
করোনা পাল্টে দিয়েছে চেনা জীবনের ছক। বদলে দিয়েছে পৃথিবী। আগে যা ছিলো দূর কল্পনা, তা হয়তো এখন বাস্তব।
লকডাউনে যেমন অনেক পরিবারের মানুষ নিকটে চলে এসেছে। তেমনি, আবার আর্থিক অনটন বা দুইজনের মাঝে বনিবনা না হওয়াতে যে যার পথ বেছে নিয়েছে। এমনি এক পরিবারের নীরব সাক্ষী আমি। আমার স্ত্রী করোনায় মারা গেলেন। নিজের একাকীত্ব ঘুচাতে নাতনীকে নিয়ে বসি গল্পে। আমার একটাই ছেলে। পারিবারিক চরম সংকটে সে তার বৌকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। অফিসের কলিগের সাথে তার এতো প্রেম ছিলো যে তাকে নিয়েই নতুন সংসার পাতে। আমি এই বুড়ো মানুষ কেমনে বৌ মাকে ছেড়ে যাই। অমায়িক, ভদ্র মেয়েটা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। নীরবে চোখের জল ফেলে। চাকরি, পরিশ্রম আর মেয়ের আদর দিয়ে আমাকে আগলায় রাখে। এখন এই তিনজন এক পৃথিবী।
নাতনীর নাম প্রাযুক্তা। রবীন্দ্রনাথের মিনি। কথা শুরু হলে শেষ হতে চায় না। যেমনি স্কুল নাই। কারও সাথে মেলামেশা নাই। খেলাধূলাও নাই। মুখর করে রাখে সারাটা বাড়ি। ও হাসলেই বাড়ি হাসে। আমাকে গল্পের বই এর কয়েকটা প্যারা পড়তে দিয়ে বলবে, বুঝিয়ে বলো। আবার অনেক সময় কঠিন ডায়ালগ গুলো অবলীলায় বুঝে ফেলে। দারুণ ছবি আঁকে সে। দেয়ালে দেয়ালে তার পেইন্টিং। রঙে রঙিন।
আচ্ছা দাদু, তুমি কী প্রেমে পরেছিলে ?
হঠাৎ তার প্রশ্নে ফিরে গেলাম ৪০ বছরে। ক্যালেন্ডার এর পাতা বলছে ১৬ ই বৈশাখ। পাতাগুলো এক এক করে উল্টে যাচ্ছে। ঝকঝক করছে আয়নার মতো। বকবক করছে স্মৃতির পাখিরা।
নাতনীকে বললাম, প্রভা হালিশহর থাকে।
” কে দাদু ? তোমার সেই প্রেমিকা ?
“হ্যাঁরে। ইচ্ছা করছে ওদের বাসায় যেতে। ”
” এখন গেলে সবাই কী মনে করবে ? ওর চেয়ে মোবাইল নং থাকলে ফোন করে ; অন্য কোথাও দেখা করতে পারো। ”
” ও রে পাকনা বুড়ি।”
” উনি দেখতে কেমন? ”
” কবরী ! ”
কাঁপা হাতে কী প্যাড চেপে সেই নাম্বারে ডায়াল করে কিছু বলতে চেয়েও পারলামনা। অথচ অপর প্রান্ত নির্দ্বিধায় বুঝে ফেললো।
” এতোদিন পর মনে পরলো?
