চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরুপ ধারনা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এসডিও, আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁসিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পরে শুনেছি।
১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরানো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠিরা আমাকে পিছনে ফেলে গেছে। আমার আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার আব্বাও আবার গোপালগঞ্জ ফিরে এলেন। এই সময় আব্বা কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে আমাকে পড়াবার জন্য বাসায় রাখলেন। তাঁর জন্য একটা আলাদা ঘরও করে দিলেন। গোপালগঞ্জের বাড়িটা আমার আব্বাই করেছিলেন। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হত তাঁর সাথে। হঠাৎ যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক। যদি কোন মুসলমান চাউল না দিত আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হত। এজন্য আমার আব্বার কাছে অনেক সময় শাস্তি পেতে হত। আমার আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না।
আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল, হকি খেলতাম। খুব ভাল খেলোয়ার ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভাল অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।
আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম। স্কুলে ছেলেদের মধ্যে আমার বয়স একটু বেশি হয়েছে, কারণ প্রায় চার বৎসর আমি লেখাপড়া করতে পারি নাই। আমি ভীষণ একগুঁয়ে ছিলাম। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমার আব্বা মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। কারণ ছোট শহর, নালিশ হত; আমার আব্বাকে আমি খুব ভয় করতাম। আর একজন ভদ্রলোককে ভয় করতাম, তিনি আবদুল হাকিম মিয়া। তিনি আমার আব্বার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে চাকরি করতেন, আমাকে কোথাও দেখলেই আব্বাকে বলে দিতেন, অথবা নিজেই ধমকিয়ে দিতেন। যদিও আব্বাকে ফাঁকি দিতে পারতাম, তাঁকে ফাঁকি দিতে পারতাম না। আব্বা থাকতেন শহরের একদিকে, আর তিনি থাকতেন অন্যদিকে। হাকিম সাহেব বেঁচে নাই, তাঁর ছেলেরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে। একজন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বড় চাকরি করেন, আর একজন সিএসপি হয়েছে। তখন গোপালগঞ্জে এমএলএ ছিলেন খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ সাহেব। তিনি নামকরা উকিলও ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে খন্দকার মাহবুব উদ্দিন ওরফে ফিরোজ আমার বন্ধু ছিল। দুইজনের মধ্যে ভীষণ ভাব ছিল। ফিরোজ এখন হাইকোর্টের এডভোকেট। দুই বন্ধুর মধ্যে এত মিল ছিল, কেউ কাউকে না দেখলে ভাল লাগত না। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। অমায়িক ব্যবহার তাঁর। জনসাধারন তাঁকে শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। তিনি মরহুম শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য ছিলেন। যখন হক সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং মুসলিম লীগে যোগদান করলেন, খন্দকার সাহেবও তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেন। যদিও কোনো দলেরই কোনো সংগঠন ছিল না। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার উপরই সবাই নির্ভর করত। মুসলিম লীগ তো তখন শুধু কাগজে-পত্রে ছিল।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-০৯ ও ১০)
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (পর্ব-০৫)
১৩টি মন্তব্য
অনিকেত নন্দিনী
কেউ মুষ্ঠির চাল না দিলে রাতে তার বাড়িতে ইট মারার ব্যাপারটায় বেশ মজা পেয়েছি। 😀
লিখতে থাকুন আপু। আমরা সবাই সাথেই আছি। 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আহা আপু, অনেক ধন্যবাদ। সবাই ভাববে আমি বোধহয় মারাত্মক রকমের একতরফা কর্ম করে যাচ্ছি। পোস্ট দিচ্ছি আর মন্তব্যের জবাব দিয়েই সাড়া। সহব্লগারদের কোন পোস্টেই তেমনভাবে যাচ্ছি না, যা অনুচিত। কিন্তু কি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, গতকাল তা জিসান ভাইর সাথে শেয়ার করলাম। বর্তমানে এতোই নাজুক মায়ের শরীর, সোয়া অবস্থায় সিরিঞ্জ দিয়ে অল্প অল্প করে খাবার মুখে দিচ্ছি।
শুধুমাত্র বাধ্যতামূলক শনিবারের পোস্ট বলে এ লিখাটা কন্টিনিউ করে যাচ্ছি। একসাথে অনেক টাইপ করে রেখেছিলাম এবং এখনও সুযোগ পেলে টাইপ এগিয়ে রাখি। কারণ, কখন কোন পরিস্থিতিতে না আবার পড়ে যাই।
অনেক ধন্যবাদ।
অনিকেত নন্দিনী
এতো ব্যস্ততার মাঝেও নিয়ম করে লেখা দিয়ে যাচ্ছেন এইই ঢের। 🙂
জিসান শা ইকরাম
” চাউল না দিত আমার দলবল নিয়ে তার উপর জোর করতাম। দরকার হলে তার বাড়িতে রাতে ইট মারা হত।” হা হা হা , এমন যে কত আমরা করেছি ছোট বেলায়। চরম আনন্দ পেতাম এই ইষ্টক নিক্ষেপে 🙂
বঙ্গবন্ধুর ছোট বেলা আমাদের মতই সহজ ও সাধারণ ছিল।
আপনাকে ধন্যবাদ এমন পোষ্ট ধারাবাহিক ভাবে দেয়ার জন্য।
আপনার মা এর দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।
শুভ কামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ।
ছোট ছোট পর্ব আকারে পড়তে দেয়াতে মনে হচ্ছে উপলব্ধিতে প্রতিটা পর্বই দাগ কেটে যাচ্ছে! (y)
ব্লগার সজীব
বঙ্গবন্ধু তো দেখছি খুবই দুষ্ট ছিলেন 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ভীষণ। অকপটে সব লিখে যাওয়ায় পড়তে আরো ভাল লাগছে।
স্বপ্ন
ছোট মফস্বল শহরের অন্য সাধারণ ছেলেদের মতই সাধারণ জীবন ছিল জাতির পিতার। আপনাকে ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সাধারণভাবে এভাবে প্রকাশটাও সাহস এবং যোগ্যতার ব্যাপার। এখানেই তিনি অনন্য। (y)
শুন্য শুন্যালয়
সব নিউজপেপার পড়া, পার্টির অফিসে বসে থাকা, রাজিনীতির খেয়াল না থাকলেও তার যে পর্যবেক্ষন ক্ষমতা অনেক তীক্ষ্ম ছিল, তা বোঝা যায়। একটু একটু করে সাধারন থেকে অসাধারন হয়ে ওঠার গল্প জানতে পারছি। জাতীর পিতা কে পড়া নয়, ধারন করাটাই আসল।
আপনার মা’র জন্য অনেক প্রার্থনা আপু। ইনশাল্লাহ ভালো হয়ে উঠবেন তিনি। আপনি ভাল থাকুন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
জাতির পিতাকে পড়া নয়, ধারন করাটাই আসল। (y)
মিথুন
ট্যালেন্টেড মানুষরা একটু ডানপিটে হয়, বঙ্গবন্ধুও ছিলেন সেরকম। এভাবে ছোট ছোট করে দেয়ায় তাকে কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারছি, পরিবারের একজনের মত…………
মারজানা ফেরদৌস রুবা
গুড! আমার এই আইডিয়াটা মাথায় এসেছে পড়তে গিয়ে দেখা যেতো আমি কিছু অংশ দুই বারেরও অধিক পড়েছি। তখন মনে হলো কেবল পড়া নয়, ধারন করতে পারলেই যেনো তাঁকে সঠিক জানা হবে।
আর অল্প করে দিলে, যার আগ্রহ বেশি সে খুঁজে পড়ে নেবে।
ধন্যবাদ আপনাকে।