শিশু অধীকার যা আমারা অনেক সময় জানিনা এবং তা চর্চা করিনা
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হোল । সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢোলে পড়ছে ।
আমিনা বিকেলে খেলার জন্য রেডি হচ্ছিল । একটু পরেই খেলার সাথীরা ডাকতে আসবে। আমিনার আর কিইবা বয়স । ৯/১০ হবে আরকি। এই বয়স টা হোল বাচ্চাদের ছুটো ছুটি করে খেলার বয়স। আমিনাকে খেলতে ভালো লাগে এক্কা দোক্কা,ছি-বুড়ী,দাঁড়িয়া বাধা বা হাডুডু খেলা খেলতে খেলার সাথীদের সাথে।
কিন্তু বাধ সাধল মার নিষেধে। মার কদিন আগেই নুতুন বাচ্চা হয়েছে । পাঁচ নাম্বার এটা। খেলতে গেলে আগের বাচ্চাটিকে কে দেখবে? সেও ত মাত্র দুই বা দেড় বছর হবে।
এই ভাবে আমিনাকে তার বাবা/মার জন্ম দেয়া দশ টি বাচ্চাকে দেখ ভালের দায়িত্ব নিতে গিয়ে ছেলে বেলার খেলা ধুলার অধিকার হারিয়ে ছোটো বেলা থেকে বড়ো মানুষের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আবার বড়ো হয়েও আর্থিক সাহায্য করতে হয়েছে। বাবা/মা সময় এসেছে বিবেক বৃদ্ধি করার।
আমিনার বাবার সরকারী চাকরী হওয়াতে আমিনার পরিবারকে আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে থাকতে হয়। যার ফলে মার বাচ্চা হওয়ার সময় কোন হেল্পার থাকেনা। আমিনা বড়ো হওয়ায় তাকেই দায়িত্ব নিতে হয় মার বছর বছর বাচ্চা হওয়ার সময় গুলোতে ।মা তো বিছানা থেকে উঠতে পারেনা ।বছর বছর বাচ্চা জন্ম দিতে দিতে মার শরীর ভগ্ন প্রায়। আর এত গুলো সন্তান থাকাতে কাজও অনেক।ছোটো ছোটো ভাইবোন গুলোকে খাওয়ানো, নাওয়ানো , কাপড় পরানো এগুলো সেরে আগে খেলতে যেতে পারতো ,এখন তাও সম্ভব নয়।
মার অসুস্থতা , নুতুন বাচ্চার দেখভাল, এসবের দায়িত্ব নিতে নিতে অল্প বয়সী আমিনার কিশোরী বয়সে। খেলার অধিকার প্রত্যেক শিশুর । সে সুযোগ তার আর নেই। সে হয়ে যায় মার নার্স ।
যে বয়েসে একটা মেয়ের খেলাধুলার অধিকার থাকে সে অধিকার কেড়ে নায় বাবা/মার অধিক সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব নিতে নিতে। বাইরে থেকে সাথী রা আসলেও তারাকে ফিরে যেতে হয়।
শুধু কি তাই? এই যে আমিনা এত বড়ো পরিবারের এতো গুলো ছেলে পেলের দায়িত্ব নিলো তাকেই আবার সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় অর্ধেক দায় ।এটাকে বলা হয় ‘এক্সপ্লইটেসান’ অর্থাৎ অবুঝ শিশুকে ব্যাবহার করা।
শুধু তাই নয় অনেক বাবা/মা তার কন্যার বিয়ের সময় পাত্রের কোন কিছু না দেখেই বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব সারার নামে মেয়েদের জীবন নিয়ে ছিনি মিনি খ্যালে।
অনেক পরিবারে মেয়েদের কোন ভয়েস নাই। যেমন ছিলনা আমিনার মার।
বাবা/মার খাম খেয়ালী পুর্ন জীবন, ভেবে চিন্তে ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে গাদা গাদা সন্তান নিলে কি হতে পারে তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করার জন্য কত আমিনার অনেক অধিকার নষ্ট হচ্ছে । সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কে এগিয়ে আসবে।
