১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জ আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। এগজিবিশন হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা একসাথে গোপালগঞ্জ আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হল। স্কুলের ছাত্র আমরা তখন। আগেই বলেছি আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরুপ সম্বর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। এগজিবিশনে যাতে দোকানপাট না বসে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা আশিটি দোকান হিন্দুদের ছিল। আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান-সবই চলত।
আমাদের নেতারা বললেন, হক সাহেব মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এতে আমার মনে বেশ একটা রেখাপাত করল। হক সাহেব ও শহীদ সাহেবকে সম্বর্ধনা দেয়া হবে। তার জন্য যা কিছু প্রয়োজন আমাদের করত হবে। আমি মুসলমান ছেলেদের নিয়েই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম, তবে কিছু সংখ্যক নমশুদ্র শ্রেনীর হিন্দু যোগদান করল। কারণ, মুকুন্দবিহারী মল্লিক তখন মন্ত্রী ছিলেন এবং তিনিও হক সাহেবের সাথে আসবেন। শহরে হিন্দুরা সংখ্যায় খুবই বেশি, গ্রাম থেকে যথেষ্ট লোক এল, বিশেষ করে নানা রকম অস্ত্র নিয়ে, যদি কেউ বাধা দেয়! যা কিছু হয়, হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হতে পারত।
হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হল। এগজিবিশন উদ্বোধন করলেন। শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল। হক সাহেব পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। আমি মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাঁকে সম্বর্ধনা দিলাম। তিনি স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথেসাথে চললাম। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নাম এবং বাড়ি কোথায়। একজন সরকারী কর্মচারী আমার বংশের কথা বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, “তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই?” বললাম, “কোন প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই।” তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-১০ ও ১১)
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (পর্ব-০৬)
১১টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
ধর্মীয় বিভক্তি সত্বেও বঙ্গবন্ধু তার সাংগঠনিক শক্তিমত্তা সবকিছু সমাপ্ত করেছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব চিঠি দিতেন! বর্তমান অবস্থায় এমন চিঠি আদান প্রদান কল্পনা মাত্র। আপনাকে ধন্যবাদ আপু, নিয়মিত পোষ্ট দিচ্ছেন -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য।
নীলাঞ্জনা নীলা
দুঃখ আমার প্রতিটি পোষ্ট পড়া হলোনা। তবে আস্তে আস্তে পড়ছি আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
দুঃখ করবেন না, সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন, এবার সময় করে পড়ে নিতে পারবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
হুম আশা করি ২/১ মাসের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবো।
তানজির খান
অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু এভাবেই গড়ে উঠেছেন। শুভকামনা রইল
মারজানা ফেরদৌস রুবা
তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, তাই সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে ছুঁতে পারেনি।
জিসান শা ইকরাম
ধর্মীয় বিভক্তি আমাদের এই উপমহাদেশকে শেষ করে দিল।
শহীদ সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর প্রথম যোগাযোগের ইতিহাসটি জানলাম,
এই যোগাযোগই জাতির জনকের রাজনীতির বীজ বপন বলা যায়।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বৃটিশরা এই ভূখণ্ডে এসে প্রথমেই যে কাজটি করেছে তাহলো, এই উপমহাদেশের মানুষগুলোর মধ্যে ধর্মীয় বিভেদের বীজ বপন করা এবং সেটি তারা করতে পেরেছিলো বলেই দু’শ বছর রাজত্ব করতে পেরেছে। তারপর সব চুষে নিয়ে আবারও চিরকালের ধর্মীয় বিভেদ টিকিয়ে রাখার জন্য রেডক্লিফ লাইন এঁকে ভারতবর্ষকে ভাগ করে যায়, যার খেসারত আজও এই উপমহাদেশ দিয়ে যাচ্ছে।
যুগেযুগে এই বিভেদ দূর করতে যারাই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে আসেন, সাম্প্রদায়িকতার সেই কুৎসিত থাবা তাঁদের কাউকেই বাঁচতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকেও সে পরিণতিই বরণ করতে হয়েছিলো।
অনিকেত নন্দিনী
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বঙ্গবন্ধুর প্রথম পরিচয়ের আবহ জানলাম। চিঠির লেনদেনও হতো জেনে অবাক হলাম। আজকালের দিনে সবাই এত ব্যস্ত! এত সময় কই?
ধন্যবাদ আপু। আপনার কারণে অনেক কিছুই জানতে পারছি।
শুন্য শুন্যালয়
ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবেই সবাই ব্যবহার করে গেলো। একদম শুরু থেকে সব জানতে পারছি আপু। অনেক ধন্যবাদ।