রমাকান্তর তালের জ্ঞান নেই। তবে তিনি বলতে পারেন কোন তাল কানে ভালো লাগে। অবশ্য এ ভালো লাগার রকমফের থাকতেই পারে !
তাঁর মতে বেতালও একটা তাল, কিছু তালের নাম তিনি শুনেছেন, তার মধ্যে ঝাঁপতাল নাকি একটা তাল ! কে জানে ওতে কিভাবে ঝাঁপ দিতে দিতে তাল লাগাতে হয় ! তাঁর মত তালকানাদের এর বেশী কিই বা বলার থাকতে পারে ?
এই তাল নিয়ে জীবনের এক ঘটনার কথা রমাকান্ত কোনদিন ভুলবেন না। উমেশ বাবু ছিলেন তাঁর পাশের পাড়াতে। মোটামুটি তাঁর সাথে ভাব ছিল। পথেঘাটে দেখা হলে ঘরবারের বিস্তৃত কুশল বিনিময় হত। পরস্পরের বাড়ি মাঝে মধ্যে যাতায়াতও ছিল। তবে হ্যাঁ, উমেশ বাবু একটু হট মেজাজের লোক ছিলেন। লোকজনের সঙ্গে নাকি চট করেই তাঁর চটাচটি হয়ে যেত। তিরিক্ষি মেজাজের জন্যে লোকজন তাঁর ধার কাছ এড়িয়ে যেত। একমাত্র রমাকান্ত সেই লোক যার সঙ্গে উমেশ বাবুর শান্ত মেজাজের সম্পর্ক ছিল।
মানুষের শরীরের মধ্যেই নাকি স্থিতিস্থাপকতা রক্ষার্থে রাসায়নিক ক্রিয়া প্রক্রিয়া সদাই চলতে থাকে, যার দ্বারা মানুষের মেজাজের উতারচড়াও ঘটতে থাকে। উমেশ বাবু প্রেশারের রোগী ছিলেন। হাই লো দুটোরই শিকার ছিলেন। এই নিম্ন ও উচ্চ চাপের লোকদের গতিপ্রকৃতি নাকি এমনি হয়–হঠাৎ হঠাৎ শান্ত হওয়া ও চটে যাওয়া তার সিমটম।
ইতিমধ্যে উমেশ বাবুর একবার হার্ট এটাক হয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্ত্রী মল্লিকা হার্টের রোগীর গতিপ্রকৃতি তার স্বামী দেবতাটি থেকেই জ্ঞাত হয়েছিল। মাথা ঘোরা, চোখের সামনে অন্ধকার দেখা,হাতপা টলা, তার সঙ্গে হার্টের বেতাল গতি নাকি হার্ট এটাকের পূর্ব লক্ষণ।
রমাকান্ত জানেন, এই হার্টেরও বিবিধ তাল আছে। সে তাল স্বাভাবিক তাল। সে তাল বেতাল হলেই বুঝতে হবে আসন্ন বিপদ ! এই গতিতাল বুঝে চিকিৎসকেরা শরীরের রোগ প্রকৃতি আন্দাজ করতে পারেন। সেদিন নাকি উমেশ বাবু ঘরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বারবরা ঝুলে পড় ছিলেন। চেয়ারে বসে অনেক কষ্টে স্ত্রীকে ডেকে উঠে ছিলেন, ও গো !
স্ত্রী জানেন, স্বামী তার অসুস্থ, হুজুরে হাজির না হলে সংসারের তাল বেতাল হয়ে যেতে পারে!
