সূর্যাইয়ের পরাজয়, চোখ ও রাম্বাকে হারনো
মধ্য রাতের যমুনার চর। তালপাতার ছাউনি কাঁপছে থর থর। সেখানে শ্রীপদ, কৃষ্ণা এবং রামু সূর্যাইয়ের জন্য অপেক্ষমান। ঝড়ো দমকা হাওয়া বইছে। ক্ষণে ক্ষণে বজ্রের ধারালো চাবুক তীব্র কষাঘাতে দাগ এঁকে দিচ্ছে মেঘনীল আকাশের শরীরে। ভারী বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে মাঝে মাঝে টপ্ টপ্। সে বৃষ্টির ফোঁটা বড্ড শীতল। প্রতিটি ফোঁটার ঠাণ্ডা অনুভূতি হাড়ের গভীরে সুরক্ষিত মজ্জায় গিয়ে আঘাত হানে। ওপাড় থেকে যমুনার ফুলে ফেঁপে ওঠার শব্দ ভেসে আসছে। নদীর চরে ছনের ডগায় কিংবা কোনো বসত ভিটার বাঁশ ঝারের ডগায় ঝড়ো বাতাসের পেষণে কয়রা ঘুড়ির মতো যে সাইরেন শব্দ আসছে, সে শব্দ প্রলয়ের সন্ধিক্ষণ মনে করিয়ে দেয়। শ্রীপদ পায়চারি করছে আর বিড়ি ফুকছে। ছাউনির নীচে বসে রামু ও কৃষ্ণা ক্ষুর ধার দিচ্ছে। রাতের নিকষেও ধারালো ক্ষুরের সুতীক্ষ্ণ ক্ষণ শুভ্র রেখা দেখা যায়। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে ক্ষুরের উদ্ধত যৌবন ঝলমলিয়ে উঠে। ক্ষুর ধারের শব্দে ছুটে চলে রাতের প্রহর। ক্ষুর ধারের তীক্ষ্ণ শব্দের সাথে রামু ও কৃষ্ণার কিম্ভুত বেসুরে হাসি এক ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করে। ইতোমধ্যে সূর্যাই হাজির হয়। হঠাৎ শ্রীপদের কথা বলে ওঠা শুনে মনে হয় মৃত্যুনদীর ওপাড় থেকে কেউ কথা বলছে।
শ্রীপদ: কিয়ারে সূর্যাই, ইতনা দেরী হুয়া না, খানাপিনা কুছ হুয়া?
সূর্যাই: জ্বী হ্যাঁ, খাকে আয়া। কামকা বাত কারো, কারিয়েনা!
শ্রীপদ: দেখাহেনা ও যমুনা নদী। একবার তুম যায়েগা ফির আয়েগা, আরাম নাহি কার সাকতিহ্যায়।
সূর্যাই: জ্বী মালিক হাম কারেগা!
শ্রীপদ: যদি কারেগা না রাম্বাকো পায়েগা সাথমে চারগো গাভীন শোয়ার পায়েগা। এ দো আদমি সাক্ষী হ্যায়।
সূর্যাই: মুঝে রাম্বা চাতা হ্যায় অর কুছ নেহি চাতাহ্যায়!
রামু: ওয়া বহুত পেয়ারকা আদমি হ্যায়!
সূর্যাই: তো মালিক যায়েগা।
শ্রীপদ: রুখো! বাজীকা বাত বলো। এবার মে যায়েগা ফির আয়েগা, তো নাই কারেগা তো কেয়া হুয়া? বাজী লাগাও!
সূর্যাই: আপকা ইচ্ছা হ্যায়। আপ যো চাতাহ্যানা ওহি হোনা সাকতিহ্যায়।
শ্রীপদ: লেকিন নাহি কারেগা তোমারা দো আঁখ উঠাকে রাখদিয়া।
বাজীর কথা শুনে সূর্যাইয়ের পা থেকে মাথা অবধি ক্ষণিকের জন্য হিম হয়ে আসে। রাম্বার ভালোবাসার উষ্ণ অশরীরী স্পর্শ তার রক্তের উত্তাপ বাড়িয়ে দেয় মুহূর্তে।
সূর্যাই: জ্বী!
শ্রীপদ: বসন্ত মা কা কসম! তো জিতেঙ্গানা রাম্বা তোমারা হোগা, নেহি জিতেঙ্গানা তো হার সাকতিহ্যায় তোমারা দো আঁখ!
সূর্যাই: চলি মালিক।
দূর থেকে সূর্যাইয়ের প্রমত্ত যমুনায় ঝাপ দেবার শব্দ হয়। মুহূর্তেই সে শব্দ বাতাসে হারিয়ে যায়। সাথে সাথে প্রকট হয়ে ওঠে রামু ও কৃষ্ণার ক্ষুর ধারের তীক্ষ্ণ শব্দ। ক্ষুর ধারের ধাতব শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে আবার ছুটে চলে রাতের সময়। সূর্যাইয়ের প্রানান্তকর সাঁতার, বাজীতে জিততেই হবে। আর পারে না সূর্যাই। শরীর কখনো কখনো ইচ্ছা না থাকলেও বিরাম নেয়। ‘হায়, যমুনা তুই যদি সূর্যাইয়ের শরীর হতিস!’ শ্রীপদ পায়চারী করতে করতে বলে।
শ্রীপদ: কেয়ারে। লেকিন উল্লুকা পাঠঠে বেহুস হোতাহেনা তো মুশকিল দিয়া বাঁচ গেয়া।
রামু: জ্বী মালিক, এহসা হোগানা, চাক্কু নিকালকে দো আঁখ নিকালনেকে লিয়ে বহুত সহজ হোগা! হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…।
শ্রীপদ: হে রামু! নৌকা লেকে যাও উসকে দেখে আও ও যাতিহেনা ফের কেয়া কারতিহ্যা। লোকো ও উল্লুকা পাঠঠে গীর যাতাহেনা তো আখো উঠা নাই সাকতিহ্যায়। যাও…।
রামু: জ্বী মালিক!
