পৃথিবীর পথে পথেঃ সানলিউর্ফা ,তুরস্ক ,সময় ২০২৪
“Turkey is a European country, an Asian country , a middle Eastern country. a Caucasian country, a neighbour to Africa,Black sea country, Caspian Sea all these” .Kamal Ataturk.
আমাদের চারজনের বেড়ানোর টিম এবার বেরিয়ে পড়লাম তুরস্কের দক্ষিণ পুর্বের দেশ সানলিউর্ফার উদ্দেশ্যে । চারজন মানে আমরা দুইজন এবং আমাদের দুই মেয়ে । বেশির ভাগ জায়গাতেই আমরা চারজন একসঙ্গে যায়। লন্ডনের হিথরো থেকে তিন ঘণ্টার পথ ইস্তাম্বুল আর ইস্তাম্বুল থেকে একটা ছোটো প্লেনে একঘণ্টার পথ সানলিউর্ফা । হোটেল বুক করা ছিল আগেই। সকালে উঠে ব্রেকফাস্টের পরেই ট্যাক্সি যোগে গবেকলি টেপে দেখার পথে রওনা দিলাম।
সানলিউর্ফা বা সংক্ষেপে উর্ফা ( তুরস্ক ) প্রাচীন নাম এদেসা ( EDESA)
সানলিউর্ফা তুরস্কের দক্ষিণ পূর্বের একটা প্রদেশ ।
ইতিহাস নুতুন করে লেখতে হবে।(ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ২০১৮ )
ইতিহাস বদলে দেয়া একটি নাম সানলিউর্ফার “গবেকলি টেপে” । এতদিন ধরে মানুষ জানতো সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা মেসপটিয়ামা বা মিসরের পিরামিড । কিন্তু মানুষের ধারনা পরিবর্তন করে দিয়ে সাম্প্রতিককালে বেরিয়ে এসেছে আর এক সভ্যতা আর সেটা হল ‘গবেক্লিটেপে’। তাও আবার এক হাজার দুই হাজার বছরের পুরানো নয়। সাড়ে বারো হাজার বছরের পুরানো এই সভ্যতা।
সানলিউর্ফা যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্যই গবেকলি টেপে দেখা। বরফ যুগ শেষ হয় দশ হাজার বছর আগে। মানুষ তখন ছিল হান্টার গেদারার । তুর মাউন্টেন থেকে বের হওয়া দুই নদী ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রেটিস নদী বের হয়ে চলে গেছে ইরাকের মধ্যে। এই দুই নদীর মাঝখানের বিরাট উর্বর সমতল ভূমিকে বলা হয় মেসপটিয়ামা । আর এই স্থানে মেসপটিয়ামা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । কিন্তু গবেক্লিটেপে তারও ছয় হাজার বছর আগের ।
মানুষ যখন থিতু হয় হান্টার গ্যাদারার থেকে আরম্ভ করে কৃষিকাজ । ছোট ছোট বসতি গোড়ে তুলে। কেউ জানেনা কখন ধর্ম আরম্ভ হয় । গব্লেকেটেপে বসতি নয় ,জার্মান আরকেওলজিসস্ট এখনে বসবাসের কোন তৈজস পত্র খুঁজে পাননি। বৃত্তাকার অনেক স্থান খুঁজে পান চার দিকে ছয় ফুটের ইংরেজির T অক্ষরের মত অনেক পাথর কাটা পিলার পান। তাতে ছবি আঁকা নানান জীবজন্তু,পোকামাকড় আর সাপের। পিলার গুলো মানুষের লম্বা বাহু দিয়ে পেঁচানো। শেয়াল ,চিতা ,বুনো শূকর প্রত্যেকের আক্রমণ করতে যাওয়ার মত মুখের এক্সপ্রেসান । অর্থাৎ সবগুলো দাঁত বের করা।
এ পর্যন্ত যতটুকু বের হয়েছে তা পুরো এলাকার মাত্র ৫%। এখনো কাজ চলমান। আরকেওলজিস্ট দের ধারনা পুরো পাহারটি এই একইরকম মাল্টি বৃত্তাকার আকারের শত শত ঘর দিয়ে তৈরি ।