–কি হল গো তোমার ? উদ্বিগ্ন ছিলেন স্ত্রী।
–বুকে হাত রেখে উমেশ অনেক কষ্টে বলে ছিলেন, বুকে ব্যথা, হার্ট ধড়ফড় করছে।
–সে কি হাসপাতালে যাবে নাকি ? উতলা স্ত্রী প্রশ্ন করেছিলেন।
ব্যথায় কাতরে উঠেছিলেন উমেশ বাবু,গলা টেনে কোন মত বলতে পারলেন, উঁ উঁ, হৃদপিণ্ড আমার…বেতাল নাচছে…! ব্যাস আর উমেশ বাবু কোন কথায় বলতে পারেন নি। জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বুঝতে পেরে ছিল। দেরী না করে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। ক ঘণ্টা পরেই তাঁর জ্ঞান ফিরেছিল। তিনদিন পরেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে ছিলেন।
এ ঘটনার মাস খানেক পরে পথে রমাকান্তর সঙ্গে উমেশ বাবুর দেখা। ডাক্তারের পরামর্শে হবে হয়তো তিনি বড় বড় পা ফেলে হাঁট ছিলেন।
–কি ব্যাপার–এখন ভালো তো ? রমাকান্তর প্রশ্ন ছিল।
–হ্যাঁ, একদম চাঙ্গা, হেসে রমেশ বাবু বলে ছিলেন।
–হঠাৎ কি হয়ে গেল মশাই আপনার ?
–আর বলবেন না–হৃদয়হীন হতে হতেও বেঁচে গেলাম।
হাসলেন রমাকান্ত। মনে মনে ভাবলেন, আজ বড় রসিক হয়ে পড়েছেন দেখি উমেশ বাবু !
–জানেন একটা বয়স ছিল, পথে ঘাটে হৃদয় চুরি হয়ে যাবার ভয় ছিল !
–কি রকম ?
–আরে মশাই, যৌবনের কথা বলছি আর প্রেম করা মানেই তো হৃদয় চুরি হয়ে যাওয়া !
এর পর হা হা, করে দুজনেই খুব হেসে ছিলেন।
–এবার আর এক অভিজ্ঞতা হল—উমেশ স্বাভাবিক মুখ করেই বলে ছিলেন।
–অভিজ্ঞতা–?
–হৃদয় আমার নাচে, ময়ূরের মত নাচে রে…এমন তালে তালে হৃদয় নাচলে কথা ছিল না, আমার হার্ট একেবারে বেতাল চালে নেচে উঠেছিল যে !
রমাকান্ত হেসে বলে ছিলেন, বে তাল মানে–ঝাঁপতাল নাকি ?
–না মশাই, অনেক তাল, ঝাঁপতাল, ঢাকতাল, করতাল সব রকম তাল মিলিয়ে আমি জড়তাল হয়ে গিয়ে ছিলাম আর কি !
সেদিন উমেশ অনেক রসসিক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
এর পর আরও কটা মাস ঘুরে গেল। একদিন দরজা খুলেই রমাকান্ত উমেশ বাবুর একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেলেন। রমাকান্ত অবাক হয়ে বলে উঠেছিলেন, কি ব্যাপার, হঠাৎ আগমন ?
–আরে মশাই আর বলবেন না, আমি নাকি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, তাই স্ত্রী আমার ঘরে রামায়ণ পাঠ দিয়েছেন। রামনাম কর্ণকুহরে ঢুকে গেলে নাকি পুণ্য সঞ্চয় হয় !
ঘরে এসে খানিকক্ষণ বসে ছিলেন উমেশ বাবু, রমাকান্ত বাবুর স্ত্রী চা এনে দিল। চায়ে চুস্কি দিতে দিতে উমেশ বলে ছিলেন, বুঝলেন রমাকান্ত বাবু ! শরীর আমার ভালো নেই, বড় দুর্বলতা অনুভব করি, এসব কথা তো আর স্ত্রীকে বলা যায় না !
রমাকান্তর স্ত্রী বলে ছিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে, রামায়ণ পাঠে নাকি আয়ু বাড়ে !
উমেশ বাবু সেদিন হেঁয়ালির মত বলে ছিলেন, হবে, তবে রামনাম নিতে নিতেই না রামনাম সত্য হয়ে যায় ?
