এক সকালবেলা দেখলাম, আমার জানালা থেকে যে দুটো আম গাছ, ডাব গাছ আর অল্পকিছু বাঁশঝাড় দেখা যায়— তাদের পাতার ওপর অচিন রোদ পড়েছে। আর সেই রোদের স্পর্শ পেয়ে গাছগুলো সবুজে ঝলমল করছে। শরৎকালের রোদের খানিকটা বৈশিষ্ট্য আছে। এটি হৃদয়ের আড়মোড়া ভেঙে দেয়। আমাদের বেশীরভাগ মানুষের জীবনযাত্রা নগরঘেঁষা হওয়াতে প্রকৃতির বদলগুলো এখন খুব সহজে চোখে পড়ে না। তবে, ঋতুবৈচিত্র্য সম্পর্কে জানার জন্যে রবীন্দ্রনাথ তো আছেন। আর, কবিগুরু বলেছেন—
‘আমরা বেঁধেছি কাশেরগুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শেফালীমালা
নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা
এসো গো শারদ লক্ষ্মী,
তোমার শুভ্র মেঘের রথে
এসো চির নির্মল নীল পথে’১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতনে লেখা— এই পঙতিগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, শরৎকালকে তিনি সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে দেখেছেন। এছাড়াও ’আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা’ নামের একটি লেখাতেও, শরৎকালে প্রকৃতি সৌন্দর্যের যে আয়োজন করে— তার আবহ পুরোপুরি উঠে এসেছে। শারদলক্ষ্মীর চিত্রকল্প রবীন্দ্রনাথ রচনা করতে পেরেছিলেন।
বাংলা ভাষার অন্যতম লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও শরৎকালকে ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর লেখা দিনলিপির পাতায় পাতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৩৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, শুক্রবারে তিনি লিখেছেন,— ‘.. কি সুন্দর শরতের প্রাতঃকাল- লতায় লতায় শিশির, নবীন সূর্যালোক। বাঁধের ধারে ধারে কি চমৎকার বেগুনী বনকলমীফুল ফুটেছে, ভাগলপুরের ধারের একরকম ফুল ফুটেছে- প্রত্যেক খাদে, ডোবাতে নালফুল। তারপর গাছে গাছে- মাকালফল পেকে দুলছে- কি চমৎকার।..’
কী সুন্দর বর্ণনা! পড়ার পর উচ্ছ্বসিত হতে হয়। এর ঠিক দশবছর পর, মানে— ১৯৪৩ সালের ১৬ আগস্ট তিনি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লিখেছেন,— ‘অদ্ভুত শরতের দিনের মত রৌদ্র। নীল আকাশ। আজ বনে বনে যেন বাল্যের মত নিবিড় ঝোপের ছায়ায় মাকালফল, মটরলতা সংগ্রহ করবার দিন। মনে হয় শুধু বনে বনে বেড়াই। যেন কতকাল আগে এইসব বনের নিভৃত ছায়ায় বনের পরী হয়ে ঘুরে বেড়াতুম- অন্য কোন জন্মে। তারই স্মৃতি আমায় আজও উদ্বেল করে তোলে।’
শরৎকালের হাওয়া খানিকটা অন্যরকম। শান্ত, স্নিগ্ধ। যদিও এখনও শ্রাবণের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। বর্ষার বিপুল প্লাবনে এ সময় মাঠ-ঘাট, নদী-নালা জলে টইটুম্বুর থাকে। আর, তাদের পাশেই খোলা জায়গায় অযত্নে বেড়ে ওঠা কাশের বনে সাদা ফুল উঁকি দিচ্ছে। যারা ছবি তুলতে পছন্দ করেন— তাঁদের জন্যে শরৎকাল আদর্শ সময়। এখন সাদা মেঘ, নীল আকাশ, রোদ, হাওয়া সবই আছে। অবশ্য, ইতিমধ্যেই আমরা পূর্ণিমার বিস্ময়কর চাঁদ দেখতে পেয়েছি। জানি, মুগ্ধ হবার মত এর কোনো বর্ণনা হয় না।