তবে সবই অনুমান। বিশেষজ্ঞ গন মনে করছেন এটা তাদের ধর্মশালা । কোন এক বিশেষ বিশ্বাসের অনুসারী ছিল এরা। কৃষি আগে না ধর্ম আগে, মনে হয় কৃষিকাজে উন্নতির জন্য বা ভালো ফসল পাওয়ার জন্য তারা তাদের কল্পনা দিয়ে একটা ধর্ম সৃষ্টি করে । ধর্ম সম্বন্ধে ধারনা প্রথম এখান থেকেই আরম্ভ হয় ম্যানকাইন্ড বা মানব জাতির। এখানে এসে তারা একত্র হয়ে হয়ত নেচে গেয়ে আরধনা করে যেতো ।
কারন আরকেওলজিস্ট আরও কিছু প্রাচীন বসতি পায় এই বিরাট এলাকায় যেমন ক্যারাহেন টেপে,যেখানে বসতি আছে চারদিকে কিন্তু আয়তকার আর মাঝে একটা করে এই T আকৃতির কয়েকটি পিলার সম্বলিত গোল আকারের গবেকলি টেপের মত আবাস। সেও পিলার গুলোতেও সেই বন্য প্রাণী কেটে কেটে আঁকা রয়েছে।
Pleistocen Era ( বরফ যুগ ) শেষ হয় ১২,০০০ বছর আগে । তারপর আরম্ভ হয় Neolithic Era অর্থাৎ যে যুগে মানুষ পটারী ব্যাবহার শুরু করে। পাথর খোদায় করা কিছু কিছু পাত্র এবং পাথর দিয়ে তৈরি অস্ত্র পাওয়া যায় এখানে । এরাই প্রথম মানুষ যারা ছিল Monoliths অর্থাৎ নিজের চিন্তার প্রতিফলন ঘটায় পাথরের উপরে খাঁজ কেটে কেটে।
বহু কেভে প্রাচীন চিত্র পাওয়া গেছে কিন্তু তা রং দিয়ে আঁকা । আর এখানে এরাই পৃথিবীর প্রথম মানুষ যারা পাথরের উপরে কেটে কেটে ছবি এঁকেছিল ।
কিভাবে খোঁজ পাওয়া গেলোঃ
সাফাক ইলদিজ (Safak Yildiz) নামক একজন কৃষক এখানে চাষ করার সময় দেখতে পান একটা অদ্ভুত আকারের পাথরের মাথা বেরিয়ে আছে মাটি থেকে উপরে। তিনি কিছুটা খুঁড়ে উঠাতে চেষ্টা করেন কিন্তু দেখা যায় এর গভীরতা অনেক। তিনি বুঝতে পারেন এটা একটা কিছু যা জানানো দরকার মিউজিয়াম কতৃপক্ষকে ।
সেখানে জানালে তারা আবার জার্মান আরকেওলক্যাল ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করেন তাদের কতৃপক্ষ আরকেওলজিস্ট Klaus Schmidt কে পাঠান । তিনি সাফাক ইলদিজ কে নিয়ে এখানে আসেন এবং খনন কার্জ চালান ১৯৯৭ সালে।
তাঁর সাথে টার্কিশ আরকেওলজিস্ট Bahattin Celik এবং Prof Necmi Karul ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি এক সঙ্গে কাজ করেন এবং যা তিনি পান তা মাইন্ড ব্লোইং, ক্রমাগত ভাবে বেরিয়ে আসে প্রায় ৩০০ টি “T” আকৃতির পিলার যা বৃত্তাকার একটা করে ঘরের মত আকারের চারদিকে ছিল। যাতে পাথর কেটে আঁকা আছে শেয়াল ,বন্য শূকর, চিতা বাঘ, মানুষে হাত ,কোথাও কোথাও মানুষের মাথার মত আকৃতির বস্তু। প্রত্যেক গোলাকার বৃত্তে ২০ টন ওজনের ম্যাসিভ স্ত্রাকচার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে আছে । সেখানে তিনি মানুষ বসবাসের চিহ্ন খুঁজে পাননি।যাকে বলা হয় “ডোমেস্টিক রিফিউজ” তা সেখানে ছিলনা ।কোনো ফসলের ফসিল ছিলনা ছিল জন্তুর হাড় হাড্ডি । মানুষের কোনো কংকাল ছিলনা।তার মানে এগুলো কোনো কবর নয়। তাঁর অনুমান পুরো উঁচু জায়গাটি একটা মন্দির এবং মানুষ এখানে এসে আরধনা করতো।