খেলাধুলাতে বাধা দেয়া শুধু নয় শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অল্প বয়েসে বিয়ে দেয়া, মেয়ে সন্তান কে বোঝা মনে করা বা মেয়ে হলে তারা বংশ রক্ষা কারি নয় শুধু মাত্র পুত্র বংশ রক্ষা কারী ভাবা, পুত্রকে সম্পত্তি মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুণ দেয়া বা একেবারে বঞ্চিত করে । বোনের দরিদ্র ঘরে বিয়ে হলেও সে দিক বিবেচনা না করে শুধু মাত্র ধর্মের দোহায় দিয়ে তাকে কষ্টে রাখতে ভাইদের একটুকুও বাধে না।ভাইরা নির্বিকার সে সময়।
এই গুলো সবিই সন্তানের অধিকার কেড়ে নেয়া বা তাদের উপর অ্যাবুইসিভ ব্যাবহার করার সামিল। যা একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মোটেও করা উচিত নয়।
একটা মেয়ে যে শুধু স্বামী দ্বারা অত্যাচারিত হয় তা নয়। সে অত্যাচারিত হয় সমাজ থেকেও । অত্যাচারিত হয় নিজ পরিবারে।
এই অত্যাচার গুলো হোল ১) অপ্রাপ্ত বয়েসে বিয়ে দেয়া, ২) শিক্ষার অধিকার নষ্ট করা, ৩) পুত্র কে মূল্যবান মনে করা আর মেয়েকে দাম না দেয়া, ৪) ছেলে আর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করা, ৫) সম্পত্তির ভাগ ছেলেকে দ্বিগুণ দেয়া, ৬) ছেলেকে ভালো স্কুলে দেয়া এবং তার জন্য হোস্টেল খরচ আর প্রাইভেট টিচারের ব্যাবস্থা করা কিন্তু মেয়ের জন্য নয় ৭) একটা ছেলে বাবার বাড়িতে আদর যত্ন যেমন বেশি পায় ঠিক তেমন তাদের শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদর দিয়ে মাথায় তুলে রাখা হয়, কিন্তু মেয়ের, বাবার বাড়িতে ছেলের মতো ভ্যালু নাই আর শ্বশুর বাড়ি গেলে খারাপ ব্যাবহারের অন্ত নাই। ৮) সমাজে আর পরিবারে অযত্ন আর অবহেলা, চলার পথ প্রতিকূলতা একটা মেয়ে কে অগ্রসর হতে বাধা প্রদান তো করেই তার সাথে এসবের জন্য মনো কষ্ট তাকে মানসিক ভাবে আহত করে ৯) একটা মেয়ে ডিভোর্স হলে সে হয়ে যায় কুস্ট রোগীর মতো অছ্যুত । তার আর কোনো সন্মান নাই । তার স্বামীর দোষের জন্য বিয়ে টিকা সম্ভব না হলেও দোষ গিয়ে বর্তায় মেয়েটার উপরে।পুরো সমােজ,পরিবারে তাকে নিচু করা দেখা হতে থাকে। ১০) নিজ পরিবারে সেই মেয়েটার আশ্রয় মিলেনা অনেক ক্ষেত্রে। একটা ছেলে বাবার বাড়িতে বিয়ের পরপরেই থাকতে পারে কিন্তু মেয়েটাকে বেড়াতে গেলে অনেক ভাইয়ের এতোই আস্পর্ধা সেটাও চাইনা। অনেক সময় ছেলের সাথে মাও যোগ দায়। ১১) পুত্র দের ধারনা দেয়া হয় পরিবার থেকেই এগুলো তোমাদের কিন্তু মেয়েদের নয়। ১২) একটা মেয়ে শ্যাম বর্ণের হলে বিয়ে হওয়া ত কঠিন হয় আর বিয়ে হলেও সেই রং নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে খোঁটা শুনতে হয়। এটা যে কত বড়ো অমানবিক তা কি ভাবে বোঝানো যাবে মানুষকে।
যুগের পরিবর্তন হলেও আমাদের সচেতনতা কতটুকু বেড়েছে?