করোনায় ব্যস্ততা কমেছে। স্মৃতির ভীড় বেড়েছে। সিদ্ধান্ত হলো আমরা দেখা করবো। কে কখন পৃথিবী থেকে চলে যাই। হয়তো এটাই শেষ দেখা।
কর্ণফুলীর মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটছি আমি আর নাতনী। অপেক্ষার প্রহর শেষে দেখা গেলো তাকে। ভারী চশমা। তবে হাঁটার ভঙ্গি আগের মতো নেই। হাঁটুতে সমস্যা মনে হয়। টেনে টেনে হাঁটছে। নাতনী বললো তোমার বর্ণনা পারফেক্ট। এখনও কবরী।
প্রভা এসে বললো, সামনে একটু এগুতে তো পারতে। ক্লান্তিতে ক্লান্তি এসে গেছে। নাতনীকে দেখে বললো, তোমার তো সঙ্গী আছে। আমার তাও নেই।
চৌকস নাতনী নিজের পরিচয় দিলো।
সূর্য দিগন্তে ডুবু ডুবু। সমুদ্রের কাছে গেলেই দেখা যেতো নৈর্সগিক দৃশ্য। সমুদ্রের বুকে কেমনে মুখ লুকায় সূর্য।
প্রভা বললো, কেমন আছো? বিশ বছর পর দেখা। তখন মনে হয় একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো।
প্রতিউত্তরে বললাম, ” তুমি ভালো তো, কবরী ? ”
ন্যাকামি রাখো। সেই বয়স নেই। এখন শুনতে ভালো লাগে না। আমার স্বামী মারা গেছে, শুনছো? মেয়ে একটাই। থাকে ঢাকা। উৎসবে আসে। ছেলে আমেরিকা। আসা যাওয়া কম। আমি অতো বড় বাড়িতে একা। পরিচারিকা আছে। সময় কাটতে চায় না। একঘেঁয়েমি লাগে।
আমিও নিজেরটা বললাম। কথাগুলো এখন গোধূলির মতো সংক্ষিপ্ত। প্রভা উঠতে চাইলো। আমি বললাম,একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য চিঠি তো দিতে পারো? না বলা কথাগুলো রিনিঝিনি আওয়াজ তুলতো। চিঠি হয়ে যেতো চলন্ত জীবন্ত ট্রেন। অভিমান আর খুনসুটির মেলবন্ধন।
প্রভা স্মিত হাসলো। আচ্ছা, এখন থেকে সপ্তাহে একটা চিঠি দিবো। তুমি লিখবে তো?
কেনো জানি শেষোক্তি কথাটাতে তার গলা ধরে এলো। আর আমার স্তব্ধতা। বলতেও পারলাম না, আর একটু বসো।
আমার নাতনী বললো, ওনাকে অসাধারণ লেগেছে। ” অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলে” রবীন্দ্রনাথ এর এই গানটা তার জন্য পারফেক্ট।
“আরও মোলায়েম ছিলো। সংসার যুদ্ধ। এখন বুঝবি না। বড় হ আগে।”
” দাদু, তোমার সাথে ওনার বিয়ে হয়নি কেনো ? ”
” বাসায় মনে করিস। বলবো।”
এখন চিঠির অপেক্ষা। আজ পাবো পাবো করে বৃহস্পতিবার পেলাম। খাম খুলে দেখি ; হলুদ পাতায় লেখা ” মৃত্যুর ডাক এসেছে।” সাথে কতগুলো কাগজ পাঠিয়েছে। ঘেটে দেখি প্রেসক্রিপশন। কর্কট রোগে আক্রান্ত। আর তিন মাস।
নাতনী জিজ্ঞেস করলো, ” চিঠি পেয়ে খুশি না হয়ে মন খারাপ করলে যে ! ”
তাকে সব খুলে বললাম। আমার চোখে পানি দেখে, সে চমকে উঠলো।
একটা গভীর মমতার হাতের স্পর্শে খানিকটা ভরসা পেলাম মনে হলো। তবে, দীর্ঘশ্বাস প্রতিদিনের মতো চাপাই থাকলো।
২৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
সুন্দর উপস্থাপন, তবে নাতনির যা বয়স, সংলাপে তা রক্ষা হয়নি। লিখিয়ের শতভাগ মনোযোগীতা পাচ্ছি না, এই গল্পে।
পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে তাল কেটে যাচ্ছে, খেই হারাচ্ছি, খামতি কোথায়(জানি কিন্তু বলবো-না) তা আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে।
বোঝার ভুল হতেই পারে। আমি কিন্তু গল্প লেখতে পারি না। তা মনে রাখি।
আরজু মুক্তা
সংলাপগুলো ঠিক করা হলো। ঠিকেই ধরেছেন। অমনোযোগিতা। একটু অসুস্থ তাই। সাধারণত গল্প একটানে লিখি। অথচ এটা চারবারে লিখতে হয়েছে। ল্যাপস বললে সুবিধা। ঐটার ওপর কাজ করা যায়। অপেক্ষায় থাকলাম। গল্প না লিখলেও বোঝা কিন্তু যায়।
শুভকামনা ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
সাধারণত এ ভাবে বলি না, বলার ফল ভাল হয়নি, তবে মনে হয়েছে এই লেখাটি পড়ে যা যা মনে হয়েছে
(ভুল সহ) আপনাকে বলাই যায়!!এটি শুধুই ভাব প্রকাশ। আপনি ভাল লেখেন, আরও ভাল লিখবেন সেই চাওয়া থেকেই
এমন বলা। ল্যাপস!! আমি খুবই নবীশ!!