ঠিক সে রাতেরই ঘটনা ছিল। রাতে বিবিধ বাদ্য যন্ত্র সহকারে রামায়ণ পাঠের আওয়াজ কানে আসছিল। কথা কিছু বোঝা না গেলেও ঢোল খোল করতালের আওয়াজ অন্য সমস্ত আওয়াজ ভেদ করে এসে পৌঁছচ্ছিল।
পরদিন সকালেই রমাকান্ত উমেশ বাবুর মৃত্যুর সংবাদটা পেলেন। হার্ট এটাকে মারা গেছেন উমেশ বাবু। রমাকান্ত সস্ত্রীক হাজির হয়ে ছিলেন উমেশ বাবুর বাড়ি। উমেশ বাবুর স্ত্রী ওদের দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে ছিল। বলে ছিল, আমার জন্যেই উনি মারা গেলেন দিদি ! রামায়ণ পাঠ যদি না দিতাম…
–কেন, কি হয়েছিল ? রমাকান্তর স্ত্রী বলে উঠেছিল।
–ওই ঢোলের চাপড়ের শব্দ তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না–এত শব্দ…
–সে কি ! অবাক হয়ে ছিলেন রমাকান্ত।
–হ্যাঁ, দাদা, উনি বারবার বল ছিলেন, ওই ঢোল থামাও—ওর আওয়াজ আমার হার্টে বাড়ি মেরে যাচ্ছে…
রমাকান্ত বুঝে ছিলেন, ওই ঢোলের চাপড়ে যে গভীর ঝাঁপতালের সৃষ্টি হচ্ছিল উমেশ বাবুর হৃদয় তা সহ্য করতে পারে নি। যে কথা উমেশ আগের দিন রমাকান্তর ঘরে বসে বলে এসে ছিলেন তাই শেষে সত্য হয়ে ছিল–রামনাম শুনতে শুনতে তিনি রামনাম সত্য হয়ে গেলেন !
সমাপ্ত
১০টি মন্তব্য
সাইদ মিলটন
মজা পাচ্ছিলাম পড়ে, শেষতক এমন 🙁
আপনি মশাই বেড়ে লেখেন 🙂
তাপসকিরণ রায়
আমার পাঠক কম তার বড় কারণ বোধহয় আমি সময় দিতে পারি না–অন্যের লেখা পড়ে মন্তব্য করাও বড় একটা হয়ে ওঠে না–এ জন্যে আমি ক্ষমা প্রার্থী–আমার লেখা পড়ার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
তাল-বেতালে একদম পাতাল !!! দারুন লেখা।
তাপসকিরণ রায়
ওই এক কথাই বলতে হয়–আমার পাঠক কম তার বড় কারণ বোধহয় আমি সময় দিতে পারি না–অন্যের লেখা পড়ে মন্তব্য করাও বড় একটা হয়ে ওঠে না–এ জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্যে।
লীলাবতী
তাল কেটে গেলেই সব শেষ। (y)
তাপসকিরণ রায়
আমি সময় দিতে পারি না–অন্যের লেখা পড়ে মন্তব্য করাও বড় একটা হয়ে ওঠে না–এ জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্যে।
জিসান শা ইকরাম
লেখায় মৃত্যু আসলেও হাসি থামাতে পারছি না দাদা
দারুন একটা হার্ট ড্যামেজ গল্প দিলেন 🙂
তাপসকিরণ রায়
দারুন শব্দটা শুনতে খুব ভাল লাগে। আপনাকে অনেক ধ্ন্যবাদ।
প্রহেলিকা
কবিতা ভালো লেখেন জানি তবে রম্য এই প্রথম পড়লাম আপনার, বাহ! এই না হলে লেখনী !
তাপসকিরণ রায়
বাহ শব্দটা উৎসাহ সূচক–খুব ভাল লাগল–অনেক ধন্যবাদ।