১) একদিন আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তের বাড়িটিতে নতুন ভাড়াটিয়া এলো। পরীর মত দেখতে তিনটি ছোট ছোট মেয়ে সেই পরিবারে। ছেলের আকাঙ্ক্ষায় ওদের মা চতুর্থবারের মত সন্তানসম্ভবা। সন্তান জন্মদানের সময়টাতে তিনি হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মায়ের আঁচল ধরে ছোট্ট আমিও হাসপাতাল বেডের কোনায় দাঁড়িয়ে। মুখে অক্সিজেন মাস্কসহ হাতে, শরীরে নানান রকম স্যালাইন, সুঁই,তার প্যাঁচানো। তিনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন অনেক বড় করে। প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে তার বিশালাকৃতির পেট কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে যাচ্ছিলো। নার্সরা কেউ কেউ হাত পা চেপে ধরেছিলো। অনেক কষ্ট করে শ্বাস নেয়া। আবার ছেড়ে দেয়া। শ্বাস-প্রশ্বাস। বেডের রেলিঙের ফাঁক দিয়ে হতভম্ব হয়ে ভীত চোখে যমে-মানুষে লড়াই দেখি। একপর্যায়ে নিঃশ্বাস ছোট হতে হতে নিস্তেজ হয়ে আসে। চারিপাশে কান্নার রোল উঠে। জীবনে সেই প্রথম আমার কারো মৃত্যু দেখা। দুঃস্বপ্নের মত গেঁথে থাকে ঘটনাটি আমার শিশুমনে…
২) খুব কাছের এক ভাবী’র প্রায় এক যুগের বিবাহিত জীবন। সন্তানের জন্যে মরিয়া। একথা ওকথার মাঝে প্রায়ই সন্তানের জন্যে হাহাকার তাঁর। সেই হাহাকার আমাকে বিচলিত করে। আমি বাক্যহীন হয়ে চেয়ে থাকি অসহায় মুখখানার দিকে। মনের খুব গহীন থেকে তাঁর জন্যে দোয়া করি।…… এক সন্ধ্যায় জানালেন, তিনি সন্তানসম্ভবা। আমি যারপরনাই খুশি হই। জিজ্ঞেস করে জানলাম, নিজে নিজেই নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি মা হতে যাচ্ছেন। সব ধরনের লক্ষন অনুভব করেন, অথচ ডাক্তার বলেন নেগেটিভ। সে এক মানসিক যন্ত্রণাদায়ক সময় তাঁর ! এমন তো শুনিনি আগে কখনো ! আমি লাইব্রেরিতে যাই। এই টাইপের সমস্যা নিয়ে কোন বই আছে কিনা খুঁজি। অতঃপর জানলাম___ এটি মানবদেহের Endocraine সিস্টেমের গণ্ডগোলের কারন। যাকে বাংলায় বলে “ফলস প্র্যগনেন্সি”। এতে শরীরে বিশেষ ধরনের হরমোন ছড়িয়ে পরে এবং গর্ভবতীর সবধরনের লক্ষন প্রকাশ পায়। ইভেন, পেটের ভেতরে সন্তানের মুভমেন্ট অনুভুত হয়। জটিল একটি প্রক্রিয়া ! ভাবি, এ স্রষ্টার কেমন পরখ ! যে এই সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছে, সে ছাড়া পৃথিবীর আর কারো ক্ষমতা নেই এই কষ্ট অনুভব করার।
কথাগুলো যে কারনে লিখলাম___
রাহার মা আমার বন্ধু। তাদের স্বামী-স্ত্রী’র দ্বন্দ্ব এতটাই চরমে যে, বিচ্ছেদ অনির্বায। নয় বছরের ছোট্ট রাহা’কে ওর মা বললেন, “এরপর তোমার বাবা যদি আমাকে মারে, তুমি লুকিয়ে ৯১১ কল করে দিও।” (আমেরিকাতে ৯১১ নাম্বারে ফোন করলে মুহূর্তে পুলিশ এসে হাজির হয়)
জবাবে ছোট্ট রাহা বলে___ “এরপর বাবা যদি রেগে যান তুমি তোমার রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থেকো। আমি চাই না পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে যাক। আমি তোমার এবং বাবার দু’জনের সাথেই থাকতে চাই। আমি তোমাদের দু’জনকেই ভালোবাসি।”
রাহা’র মা ফোন করে কথাগুলো যখন জানালেন, আমি নির্বাক বসে থাকি। আমার কেবলই মনে হতে থাকে, এটি সম্ভবত সব শিশুদেরই মনের কথা। সবাই হয়তো রাহা’র মত করে গুছিয়ে মনের ভেতরের কথাগুলো প্রকাশ করতে পারেনা। মুলত সবশিশুরাই তাদের বাবা এবং মা দু’জনকেই কাছে পেতে চায় মনেপ্রানে।
## কেউ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে …
কেউ তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় সন্তান পাবার জন্যে হাহাকার করে…
আর, যারা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে ফুটফুটে রাহা’দের নিয়ে, তারা সে স্বর্গীয় সুখের মূল্য বুঝে না…
ভাল থাকুক শিশুরা…
ভাল থাকুক তাদের বাবা-মায়েরা…