প্রবাসী লাইলার কথা আসা যাক। বাবা/মা প্রবাসে আসার ভিসা পেলেও অন্য সব সন্তান কে আনতে পারলেও বয়সের কারনে লাইলা যখন এসে মা/ বাবার সাথে যোগ দিলো তখন স্কুলে যাওয়ার বয়স শেষ।ভোকেশনাল ট্রেনিং আছে কিন্তু সেখানে না দিয়ে টাকা কামাতে লাগিয়ে দায় তাকে।
মা/বাবার তখন বাড়ি ঘর ছিলনা। বাবা লাইলাকে কাজে লাগিয়ে দিলো বাড়ি কেনার ডিপোজিড যোগাড় করতে। লাইলা সারা দিন বাড়ির বেসমেন্টে সেলাই মেশিনে বসে বস্তা বস্তা গারমেন্টের পোশাক সেলায় করে সমস্ত টাকা বাবার হাতে দিয়ে দায়।
বাবার বাড়ি হয় ঠিকিই কিন্তু বাড়ি লিখে দায় বৃদ্ধ কালে ছলেদের কে। যদিও ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী বাবার মৃত্যুর পর ছেলে মেয়ে সমান আংশ পায় কিন্তু বাবা যদি উইল করে দায় কাকে কি দিবে তখন বঞ্চিত করা যায়।
এই হোল পুত্রকে নিজ বংশ মনে করে পিতা মাতার সম্পত্তি বণ্টন। এখানে তাদের কোন বিবেক কাজ করেনা।
প্রবাসে বসবাস কারি নারী নানা ধরনের কষ্ট করে জব করে এবং বিখ্যাত সিরিয়াল ‘জ্যোতি’ নাট কের মতো মা/ বাবা কে টাকা পাঠায় , ‘জ্যোতি ‘ র মতো। নিজেদের সুখ সুবিধা বাদ দিয়ে। আবার এই মেয়ে গুলো দেশে ফিরে গেলে তারাকে নিজ পরিবারেই ওয়েলকাম করেনা। নানা রকম অপবাদ তো আছেই আরও আছে তারাকেই বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা। প্রবাসী হলে দেশের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য মন নরম থাকে মেয়েদের মন এমনিতেই নরম সেই নারী সুলভ কমনীয়তাকে ব্যাবহার করে নিজ পরিবার শোষণ করে। একেই বলে এক্সপ্লয়টেসান । এদের মধ্যে অনেকে আন্ডার এজ মেয়ে থাকে।
Sustainable Development Goals
২০১৫ সালে ১৬০ টি দেশের লিডার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় আনে কি ভাবে বাচ্চা দের অধিকার প্রতিস্টা করা যায় এবং কিকি নীতি নির্ধারণ করলে একটা সমাধান পাওয়া যাবে বা তাদের অধিকার সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা যাবে।
প্রত্যেকটি বাচ্চার অধিকার আছে একটা ভালবাসা এবং নিরাপদ পূর্ণ পরিবার। যেখানে তারা পাবে একটা বাসস্থান,খাদ্য, চিকিৎসা সেবা, বস্ত্র, শিক্ষার অধিকার এবং ইমোশনাল সাপোর্ট।
অনেক বাচ্চা এই অধিকার পায়না যখন দারিদ্র আসে দরজা দিয়ে। বেশির ভাগ দরিদ্র দেশে অনেক পরিবারে বাচ্চা দের বেসিক প্রয়োজন পুরন করতে অক্ষম। সারা পৃথিবীতে প্রতি পাঁচজন বাচ্চার একজন বাচ্চা অতি দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। যার ফলে তারা ম্যালনিউট্রেসান আর অসুখ বিসুখের স্বীকার ।
অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধান একত্রিত হয়ে এই পরিস্থিতিকে রেকগনাইজইং করতে পেরেছে। ২০১৫ সালে ১৬০ টি দেশের লিডার ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দরিদ্রের সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে এসে শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা এবং তাদেরকে তাদের অধিকার রক্ষা করে একটি সুন্দর জীবন দেয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করে।
