পৃথিবীর পথে পথেঃ মিশর (বিখ্যাত ফিমেল ফ্যারো হ্যাটসসেপসুটের টেম্পেল) সাল ২০০৬ (৪ পর্ব )
” Egypt has a story to tell and Im here to listen”
গাধার পিঠে উঠে চলেছি আমাদের পুরো গ্রুপ বিখ্যাত নারী ফ্যারো ‘হ্যাটসসেপস্যুটের’ টেম্পল দেখতে নীল নদের অপর পারে । প্রথমে একটি ছোটো বোটে উঠে এদিকে আসলাম । এসে দেখি সারি বেধে গাধা দাঁড়িয়ে আছে আমরাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
মিশরীয় ভাষায় এই টেম্পেল কে বলা হয় Dsr- dsrw বাংলায় এর মানে ‘পবিত্র দের মধ্যে আরও পবিত্র’ । প্রাচীন মিশরীয় আর্কিটেক্টের এর আর একটা অসাধারণ কীর্তি । তিনটি ম্যাসিভ ট্যারেস একটির উপরে আর একটি তিন তলার মতো করে করা ।যা দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের গা ঘেষে পাহাড় কেটে বানানো । সম্ভবত এটা ‘সেনেন মুট’ তার বিশ্বস্ত ওভারসীয়ার (‘senenmut’ ) এর তত্তা বধানে নির্মাণ হয় ।
পুরো বিল্ডিং টি তে অনেক গুলো সারি সারি কলাম আর কলাম গুলো নারী ফেরো হ্যাটসেপস্যুটের পুরো দেহ, মাথা ও মুখ সহ আকৃতি দিয়ে বানানো।
‘মুহাম্মাদ’ আমাদের গাইড কে আমরা ফলো করছি আর এই বিশাল টেম্পেল টির ইতিহাস আর তার সাথে শক্তিশালী সাহসী এই নারী ফ্যারোর গল্প শুনছি ।
তার আমলটি ছিল শান্তি ও সম্বৃদ্ধ পূর্ণ । কারন টেম্পেলের দেয়াল চিত্রে আঁকা ছবি তে আমরা দেখতে পেলাম ‘পানট’ নামক একটি স্থান, যা ইথিওপিয়ায় অবস্থিত সেখানে পানি পথে বাণিজ্য করতে যাওয়ার দৃশ্য । সেখান থেকে আনা হচ্ছে সোনা,ইবলি, ব্লাক উড, কাঠ, অ্যারোমেটিক বৃক্ষ আর রেজিন । সেই গাছটি লাগানো হয়েছিলো এই টেম্পেলের সামনের বিরাট চত্বরে । যার চিহ্ন ঘেরা দিয়ে রাখা আছে।
এই টেম্পেল টি তার মৃত্যুর দুই দশক পর তুতেমাস ৩ এবং এমেনহটেপ ২ এর হাতে হেটসসেপসুটের লেখা নাম এর কারটুস ড্যামেজ করা হয় । উদ্দেশ্য হয়তো ব্যাক্তি গত রাগ আর নয়তো সে একজন নারী এই জন্য।
সামনের চত্বরে দুই পাশে সারিবদ্ধ পাথর দিয়ে বানানো লায়ন বসা অবস্থায় আছে হ্যাটসসেপসুটের মুখাকৃতি সহ । অনেক গুলোই ধ্বংস প্রাপ্ত । টেম্পেলের পেছনে একটা লম্বা গুহায় তার মমি লুকানো ছিল। ভ্যালি অব দি কিং এর KV ২০ তে তাকে প্রথমে সমাহিত করা হয়েছিলো।
হেটসসেপ্সুটের আর একটি আকর্ষণীয় মন্দির আছে করনাকে । তার দেয়ালে আঁকা আছে ফেস্তিভ চলার দৃশ্য । আর এক দেয়ালে আঁকা আছে জীবন চক্র,করনেসান এই সব।
