অর্ধ খোলা জানালার পথ জেনে আসা রৌদ্রজ্বল আলো প্রদীপের গায়ে মেখে ঘুম ভাঙিয়ে দিল।নীলয় ছাড়াও আরো দু’জন তখনো তার কক্ষে এলেমেলো অবস্থায় শুয়ে রয়েছিল।সুনীল ততক্ষণে তার বাসায় চলে গেছে বলেই তার অনুমান হল।এমন অনভ্যস্ত জীবনাচরণে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।তবে এতটুকু শুধু বুঝতে পারল যে এমন খামখেয়ালি,ঢং,পাগলামির সঙ্গে সঙ্গী হয়েই বাকি অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।সকালের নাস্তা করার জন্য বাহিরে বের হচ্ছিল প্রদীপ,তখনি নূর তাকে আছমকা দেখে তাকে তার কক্ষে নিয়ে গেল।নূর প্রদীপকে না জানিয়েই ডিম ভাজি,সবজি-ডাল,গরম রুটি সমেত নাস্তার পার্সেল এক ছোট ভাইকে দিয়ে আনিয়ে নিল।নূর প্রথম আলো পত্রিকাটাও ভাজ করে বাড়িয়ে দিল প্রদীপের দিকে।নূর প্রদীপকে বলল যে তার কক্ষ সবসময়ই প্রদীপকে স্বাগত জানাতে উদগ্রীব থাকবে।প্রদীপ বুঝতে পারল না তাকে সবার এত আপন করে নেয়ার রহস্য! এভাবে নূর প্রতিদিনই সকালের নাস্তা প্রদীপকে নিয়েই করতে চাইত যদিও প্রদীপের আপত্তিতে সেটা সবসময় হয়ে উঠত না।তবে সকালের তরতাজা সমাচার পত্রিকার আয়নায় চোখ বুলিয়ে নেয়ার জন্য নূর প্রদীপকে ডেকে নিয়ে যেত প্রতিদিন।এ বিষয়টা যখন সুনীল,নীলয় জানতে পারল,তারা ততটা ভালভাবে নিতে পারছিল না।নূরও একটি ইসলামি ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত।যদিও নূরের প্রদীপকে তার ট্রাম্পকার্ড বানানোর তিল পরিমান ইচ্ছেও ছিল না,তথাপি অন্যরা অনেক সময় ভুল বুঝত নূরকে।মোটাদাগে বলা যায় যে নূর চাইত তার পাঠ্য বইয়ের দূর্ভেদ্য,গুরুগম্ভীর বিষয়াদি প্রদীপের সাহচর্যে যেন সহজে ব্যবস্থা করে নিতে পারে।প্রদীপের কঠোর পরিশ্রমলব্ধ অর্জিত জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার একটা বাসনা ছিল তার মধ্যে। পক্ষান্তরে, সুনীল চাইত প্রদীপ তার ছাত্র সংগঠনে একজন সামনের সারির ছাত্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হোক।তার মধ্য দিয়ে কলেজের আরো শত শত মেধাবী,উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন ছাত্ররা বামপন্থী এই রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনকে ভালবেসে নিজেদের আত্মনিয়োগ করুক।কিন্ত সুনীল প্রদীপকে প্রত্যাশা মাফিক কাজে লাগাতে পারছিল না।তবুও সে হাল ছাড়ল না।অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হল কিছুদিনের মধ্যেই।ফলাফলে প্রত্যাশিত অবস্থান প্রদীপ ধরে রাখতে সক্ষম হল।সে তার বিভাগে প্রথম বর্ষ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল।সবার বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস গড়ে উঠল তাকে নিয়ে।প্রদীপ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত তার অর্জিত সাফল্যের পথ বেয়েই সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।