শ্রীপদ: কৃষ্ণা, নারাছু ডোমকা সাথ রাম্বাকো সাদি পাক্কা কারকে আয়ানা?
কৃষ্ণা: জ্বী সব ঠিক কার দিয়া হু।
শ্রীপদ: আজ রাতমে কাম খতম কারনে পারেগা। নাইলে রাম্বা সূর্যাইকে সাথ লিয়ে ভাগ জাতাহ্যায়। নারাছু ডোম রহুত রূপাইকা মালিক। উসকো বিবি নেহি, সন্তান নেহি ও শালা বিমারি হ্যায় বহুত জরুরী মারজায়েগা। না মেরা বাহিন বিধবা হোগা, মেরা সম্মান বহুত চড়া হোগা, নারাছু ডোমকা সব রূপাইকা মালিক হাম হোগা।
কৃষ্ণা: মালিক, সূর্যাই শালাকে খুন কারকে নদীতে ভাসা দিয়া?
শ্রীপদ: নেহি কৃষ্ণা, আদমি জো মারজায়েগা না কই মুশকিল তো নেহি হোতাহ্যায়। হাম নিজ হাতে সূর্যাইর দো আঁখ উঠাকে ছোড় দিয়া। ও মার সাকতিহ্যায় হামেসা কে লিয়ে হান্দি হো সাকতিহ্যায়! হা হা হা হা…।
রামু, সূর্যাইকে কাঁধে করে নিয়ে আসে।
রামু: মালিক! ও নাহি যা সাকতিহ্যায়। ওপাড়মে অজ্ঞান হোগা।
শ্রীপদ: চু চু চু চু…। এহসা রাজী তুম কেইসে রাজী হুয়ারে সূর্যাই!
শ্রীপদ: ধর শালাকে। ওকের দু’আঁখ উঠাকে হাম নিজে হাতে মাট্টিমে গার দে। ও মরাকে জ্বালা ভোগ করতে করতে মর যাই। আঁখকে সঙ্গে ওকের মোয়া দেঠোও গারদেব। হা হা হা…। দো আঁখ মাট্টিমে গাড়া দে।
রামু ও কৃষ্ণা সূর্যাইয়ের দু’হাত পাটের দড়ি দিয়ে পেছন দিকে বেঁধে পা ভাঁজ করে নামাজের শেষ বৈঠকের মতো বসিয়ে দেয়। সূর্যাই ভীত হয় এই ভেবে যে চোখ উৎপাটনের ব্যাথা না জানি কত ভয়ঙ্কর। সে ভীতি প্রেমিকার জন্য মহৎ মৃত্যু সংকল্পকেও হার মানায়।
সূর্যাই: রামু ও কৃষ্ণা হামনিককে একই জাতকে আদমি। তুনিককে হামরেকে মাফ কর দে। হামার ভুল হোগাই।
রামু: শালা তে হামনিককে জাতকে কলঙ্ক। প্রেম খাতির মরেক্কেও এতনা ডর!
কৃষ্ণা: এতনা ডরায়েছে রাম্বা সঙ্গে প্রেম করে কায়েগারেহে?
সূর্যাই: কায়ে রাম্বাতো হামনিককেই জাত। শ্রীপদ কা বড়কা জাতকে বাঙালি?
রামু: এক জাতকে হকে ছেইকা তোরে ছেন ফকিন্নিকে সঙ্গে রাম্বা প্রেম করি? রম্বা পয়সাওয়ালা ডোমকে বহিন। রাম্বা আর তর অবস্থাকা একভা? ফকিন্নিকে বাচ্চাকে কেতনা বড়কা সাহস!
শ্রীপদ: শকোত করকে ধর শালাকে।
(…………………………………………….চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
১. http://sonelablog.com/archives/12440
২. http://sonelablog.com/archives/12475
৩. http://sonelablog.com/archives/12531
৪. http://sonelablog.com/archives/12788
৫. http://sonelablog.com/archives/12859
৬. http://sonelablog.com/archives/12944
৭. http://sonelablog.com/archives/13003
৮. http://sonelablog.com/archives/13126
৯. http://sonelablog.com/archives/13269
১০. http://sonelablog.com/archives/13617
১১. http://sonelablog.com/archives/14926
১২. http://sonelablog.com/archives/17125
১৩. http://sonelablog.com/archives/17164
১৪. http://sonelablog.com/archives/17210
১৫. http://sonelablog.com/archives/17308
১৬. http://sonelablog.com/archives/17837
১৭. http://sonelablog.com/archives/17968
১৮. http://sonelablog.com/archives/18263
১৯. http://sonelablog.com/archives/18396
৬টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
‘হায়, যমুনা তুই যদি সূর্যাইয়ের শরীর হতিস!’ লাইনটা খুব ভালো লাগলো। বাজিটা জিততে পারলোনা? 🙁
সাতকাহন
সবুরে মেওয়া ফলে
জিসান শা ইকরাম
পড়ছি আর পড়ছি -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ, জিসান ভাই, আপনার মতো আরো দু’একজন আছেন, যাঁরা আমার নিয়মিত পাঠক, আমার অসংখ্য পাঠকের দরকার নেই, আপনাদের মতো দু’একজন থাকলেই চলবে। খুব শীঘ্রই উপন্যাসটির ইতি টানবো। সাথে থাকবেন।
শিশির কনা
সময় নিয়ে পড়বো ভাইয়া। -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ, শিশির কনা।