এটি ইউরোপিয়ান স্কলার আর আরকেওলজিস্ট দের নজরে আসলো ১৭৩৭ সালে। একজন ব্রিটিশ ট্র্যাভেলার এখানে বার বার ভিজিট করেন আর তা লিখে বই বের করেন । এতোই ধ্বংস প্রাপ্ত ছিল তিনি বুঝতে পারেন নাই এটা কি, কে করেছে, কবে করেছে কেন করেছে এই সব।
১৮৫০ সালে Auguste Mariette নামে একজন ফ্রেঞ্চ আরকেওলজিস্ট সিরিয়াস ভাবে কাজ আরম্ভ করেন । তার সাথে আরও ফ্রেঞ্চ আর্কেওলজিস্ট ছিল । তারা খুঁজে পান আরও দুটো টেম্পেলের চিহ্ন । এগুলো হল মেন্তুহটেপ ২ এবং তুথমাস ৩ এর ।
আর্কেওলজিস্ট হ্যাটসসেপসুটের টেম্পেল টিকে রেস্টরেসান করেন । বর্তমান কালে স্কলার রা চিন্তা ভাবনা করছেন পাশের দুই মন্দির কেও উদ্ধার করবেন ।
যাইহোক এটা দেখার পর আমরা চললাম ভ্যালি অব দি কিং দেখতে ।
ভ্যালি অব দি কিং নীল নদের পশ্চিম পাড়ে দেল- ই- বাহারি এর পেছনে। ৬২ টি টুম্ব আছে এখানে। ১৮,১৯,২০ ডাইনেসটির (১৫৩৯-১০৭৫ BC) প্রায় সব ফ্যারোর টুম্ব এখানে আছে । তুতমাস ১ থেকে র্যামেসেস ১০ পর্যন্ত ফ্যারো রা এখানে সমাহিত হয়।
পিরামিড এরার পর চিন্তা ভাবনা করে এই নির্জন এলাকা বেছে নেয়া হয় তাদের সমাধির জন্য। সাথে আছে এই কবর বানানো দের ভিলেজ। লুকানো অবস্থায় যেমন ছিল এই লেবার রা তেমন লুকিয়ে রাখা হতো এই সমাধিগুলো। যাতে তাদের সাথে দেয়া ধনরত্ন কেউ চুরি করতে না পারে।
প্রত্যেক টি সমাধি পাহাড়ের মধ্যে খানে টানেল করে করিডোর আর অনেক কুঠুরি বানিয়ে তা প্লাস্টার করে তাতে বুক অব ডেড অনুসরন করে আঁকা হতো অনেক ছবি। প্রত্যেক কুঠুরি বোঝায় করে ফার্নিচার ,খাবার,ধন রত্ন দেয়া হতো। যাতে মৃত্যুর পর আবার নুতুন জীবনে সেগুলো তারা ব্যাবহার করতে পারে । এগুলো দেখলে বোঝা যায় কত ক্ষমতা ধর ছিল একজন ফ্যারো ।
এখানে তাদের পরিবার,উচ্চ পদস্ত কর্মচারী এবং কিছু প্রিষষ্ট দেরও কবর আছে। সবচেয়ে সুন্দর ‘সেটি ১ ‘এর কবর ,আর র্যামেসেস এর পুত্র দের জন্য শত শত করিডোর সহ ডজন ডজন চেম্বার বানিয়ে সেখানে তার সমস্ত পুত্র দের কবর মহল করা হয়েছিলো। সেটা হল নাম্বার ৫। কারন তার পুত্র সংখ্যা ১২০ জন ।
টিকিট করে একেক জন তিনটির বেশি কবর দেখতে পারবেনা। আমরা ‘সেটি ১’,’তুতেন খামন’, আর আর একজন ফ্যারোর কবর মহল দেখলাম।সে এক এলাহি কাণ্ড ।
বর্তমানে এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে পড়েছে।
লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, লন্ডন