ক্ষুধা,নিরাপত্তা, ছেলে মেয়ের মধ্যে সমতা বিধান, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা,শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার থেকে রক্ষা করা এবং সবার জন্য শিক্ষার ব্যাবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে পরিগণিত হয়।
বাবা/মাকে সচেতন করা সবচেয়ে আগে দরকার। পরিবার গঠন করার আগে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রস্তুত আছে কিনা ,বাচ্চাদের কি কি অধিকার আছে তা তারা জানে কিনা, তা তাদের অবগত করাতে হবে । তারা যদি এই অধিকার গুলো চর্চা করতে না পারে তা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার ব্যাবস্থা থাকতে হবে। নিজের ইচ্ছা মতো বাবা/মা যা ইচ্ছা তা করতে পারবেনা।
কি ভাবে বাচ্চাদের অবগত করা যায় বা বাচ্চাদের উপর যে অন্যায় করা হচ্ছে তা কি দেখে বোঝা যাবে । কারন অনেক সময় বাচ্চা বলতে পারেনা বা জানেনা কোথায় গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে।
স্কুলের পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে, দেয়াল পোস্টার বা লিফলেটের মাধ্যমে বাচ্চাদের জানাতে হবে ।
বাচ্চার নানা রকম প্রতিক্রিয়া ,শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তন , উৎকণ্ঠা ,ডিপ্রেসান দেখে স্কুল শিক্ষক ঠিক বুঝে নায় তার কি অসুবিধা। পাড়া প্রতিবেশী দের চোখে পড়ে বাচ্চারা নিগৃহীত হচ্ছে কিনা। তাদের মাধ্যমে সহজেই জানা যাবে একজন অবহেলিত বাচ্চার দুরবস্থা।
বাচ্চার অধিকারঃ UNDP, United Nations Convention এর মাধ্যমে যে আইন করে দেয়া হয়েছেঃ
প্রত্যেক দেশে এগুলো মানার জন্য আইন করে দেয়া হয়েছে। দরকার আইনগত ব্যাবস্থা নেয়া ।প্রয়োজন প্রচুর প্রচার এবং বাবা/মার সচেতনতা এবং শিক্ষা বৃদ্ধি।
অনেক দেশে মেয়ে শিশু রেপের স্বীকার হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে বানোয়াট আর মনগড়া কথা বলে মানসিক অত্যাচার করা হয়। অনেক বাবা/ মা ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে দায় যা অন্যায় এবং আইন বিরুদ্ধ । জোর পূর্বক বিয়ে দেয়া বন্ধ করতে হবে এবং এটা যে আইন বিরুদ্ধ তা অভিবাবক কে বোঝাতে হবে।
ছোটো বাচ্চা এবং কিশোর কিশোরী দের উপর অত্যাচার রোধ এবং তাদের মধ্যে ডিসক্রিমিনেসান বন্ধের জন্য যা করতে হবেঃ
লেখক ও গবেষকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস , নারী ও শিশু উন্নয়ন কর্মী ,লন্ডন
৩টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
সুবিদা বঞ্চিত শিশুরা আলোর পথে হাটুক।লেখা ভাল লাগল।
নার্গিস রশিদ
অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা ।
হালিমা আক্তার
চমৎকার বিশ্লেষণ মূলক লেখা। অনেক পরিবার আছে শুধু মেয়ে নয় ছেলের উপর সংসারের বোঝা চাপিয়ে দেন। এটা বাবা মায়ের অসচেতনতা। ভুক্তভোগী সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব ভুলে যান। ওই সন্তান বাবা মা ভাই বোনদের মায়ার আঁচলে বাঁধা পড়ে। সে ভাবে এটা তার দায়িত্ব। নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য শেষ করে এক সময় সে হয়ে যায় উচ্ছিষ্ট। আর মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক সম্পত্তি পায়। এটা ইসলাম ধর্মীয় বিধান। শুভ কামনা রইলো।