যদিও তার কক্ষে পড়াশোনার সুশ্রী পরিবেশ আর নেই বললেই চলে,তবুও এমন পরিবেশ ছেড়ে চলে যাবার ব্যাপারে যেন সে ছিল অনেকটাই উদাসীন।সুনীলের প্রতি একটা দূর্বলতা পরোক্ষভাবে কাজ করতে লাগল।পরিমল নামের তার এক সহপাঠীকে এমনি করে ছাত্র সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করল সুনীল।পরিমল তার বাসা থেকেই সি.এন.জি করে ক্লাস ধরতে কলেজে আসত।তাই ওই শহরে থাকার প্রয়োজন গড়ে উঠেনি।পরিমল ছিল অনেকটাই ভাবুক স্বভাবের।তার ভাবনার বাহারি প্রজাপতি উড়তে থাকত নানান রঙে,ঢঙে।তন্মধ্যে প্রদীপ,সুনীল,পরিমলের মধ্যে এক নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।একজন আরেকজনকে না দেখলে যেন দিনটাই বৃথা হয়ে যেত।প্রদীপ,পরিমল সুনীলকে মনের খোরাক জোগাতে,মনের ডাকেই দেখতে চাইত।তবে সুনীল সর্বাবস্থায় তাদের তার ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তবেই দেখা দিত।মাস খানিক পর সুনীল তার ছাত্র সংগঠনের অভিভাবক দল তথা কেন্দ্রীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও জেলা সমাজতান্ত্রিক দলের পরামর্শক্রমে কাউন্সিলের ডাক দিল।মোটামুটি অনাড়ম্বর পরিবেশে কোন এক মেঘলা দিনে এই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হল।পরিমল ও প্রদীপকে সংঘটনের দ্বায়িত্ব অর্পণ করা হল।পরিমলকে সভাপতি ও প্রদীপের অনিচ্ছা স্বত্তেও প্রদীপকে সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বায়িত্ব দেয়া হল।সুনীল যেন সেদিন হাফ ছেড়ে বাচল।সেই দিনের অপেক্ষাতেই যেন ছিল যেদিন নিশ্চিন্তে তার বন্ধুদের দ্বায়িত্ব দিয়ে আরো উপরে উঠার পথ তার প্রশস্থ করতে পারবে।সুনীলের সকল চৌকস কর্মকাণ্ড প্রদীপ আর পরিমলের দেখতে ভালো লাগলেও সেখানে শরিক হতে ততটা ভালো লাগত না।তবে যেহেতু মুক্তোর মালা দুজনের গলায় পড়ানো হয়ে গেছে,সেহেতু আন্তরিকভাবে সময় দেয়াটা দ্বায়িত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে বলেই সুনীল দুই উদীয়মান নেতাকে চা-চক্রে সহাস্যে মনে করিয়ে দিত।প্রদীপ,পরিমল পড়ল মিষ্টি মধুর যন্ত্রনায়! একদিকে রাজনৈতিক কাজে খুব একটা গা লাগানোর ইচ্ছে কখনোই ছিল না,অপরদিকে নতুন দ্বায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটা উৎসাহ,উদ্দীপনাও কাজ করছিল।তাই বিভিন্ন দিন প্রদীপ,পরিমল নিজে থেকেই সুনীলের কাছ থেকে দলের ইতিহাস,মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা,আদর্শ,লক্ষ্য ইত্যাদি জানার আগ্রহ প্রকাশ করত।আর সুনীল চালকের আসনে থেকেই সুন্দর করে স্বচ্ছতার সাথে সবকিছু বুঝিয়ে দিত।এমন একটা সময় আসল তাদের তিন বন্ধুত্বকে ঘিরে মানুষ নানান ধরনের কথাবার্তা বলত।প্রদীপ,পরিমল যে ফুটপাত দিয়ে হেটে বেড়াত একসময় দুই-একটি বই চেপে মুষ্টিতে,সেই ফুটপাতেরই সাথে সমান্তরালে বয়ে চলা রাস্তায় নেমে বিভিন্ন দাবীতে শ্লোগান দিতে শুরু করল তখন থেকে।

৬৩১জন ৫২৫জন

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