তবে, শরৎ-এর নাম নিলে কেন জানি শরৎচন্দ্রের নামও এসে পড়ে। এ জন্যেই হয়তো কবি রফিক আজাদ লিখেছেন,—
‘‘শরৎ’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্র আমার চোখের সামনে
অর্থাৎ দৃষ্টিসীমার মধ্যে শারদ-আকাশ কিংবা
কাশফুল এসে দাঁড়ায় না- বরং শরৎচন্দ্র মূর্তিমান হন;
না, শরৎচন্দ্র, নীলাকাশে সমুজ্জ্বল কোনো চাঁদ নয়-
মহামতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং;
তিনি আমাদের ফুপু-খালা-মায়েদের কাছে মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন!’ছোটবেলায় আমার মনে হত শরৎচন্দ্রের নামেই শরৎকাল! অনেক পরে এই ভুল ভেঙেছে। সে যাই হোক— শুধু সৌন্দর্যপিপাসু মানুষদের নয়— এই ঋতু কালিদাস থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার-সহ আরও অনেক কবি-সাহিত্যিককে উদ্বেলিত করেছে; এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ভবিষ্যতেও তা-ই করে যাবে।
নাজমুস সাকিব রহমান
১১ অক্টোবর, ২০১৬
৮টি মন্তব্য
মৌনতা রিতু
শরৎচন্দ্রের বই খুব একটা পড়া হয়নি আমার। সমরেশ আমার প্রিয়।
নাজমুস সাকিব রহমান
শরৎ অনেক বড় লেখক। গল্প বলার যে বিস্ময়কর ক্ষমতা তার ছিল, সে ক্ষমতা সবার নেই।
নীলাঞ্জনা নীলা
শান্ত-সুন্দরী মৌনতা আপু শরৎচন্দ্রের বই পড়ো। উনার লেখায় সাধারণ মানুষের জীবন উঠে এসেছে। আমার খুব প্রিয় একজন লেখক।
ইঞ্জা
শরৎচন্দ্রের বই একবার পড়েই দেখুননা আপু, বুঝবেন গল্প কাকে বলে। 😀
ব্লগার সজীব
ওনাদের সময়ে মনে হয় শরৎ কালটা বেশী দৃশ্যমান এক্সহিল। আমি তো বর্তমানে শরৎ কালটা খুঁজেই পাইনা 🙁
নাজমুস সাকিব রহমান
অবজার্ব করুন। পেয়ে যাবেন। এখন আগের মত ধরা দেবে না। খুঁজে নিতে হবে।
নীলাঞ্জনা নীলা
ঋতুর মধ্যে আমার শরৎ সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। যদিও এখন আবহাওয়ার বদল হয়ে গেছে। আমাদের ছোটবেলায় শরৎকাল এলেই একধরণের আনন্দ। কতো যে গান গাইতাম আবার নাচতামও। অনেকের কাছে বর্ষা বেশী প্রিয়। আমার কাছে শরৎ। বিশেষ করে শরৎকালের বৃষ্টিতে ভেঁজার আনন্দও আলাদা, অন্যরকম।
শরৎচন্দ্র আমার প্রিয় একজন লেখক। অনার্সে যখন পড়ি খুব স্বপ্ন দেখতাম শরৎচন্দ্রকে নিয়ে এম.ফিল করার। কিন্তু হলো কই? ভালো লাগলো আপনার পোষ্ট।
ইঞ্জা
শরৎচন্দ্র আমারো প্রিয়, উনার লেখা বেশির ভাগ বই আমি ছোটবেলায়, মানে যখন ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ি সেউ সময়েই শেষ করেছি।
আপনার পোষ্টটি অনেক কথা মনে করিয়ে দিলো। (y)