রেডিও কার্বন ডেটে ধরা পড়লো এর বয়স ১২০০০ হাজারের পুরানো ।
পাঁচটি বড় ধরনের পরিবর্তনের সমাহার এখান থেকেই আরম্ভ হয়।
১) পার্মানেন্ট স্যাটেলমেন্ট
২) সভ্যতার সকাল
৩) ন্যাচার বা প্রকৃতি কে কন্ট্রোল
৪) ‘স্প্রিট’ পূজা করা থেকে সরে এসে গড কে আরধনা করার আরম্ভ
৫) মানুষের জীবন একটা কন্ট্রোলের মধ্যে আসা
জার্মান আরকেওলজিসস্ট Klaus Schmidt এর মৃত্যুর পর বর্তমানে টার্কিশ এবং জার্মান আরকেওলজিসস্ট এক্সপেরিমেন্ট এবং খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখানে টুরিস্ট দের যাওয়া আসার জন্য গাড়ির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। অ্যানিমেশন এবং মিউজিয়াম করা হয়েছে যা দিয়ে সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে পুরো ব্যাপার টা কি। করেছে ন্যাসান্যাল জিওগ্রাফিক ।
ফেরার পথে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আর তা হল আমাদের পুর্ব পুরুষের দীর্ঘ যাত্রা কাল।
দ্বিতীয় দিনঃ
আদিয়ামান, নেমরুত মাউন্টেনে অ্যান্টিকুয়াস ১ কমাজেন্স ( Antichous 1 Cmmagene ) গ্রিসিও ইরানীয়ান কিংডম অফ কমাজেন্স এর বিরাট পিরামিড আকৃতির টুম্ব বা কবর।
ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট (১৯৮৭)
পরের দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম এই হেরিটেজ সাইট দেখার জন্য, তুরস্কের ‘তুর’ মাউন্টেনের এটি একটা ব্রাঞ্চ । দীর্ঘ তিনঘণ্টার পথ । দুর থেকে তুর মাউন্টেনের সাদা বরফে ঢাকা দীর্ঘ সারি ক্রমান্বয়ে কাছে আসা আরম্ভ হয়। আমরা আসতে আসতে উঠতে লাগলাম উপরে । বিরাটকায় অদ্ভুত আকারের গাছপালা হীন রকি পর্বত। সুংসাং নীরাবতা। কোনো সাড়াশব্দ নাই নাই জীবনের চিহ্ন । শুধু উপরে উঠা আর উঠা। যদিও ট্যাক্সি যোগেই গমন রাস্তাও ভালো ।কিন্তু উপরে শীতকাল বলে বরফ এবং ঘন মেঘ বা কুয়াশা। দুই হাজার ফিট উপরে উঠার পর কার একজাগায় থামে এরপর পায়ে হেঁটে আধা ঘণ্টা আরও উপরে উঠা।
এতো নির্জনতা আর সুউচ্চ স্থান বেছে নিয়েছিলেন রাজা, কারন তার ভাবনা ছিল লোকালয় থেকে দূরে কবর থাকায় ভালো এবং এখানে কিভাবে এতো ভারী ভারী পাথর তুলে আনা হয়েছিল তা সত্যই এক বিস্ময়। তাও আবার তখন কোনো ক্রেন বা টেকনোলজিও ছিলনা। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ মূর্তি সবি বসা অবস্থায় । মাথা গুলো ভূমিকম্পে ভেঙ্গে গেছে আর চারপাশে পড়ে আছে। মধ্যে খানে রাজা চারপাশে পার্সিয়ান এবং গ্রীক দেবতা । তারা হল Heracles, Zeus, Apollo,দুটো করে সিংহ এবং দুটো বিরাটকায় ঈগল । তাদের কাজ পাহারা দেয়া।
কে এই Antichous 1 Commagene