ভাল থাকুক আমার সোনেলা’র বন্ধুরা…
১৯টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
আমাদের শিশুরা যেন ভালো থাকে।আপনিও ভালো থাকুন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। শুভকামনা নিরন্তর।
স্বপ্ন নীলা
আপা, যখন পড়ছিলাম তখন কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল — কত নারীযে কষ্টে আছে তা বলে বোঝাতে পারবো না ——- আমার দেখা ও জানা মতে অনেক উচ্চপদে থাকা নারীও মারগুতা খাচ্ছে আর সেইসাথে তাদের উপার্জিত টাকার পুরোটাই তাদের স্বামীর হাতে তুলে দিচ্ছে ———সেইসব পরিবারের শিশুরাযে কতটা অসহায় তা তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি
লেখায় কোটি কোটি +++++++++++++
রিমি রুম্মান
আমাদের আশেপাশের ঘটনাগুলো প্রায় একই। যদিও লেখার ঘটনাগুলো আমার খুব কাছ থেকে দেখা।
জিসান শা ইকরাম
তিনটি ভিন্ন ঘটনা,
মাঝের ঘটনাটি আসলেই ব্যতিক্রমী এবং আরো কষ্টের
সন্তান নেই তারপরেও শ্রষ্টা তার মাঝে এমন অনুভুতি দিলেন।
অন্তর ছুঁয়ে গেলো লেখায়।
আমাদের শিশুরা ভালো থাকুক।
রিমি রুম্মান
সে এক যন্ত্রণাদায়ক সময়। একটা সময় তাঁর এমন কথাবার্তায় আমার বন্ধুরা ভেবে বসলো যে তিনি মানসিক রোগী। মুলত এটি মানব দেহের একটি জটিল প্রক্রিয়া।
সঞ্জয় কুমার
কষ্ট এবং ভালোলাগা একসাথে অনুভব করলাম
রিমি রুম্মান
এটিই জীবন। এটিই বাস্তবতা। ভাল থাকুন সবসময়।
ব্লগার সজীব
এমন লেখায় আমি মন্তব্য করতে পারিনা আপু।সুধু চাই সবাই ভালো থাকুক।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। শুভকামনা নিরন্তর।
কৃন্তনিকা
অনেক কঠিন কঠিন সত্যকে তুলে ধরেছেন…
১) পুত্রকামনা আমাদের একটি সামাজিক সমস্যা। আমরা যতই আধুনিক হই, এই পুত্রসন্তান লাভের চিন্তাধারা থেকে এখনো বের হতে পারি নি, যা খুবই দুঃখজনক।
২)False pregnancy(Pseudopregnancy) আসলে মানসিক সমস্যা। সন্তান কামনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে দেহে হরমোনের পরিবর্তনের ফলে প্রেগন্যান্সির মত শারীরিক পরিবর্তন হয়। এরকম ঘটনা খুবই বিরল। কারণ সন্তান কামনার ইচ্ছার তীব্রতা থেকেই হয়… ভাবতেই কষ্ট লাগে মহিলার মনের অবস্থা প্রকট।
৩)সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখা উচিৎ- এটা ভাবতেও কষ্ট লাগে। কারণ অনেক মেয়েই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
সব দিক দিয়েই কষ্ট আর ভোগান্তির শিকার শেষ পর্যন্ত মেয়েরাই হয়… মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া অভিশাপই হয়ত…
আপনার লেখা আবার ভাবালো আমায়…
রিমি রুম্মান
খুব কাছ থেকে দেখা ঘটনা। প্রথমটি ছোটবেলায় দেখা। দ্বিতীয় আর তৃতীয় ঘটনাটি এই প্রবাসে দেখা। আসলে একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়। ফলস প্রেগনেন্সি’র ঘটনাটি আগে জানা ছিল না। পরে জেনেছি।
খেয়ালী মেয়ে
হৃদয়কে নাড়া দিলো ঘটনাগুলো—
ভাল থাকুক শিশুরা…
ভাল থাকুক তাদের বাবা-মায়েরা…
ভাল থাকুক সবাই…
রিমি রুম্মান
সবার জন্যেই শুভকামনা…
লীলাবতী
কত কিছু নিয়ে আসলেন লেখায়।অনেক কিছুই ভাববার আছে এই লেখায়।আমাদের শিশুরা সহ সবাই ভালো থাকুক।
রিমি রুম্মান
কেন যেন একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে সামনে নিয়ে এলো…
রিমি রুম্মান
পোষ্টটি খুঁজে বের করে পড়বো। আমার এ সম্পর্কে আরো জানার ইচ্ছে। ভাল থাকুক মা হতে চাওয়া সেইসব নারীরা ।
শুন্য শুন্যালয়
Pseudocyesis এর একটা পেশেন্ট নিয়ে অনেকদিন আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তার আরেক প্রহসন এটা। লেখাটা পড়ে মনটা কেমন করে উঠলো আপু। সব শিশুগুলো ভালো থাকুক, প্রার্থনা এটুকুই।
রিমি রুম্মান
খুঁজে নিয়ে লেখাটি পড়বো। আমার এ সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ। ভাল থাকুক সেইসব মা হতে চাওয়া নারীরা।