ভ্রমণ কাহিনী
পৃথিবীর পথে পথেঃ জিব্রালটার , সময় কাল ২০২২ (২য় পর্ব)
“We will never surrender we will win or die”
“সারেন্ডার নয় ,হয় জয়লাভ না হয় মৃত্যু”
পরের দিন সকালে স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত জিব্রালটার দেখতে গেলাম। যদিও এটি স্পেনের লাগোয়া ছোট্ট একটি স্থান কিন্তু এটা ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত। ব্রিটিশ দখল করে ১৭০৪ সালে। আফ্রিকা যাওয়ার গেট বলা হয় জিব্রালটার কে ।
৪২৬ মিটার উঁচু জিব্রালটার রকটিতে অনেক গুলো কেভ আছে । সেই কেভ গুলোতে বাস করতো ‘নিয়ানডারথান’ মানুষ ।এর একটির নাম ‘গরহামস কেভ’। সেখানে পাওয়া গেছে নিয়ানডারথান মানুেষর আঁকা পাথরের মেঝেতে কেটে কেটে বানানো ‘দাগ’ । ১৮৪৮ সালে এবং ১৯২৬ সালে তিনটি স্কাল পাওয়া যায়। একটি বয়স্ক নারী এবং দুটি অল্প বয়স বালকের।
৪০,০০০ BC বছর আগে এই রকে পা রেখেছিল ‘নিয়ান্দার ডার থাল’ মানুষ
২০০ মিলিয়ন বছর আগে এখানে সমুদ্র ছিলনা। এখানে চরে বেড়াত বন্য প্রাণী যা আফ্রিকাতে পাওয়া যায়। এখান থেকে আফ্রিকা মাত্র নয় মাইলদূরে ।৬০ -২০ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকান টেকটোনিক প্লেট, ইউরোপিয়ান টেকটোনিক প্লেটকে ধাক্কা দিলে একটি আর একটির উপরে উঠতে থাকে। যার ফলে এই রকটির সৃষ্টি হয়।আর এই রক টির দেয়ালে দেয়ালে যে কেভ গুলো আছে একদিন সেখানে নিয়ান ডান থান মানুষেরা থাকতো।
আমরা দেখতে গিয়েছিলাম এই কেভ গুলো । যেখানে এখনো গবেষণা কাজ চলছে। একেবারে কাছ থেকে দেখার জন্য একটা প্লাটফর্ম বানানো হয়েছে । যেখান থেকে কেভের ভিতর ভালো ভাবে দেখা যায়। তাদের ব্যাবহার করা পাথরের কুড়াল জাতীয় জিনিস পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত হয়।সেখানে ভিজিটর দের জন্য লেকচার আর ফিল্ম দেখানো হয় মিউজিয়ামের টিকিটের সাথেই এটা এক সঙ্গে । লেকচারটি নিয়ানডানথান দের উপরে।
তারপর আমরা মিউজিয়াম দেখলাম । সেখানে ইসলামি আমলের হামাম খানা পাওয়া গেছে ।পাওয়া গেছে সেই আমলের পাত কুয়া আর বসত বাড়ির ফাউন্ডেসান আর ব্যাবহার করা জিনিস পত্র। মিউজিয়াম টি সত্যি খুব রিচ ।
বাইরে মুরস দের দুর্গ এখনো ঠিক ঠাক মতো আছে । ৭১১ AD সালে ‘তারিক ইবনে জায়েদ’ এখানে ৭০০০ আর্মি সহ অবতরন করেন। ‘জেবেল তারিক’ অর্থ ‘তারিকের মাউন্টেন’ ।’জেবেল তারেক’ থেকেই ‘জিব্রালটার’ নাম হয়। একটা বিরাট পাথরের ফলোকে তাঁর নাম উৎসর্গ করা আছে তাঁর ইতিহাস এবং নাম করন নিয়ে । ৭৫০ সালে অসীম সাহসী বীর ‘তারেকে’ পুরো স্পেন দখল করেছিলেন ।
তারপর আমরা এঁকো বেঁকো রাস্তা দিয়ে উপরে উঠে গেলাম ।
সেন্ট মাইকেল কেভ
প্রথমে দেখলাম ‘সেন্ট মাইকেল কেভ’।কেভের ভিতরে লম্বা লম্বা পানির ড্রপের মতো জিনস ঝুলোন্ত অবস্থায় আছে কোনো কোন টি একেবারে মাটির সঙ্গে ঠেকে গেছে এবং স্তম্ভের সৃষ্টি করেছে। ভিতরটা আধা আলো আধা অন্ধরকার । কতরকমের আঁকা বাঁকা সুরঙ্গ এদিক থেকে ওদিক চলে গেছে । দিকনির্দেশনা দেয়া আছে সে হিসেবে আমরা একটার পর আর একটা কেভে ঢুকছি। সব জায়গাতে সেই একই ভৌতিক দৃশ্য । কিভাবে সৃষ্টিঃ রকের জিয়োলজিক্যাল falt। উপরের আর্থের পানি একটু একটু করে পড়ে তা লাইমস্টোনের সাথে মিশে একটা ড্রপের সৃষ্টি করে। বছরের পর বছর ঝুলে থাকতে থাকতে এগুলোর সৃষ্টি হয়। একটা চমৎকার প্রকৃতির বিস্ময়।
কেভের এই লাইমস্টোন মিশ্রিত পানি যে ড্রপের সৃষ্টি করেছে তার বয়স ৩.৩ মিলিয়ন বছর বয়স। যাকে বলা হয় প্রিহিস্টরিক যুগের । কেভের সবচেয়ে গভীর স্থান ৬২.৫ মিটার । সব সময় সেখানে নানান রঙের লাইটের ডিসপ্লে করে আরও চমৎকার করা হয়েছে।
এই রকের আরও কিছু যেমন অনেক উঁচুতে কাঁচের ব্রিজ । অর্থাৎ যার উপর দিয়ে হাঁটলে গা শিউরে উঠবে ,কারন একেবারে অনেক গভীর খাদ দেখা দেখা যাবে উপর থেকে।
তারপর নিছে নেমে আমরা একটা ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে গেলাম ডলফিন দেখতে। একটা দুটো নয়। দলে দলে ডলফিন একেবারে ট্রলারের কাছ ঘেঁষে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
এপার্টমেন্টে এসে পরের দিন সকালে আমরা রওনা দিলাম ফেরি যোগে জিব্রালটার প্রণালী পার হয়ে মরক্কোর ‘তানজিয়ার’ যাওয়া। এক ঘণ্টার পথ ।আরামদায়ক জার্নি । সুন্দর ফেরী। স্পেন থেকে মরক্কো পাড়ি দিয়ে জিব্রালটার প্রণালী দিয়ে যাওয়া । সে এক মজার এডভেঞ্চার। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রণালী ভ্রমণ। স্পেনের তারিকা পোর্ট থেকে তানজিয়ার ১৪.৫ কিমি ।একদিকে আটলান্টিক মহাসাগর আর একদিকে মেডিটেরিয়ান সাগর। ভাবতেই খুব ভালো লাগছিল ।
আমাদের স্পেন আর জিব্রালটার ভ্রমণ শেষ করে পরদিন চলে আসলাম লন্ডনে।