বীর আলেকজান্ডার (৩৩০ BC) মেসডোনিয়া থেকে তুরস্ক তারপরে একে একে মিশর, পারস্য হয়ে আফগানিস্তান দখল করে ভারত বর্ষের সীমানায় আসে।
তার মৃত্যুর আগে তিনি তার এই বিরাট রাজত্ব তার সেনাবাহীনির প্রধান দের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যান। তাঁরা হলেন ১) সেলুকাশ ২) টলেমী (Ptolemy) মিশর ৩) Antigonus1 মেসাডনিয়া ৪) Lysimachus Thrace ৫) Antipater
Antichous 1, হাফ পার্সিয়ান হাফ গ্রীক ছিলেন । আলেকজান্ডার এবং তার সেনা প্রধানরা পারস্য রাজার মেয়েদের বিয়ে করেছিলে। এই আমলটিকে বলা হয় Greco Iranian kingdom of commagene 86BC- 31BC। তিনি ছিলেন এই আমলের শেষ রাজা। তার পরেই ক্ষমতা চলে যায় রোমান দের হাতে।
তার হেড গিয়ার এবং পরনের কাপড় ছিল পার্সিয়ানদের মত । এবং দেবদেবী পারসিয়ান এবং গ্রীক দেবি দের সাথে মেশানো । কারন তার মা ছিল গ্রীক প্রিন্সেস laodiee ৫ এবং তিনি seleucid ইম্পরার আমলের। সেইদিক দিয়ে তিনি সেলুকাস বংশের ।
জার্মান আরকেওলজিস্ট এখানে খনন কাজ চালান এবং দেখতে পান একটা স্তেলা যেখানে রাজা দেবতাদের সাথে হাত মেলাচ্ছে ।তিনি নিজেকে দেবতার সাথেই তুলনা করতেন এবং নিজেকে শক্তিশালী বিশ্বব্রম্ভান্ডের দেবতা বলে মনে করতেন। এতো বড় সুউচ্চ স্ট্যাচু আর কোথাও দেখা যায়না তার পেছনের পিরামিড আকৃতির পাহাড়টি তার টুম্ব ।
নিচে নামতে নামতে চলে আসলাম সমতলে। আদিয়ামানে রিসেন্ট ২০২৩ ভূমিকম্পে যে বিরাট ক্ষয় ক্ষতী হয় তার চিহ্ন পড়ে আছে চার দিকে। এখনো অনেক বিল্ডিং ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে আছে।
মনে মনে ভাবতে থাকলাম এই যে এই ক্ষমতাধর রাজা এবং তাদের ডাইনেস্টি আর সাম্রাজ্য কোথায় আজ তারা ? সময়ের অসীম গর্ভে সকলকেই একদিন বিলীন হয়ে যেতে হয় ।পড়ে থাকে শুধু তাদের ভাঙ্গা চোরা প্যালেস,টুম্ব , ক্যাসেল আর মন্দিরের চিহ্ন ।
সানলিউর্ফায় ( তুরস্ক ) তৃতিয় দিন ‘হারান ‘
সকাল সকাল উঠে ফ্রেস হয়ে সকালের নাস্তা সারলাম আমাদের হোটেলের নিচে। অনেক বাহারি খাবার যা তাদের নিজস্ব কুজিন। অলিভ,বেগুন ভরতা আমাদের মত পিয়াজ মরিচ দিয়ে নয় ,তাদের স্পেশাল একটা চাটনি দিয়ে তৈরি ,তিন রকমের চিজ, সেদ্ধ ডিম, দুই তিন রকমের তাদের মত তৈরী করা রুটি আরও কত কি।
তাদের আথিতিওতা খুব ভালো। খুব মিশুক এবং হেল্প ফুল।আমরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম সারা দিনের জন্য।