এখন সুন্দর বলতেই হচ্ছে, সুস্থ থেকে আরও লিখুন।
আরজু মুক্তা
চেষ্টা করি। দোয়ায় রাখবেন। আমরা একটা অভ্যেস খারাপ। খাতা নিয়ে বসলে, গল্প কবিতা আর্টিকেল সব লিখে ফেলি।
হালিমা আক্তার
করোনা মানুষের জীবন উলোট- পালোট করে দিচ্ছে। এতো বছর পরও হৃদয়ে টান রয়ে গেছে। একেই বলে প্রেম। শুভ কামনা অবিরাম।
আরজু মুক্তা
এই প্রেমগুলো ভালো লাগে।
শুভ কামনা আপা
রেজওয়ানা কবির
ভালো লেগেছে পুরনো দিনের স্মৃতি আর পুরোনো ভালোলাগার মানুষের শেষসময়ে দেখা, কিন্তু শেষ হইয়াও হইল না শেষ প্রেসক্রিপশনের কারনে। শেষটায় কষ্ট লাগল,পেয়েও হারালামের মত। শুভকামনা।
আরজু মুক্তা
একেবারে না থাকার চেয়ে একটু থাকা ভালো।
শুভ কামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
‘ ফাষ্ট লাভ নেভার ডাই’- গল্পে প্রতীয়মান। করোনায় জীবন ওলট পালট। মন চায় পুরোনো ক্যালেন্ডার ঘাটতে, তাদের সাথে কথা বলতে, একটু সময় দিতে। শান্তি কবে ফিরবে কে জানে?
শুভ সকাল!!!
আরজু মুক্তা
একদম। প্রথম প্রেম ভোলা যায় না।
আল্লাহ ভরসা। শান্তি ফিরুক
মোঃ মজিবর রহমান
অসম্ভব ভালো লাগলো। কতসুন্দর করে একটি বেদনার চিত্র তুলে ধরলেন ভাবাই যাই না। অতিত আমারও মনে পড়ল। সেই কারমাইকেল কলেজে সৃতি।
অশেষ ধন্যবাদ। আমি বাস্তবেই পড়েছি।
আরজু মুক্তা
ভাই এতো সুন্দর কমেন্ট পড়ে আমি আপ্লুত। আমি কৃতজ্ঞ। সবারি কম বেশি অতীত থাকে। মাঝে মাঝে আমরাও পাখা মেলে দেখে আসি।
ধন্যবাদ ভাই।
আর শুভ কামনা সবসময়
আলমগীর সরকার লিটন
খুস সুন্দর গল্প লেখেছেন যেনো বাস্তবময় স্মৃতিকথা মুক্ত আপু
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই।
শুভ কামনা সবসময়
মোঃ মজিবর রহমান
মুক্তা আপু মুক্ত করে দিলেন লিটন ভাই, হা হা হা
আরজু মুক্তা
ভাই, আমাকে বাড়িতে সবাই মুক্ত বলে।
মোঃ মজিবর রহমান
যাক লিটন ভাই তাহলে পুর্বে থেকেই জানেন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
প্রেম ভালবাসার যে কোনো বয়স নেই — একটা গভীর মমতার হাতের স্পর্শে খানিকটা ভরসা পেলাম মনে হলো। তবে, দীর্ঘশ্বাস প্রতিদিনের মতো চাপাই থাকলো।
আরজু মুক্তা
তবে, প্রথম প্রেম ভোলা যায় না।
শুভ কামনা ভাই।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
প্রথম প্রেম মানে প্রথম প্রেমই। শুভ কামনা রইলো আপা।
রিতু জাহান
আহ! স্মৃতি,, কিছু স্মৃতি কখনো বিস্মৃতি হয় না।
ক্যালেন্ডারের পাতার মতো উড়ে উড়ে টুকরো কথনজুড়ে সামনে ভাসে।
আর একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসে উড়ে যায় দূর বহদূরে,,,আবারও ফিরে আসার তাড়নায়।
আরজু মুক্তা
একদম। জীবনটাই এমন।
শুব কামনা সবসময়
তৌহিদুল ইসলাম
বাচ্চাদের অবুঝ মন, কত কথা জাগে সে মনে! দাদুর সাথে কথোপকথনরত সময়ের কথা পড়ে ভালো লাগলো আপু। কত মানুষের ভেতরে মুচরে ওঠে প্রেমের উপাখ্যান তার ইয়াত্তা নেই। ভালোবাসা অমর।
শুভকামনা আপু।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই।
ভালোবাসা অমর। কেউ বোঝে। কেই বোঝে না
শুভ কামনা সবসময়