেই।
আল্লাহ তায়ালা আপনার ভাইকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
সেই সময়টা আমাদের পরিবার যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে বলার কথা নয়। আমার মা এবং একমাত্র পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে চিকিৎসকরা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের মানবিক দায়িত্ব পালন করেন তবে কারোই কিছু বলার থাকেনা। আপনার সহমর্মিতার অশেষ ধন্যবাদ আপু।