প্রথমে দেখার জন্য নামলাম ন্যাক্রপলিস কিজিল্কউন (kizilkoyun) অর্থাৎ গ্রীক আর রোমান দের কবর । গ্রিসীয় রোমান আমলের ধনী পরিবার দের পাহাড়ের গা কেটে কেটে ভিতরে দিকে ঘর বানানো। আর সেখানে তাদের মৃত দেহ গুলো সমাহিত করে রাখা । যারা একটু বেশি ধনী তাদের ঘর গুলোর মেঝে মোজাইক করা ,এক দিকে ক্রন্দন রত নারী মুর্তি আর একদিকে একজন রোমান সোলজার। পরিবারের সবার ছবি পাথর খোদাও করে রাখা হয়েছে । কারো কবরের গেট গ্রীক মন্দিরের মত। এক জায়গায় পড়ে আছে গ্রীক অক্ষরে লেখা মৃত পরিবারের সবার নাম । মোট কবরের সংখ্যা ৭৮ টি । সামনে একটা ছোটো অফিস যেখানে একজন ইংলিশ স্পিকিং গাইড আছে যার কাজ টুরিষ্ট দের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখানো।
আবার মনটা চলে গেলো বিফোর খ্রাইস্ট এর সময় গুলোতে। তখন এখানে রাজত্ব ছিল গ্রীক, রোমান এদের। এই স্থান টির নাম ছিল “এদেসা” ।
নেক্রপলিস দেখার পর ট্যাক্সি রওনা দিলো ‘হারানের’ দিকে।
“হারান” স্যানলিউর্ফা থেকে দেড় ঘণ্টার পথ। সিরিয়া এখান থেকে ১০ মাইল দূরে। এখানে ঐতিহাসিক যত কিছু দেখার আছে তা কে ওপেন মিউজিয়াম বলা হয়।
বিরাট একটা দুর্গ বা ক্যাসেল যেখানে তিন আমলের তৈরি করার চিহ্ন আছে। হিটাই,রোমান আর উমাইয়া আরাব দের । কালো পাথরের দেয়াল হিটাই, ঘন লাল রঙের ইট রোমান এবং হালকা লাল কালারের ইটের দেয়াল আরব বা উমাইয়া বংশের । হিটাই দের কথা উল্লেখ আছে মিশরের মিডিল কিংডমে টুটেনখামনের রানী এঙ্কেসেনামনের এক চিঠিতে ।হিটাই রা এখানে আসে ইউরক্রেনিয়া থেকে ।এখানে সাম্রাজ্য গোড়ে ছিল গ্রীক, রোমান ,রোমান বাইজেনতাইন , এরাব, মামলুক, আব্বাসিও, হিটাই আর অটোম্যান ।
চেঙ্গিস খানের ধ্বংসকরা গ্রীক সিটি, যারা চাঁদ আর সূর্যেকে পূজা করতো অর্থাৎ পেগ্যান আর সেই চিহ্ন সেখানে পড়ে আছে। পাশা পাশি গ্রীক ধর্মের বিরাট এক লম্বা টাম্পেল , উমাইয়া বংশের ধ্বংস প্রাপ্ত আমলের মসজিদ আর ইউনিভার্সিটি আর বিরাট এলাকা জুড়ে ইব্রাহিম (আঃ সা ) এবং এর পরিবার বিবি সারার বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষ ।
আমাদের গাইড একটু কাছেই উঁচু একটা চূড়া থেকে দেখিয়ে দিলো মেসপটিমার বিরাট সমভূমি যা মেসপটিয়ামা নামেই পরিচিত । দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সিরিয়ার সীমানা এবং সিল্ক রুট। যেখান দিয়ে প্রাচীন কালে ব্যাবসা বাণিজ্য চলতো । এই সেই মেসপটিয়ামা যেখানে প্রাচীন মেসপটিয়ামা সভ্যতা গোড়ে উঠেছিল আর যেখানে প্রথম মানুষ কৃষি কাজ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস আরম্ভ করে।
তার পর আমরা দেখতে গেলাম বি হাইভ ভিলেজ । মাটির তৈরি দেয়াল ,ছাদ গোল গোল চিমনীর মতো । দেখতে মৌমাছির চাকের মতো তাই বি হাইভ হাউস বলা হয়। বস বাস রত মানুষ আধুনিক বাড়িতে চলে গেছে । এখানে মিউজিয়ামের মতো করে রাখা হয়েছে। তাদের ফার্নিচার ,রান্না ঘর, শোবার ঘর ,শস্য রাখা বিরাট বিরাট পাথরের পাত্র সব সেই রকম করে রাখা আছে। তাদের পোশাক পরে আমরা ফটোশুট করলাম ।
ইউফ্রেটিস রিভার বোট ট্রিপ ,হালাফি ভিলেজ
সানলিউর্ফা থেকে ট্যাক্সি যোগে দুই ঘণ্টার দূরত্বে ইউফ্রেটিস রিভার । সকালে ব্রেকফাস্টের পর আমরা রওনা দিলাম । তুরস্ক বিরাট একটি দেশ। বাংলাদেশের চেয়ে কমপক্ষে ৬/৭ গুন বড় । লোক সংখ্যা আশি মিলিয়ন আর বাংলাদেশে একশত আশি মিলিয়ন। বেশির ভাগ স্থান খালি কিছুটা উঁচুনিচু । সামারে টেম্পারেচার ৫০ ডিগ্রি, শীতে কোথাও কোথাও বরফ পড়ে । খ্যাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্ন । তুরস্ক নব্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল কান্ট্রি । আমরা দুই পাস দেখতে দেখতে যাচ্ছি।
তারপরে এসে পড়লাম নদীর ধারে, দুই পাড় খাড়া পাহাড়। কোন গাছ পালা নাই। শুধু শক্ত পাথর।এক অদ্ভুত সুন্দর জিওগ্রাফি । নদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে একটা মসজিদের একটা মিনার শুধু উপরে দেখা যাচ্ছে সব ডুবে আছে পানির নিচে । একটা প্রাচীন ভিলেজ পাহাড়ের কেভের মধ্যে যার অনেক ঘর পানিতে ডুবে আছে । যে বোটে আমরা ছিলাম সেখানে স্থানীয় কিছু টুরিস্টও ছিল।
পরের দিন গেলাম উরফা ক্যাসেল ,বাজার, ইব্রাহীম ( সাঃ আঃ) মাজার আর বালিকি গুল দেখতে ।উরফা ক্যাসেল ৬থ -১১থ BC টে তৈরি । কলাম দুইটি তৈরি ২৪০BC । সাম্প্রতিক কালে ক্যাসেলের মধ্যে পাহাড়ের দেয়ালে ৭০ টি রক কাট টুম্ব আর মেঝেতে দুই জন পুরুষ আর দুই জন নারীর ছবি সহ মোজাইকের মেঝে লেখা সহ পাওয়া গেছে ।তবে সেই লেখা পড়া যাচ্ছেনা। ধারনা করা হচ্ছে কোন রাজার পরিবারের কবর এই ক্যাসেলের মধ্যেই ছিল । এখানে প্যালেস ছিল আর ছিল তাদের পারিবারিক কবর । গ্রিক আমলের দুটো পিলার দাঁড়িয়ে আছে তাদের শেষ চিহ্ন নিয়ে।
বাজারে প্রচুর বাদাম,খাবার, শাকসবজি,কাপড় জুতোর দোকান। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো কোনো দারিদ্র চোখে পড়লো না। মেয়েরা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ নয়। স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করছে। মানুষ হাসিখুশি কারন অভাব নাই। রেস্টুরেন্টে মাংসের কাবাব আর রুটি প্রধান খাবার। কারন তুরস্ক পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি ছাগল আর ভেড়ার মাংস উৎপাদন কারী দেশ।
তুরস্ককে বলা হয় “সেন্টার অফ আর্থ” বা পৃথিবীর মধ্যস্থল । চারদিক থেকে কত রকমের রাজা এসে রাজত্ব করে গেছে এবং তাদের চিহ্ন রেখে গেছে। তা ছাড়া সব ধর্মের স্টার্ট পয়েন্ট । সব শেষে এসেছিল “Turrk” ,এই Turrk রাই অটোম্যান এম্পায়ার স্থাপন করে ছিল । আর তাদের বংশধর রাই এখনো এখানে চলমান আছে।
হুসনুন নাহার নার্গিস ,লন্ডন
একটি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
দারুন তথ্য বহুল ভ্রমণ কাহিনী। এতো কিছু বিশ্লেষণ করে লেখা প্রচুর ধৈর্য্য ও শ্রমের ব্যাপার । ধন্যবাদ আপনাকে বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।