পৃথিবীর পথে পথেঃ ইন্ডিয়া বা ভারত, সময় ১৯৯৮ ,ভ্রমণ কাহিনী
“India is the cradle of the human race, the mother of history, the grand mother of legend and the great grand mother of tradition”.
ভারত বর্ষ “Mother of history” কেন ?
আমাদের ভারত ভ্রমণের কারন হল ভারতের ঐতিহাসিক সাইট গুলো দেখা। নিজ দেশ বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস আর ভারতের ইতিহাস তো একই। যা দেখা জরুরী বলেই মনে করি ।
তা দেখতে হলে আমাদের যেতে হবে অনেক আগের অতীতে । কি সেই অতীত তা জানতে একটা টাইম লাইন করা যায় যা নিচের মতো । তা ছাড়া যে দেশে আমি যায় তার সম্বন্ধে পড়ে গেলে যা দেখতে বা জানতে চাই তা আরও ভালো করে বোধগম্য হয়।
এই হল ভারতের আদি ইতিহাসঃ
+ ৭০,০০০ -৫০,০০০ BCE হিউম্যান রেস বা মানব জাতি আফ্রিকা থেকে বের হয়ে বিভিন্ন যায়গায় যায়, ভারতে আসে এই সময়ে।
+৩৩,০০০- ১৬০০ BCE সিন্ধু সভ্যতা স্থাপন হয়
+ ২০০০-১৫০০ ইন্দো ইউরোপিয়ান মাইগ্রান্ড হয় এখানে
+ ১৮০০BC ক্লাইমেট চেঞ্জ হওয়ার জন্য সিন্ধু সভ্যতা পূর্ব দিকে পদ্মা গঙ্গা নদীর দিকে চলে আসে
+ ৫৬৩ -৪৮৬ BCE গৌতম বুদ্ধের আগমন , + ৫১৮ BCE দারিউস পার্সিয়ান ইন্দাস ভ্যালি দখল
+ ৫০০ BC তক্ষশীলা আর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, + ৫০০ BC রামায়ণ মহাভারত
+ ৩২৬ BC আলেকজান্ডার দি গ্রেটের আগমন
+ ৩২৪- ২৯৮ BC চন্দ্র গুপ্তা ময়ুরা আমল
+ ২৬৯- ২৩৩ BC অশকা
+ ৩০০-৫৫০ C গুপ্ত ইম্পরার
+ ৩১৯- ৩৩৫ c চন্দ্র গুপ্তা ১ (লওহ যুগ ), + ৬০০-৭০০c মুসলিম ব্যাবসায়ির আগমন
+ ৮৭১-৯০৭ cholan ইম্পেরার ,+ ১২০৬-১৫২৬ সুলতান আমল, + ১৫২৬ মুঘল, ১৮৫৮ ১৯৪৭ ব্রিটিশ আমল
সংক্ষেপে এই হল পাক ভারতে যে ভাবে ইতিহাস সৃষ্টি হয় । দিল্লীতে নেমে ঐতিহাসিক সাইট আর মিউজিয়াম দেখে হাতে নাতে অর্থাৎ প্রাকটিক্যাল ভাবে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে ভালো মত ধারনা হয় । যা কিনা আমাদের আগের ইতিহাস ।
এক সময় বাংলাদেশ বা পাকিস্তান বলে কিছু ছিলনা ,ছিল ভারত বর্ষ । বিভিন্ন সময়ে এর মানচিত্র পরিবর্তন হয়েছে। কোনো সময় অনেক ছোটো ছোটো রাজ্যের সমাহার ছিল। একেক রাজ্যের একেক রাজা ছিল। একে ওপরের সাথে যুদ্ধ করতো এবং রাজ্যের বিস্তৃতি করতো। কোন সময় যদি শক্তি শালি শাসক আসতো তাহলে সব রাজ্যকে এক করে বিরাট একটি রাজ্য বানাতো । রাজা যায় রাজা আসে।মানচিত্রের বদল হয়।
দিল্লীতে নেমে পরের দিন বের হলাম হিস্টিরিক্যাল সাইট গুলো দেখতে । সময় টা জুন মাস ।প্রচণ্ড গরম । টেম্পারেচার ৪৫ ডিগ্রি । এই গরমেই দেখে বেড়াতে হচ্ছে সব সাইট গুলো । ভাগ্যিস গাড়ির মধ্যে এসি ছিল।দিল্লীতে যে ঐতিহাসিক সাইট আছে তা হচ্ছে
লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির এবং চন্দ্র গুপ্ত ময়ুরার মুর্তি , যে কিনা চন্দ্রগুপ্ত ময়ূরী শাসন আমলের ভিত্তি স্থাপন করে এই ভারত বর্ষে ৩২৪ BC তে ।যার সময়ে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের যুদ্ধ হয়েছিলো। ‘গঙ্গারীধি’, ‘গঙ্গাদারা’ ‘Gandaridae’ বর্তমানে বাংলাদেশে যার অবস্থান , যার কথা গ্রীক ইতিহাসবিদ ‘হেরোডটাস’ উল্লেখ করেছিলেন ,কিন্তু তার লেখা হারিয়ে গেলে ‘মেগাস্থেনেস’ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে পুনরায় লেখেন। বলে গিয়েছিলেন সেই আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ইতিহাসে । তাই ভেবেছিলাম ভারত গেলে এই ‘চন্দ্রগুপ্ত ময়ূরীর’ স্ট্যাচু এবং তার আমলের আর্ট ইফেক্ট দিল্লী মিউজিয়ামে দেখবো।মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে আসলাম তার আমলের মুদ্রা এবং বেশ কিছু স্ট্যাচু । তার স্ট্যাচু টি দেখলাম লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে গিয়ে ।
অশোকা পিলারঃ
রাজা অশোক (২৭৯- ২৩২) নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে বুদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে । তার রাজত্বের সীমানায় বর্তমানে পশ্চিমে আফগানিস্তান,নেপাল,পাকিস্তান,ভারত ,মধ্য ডেকান এবং বাংলাদেশ পর্যন্ত সব জায়গায় একটা করে ৪০ থেকে ৫০ ফিট উঁচু মিনার বা স্তম্ভ স্থাপন করেন। যাতে লেখা আছে তার রাজত্বের সীমানা এবং বৌদ্ধ ধর্মের চিহ্ন লোটাস বা পদ্ম ফুল এবং সিংহ মূর্তি ।
এই রকম একটি স্তম্ভ দিল্লীতে আছে । সেখানে তার নাম আর রাজত্বের বর্ণনা আছে । দেখতে দেখতে সেই অতীতে চলে গিয়েছিলাম । যখন এই ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম উচ্চ শিখরে ছিল। চারদিকে তাদের রমরমা অবস্থা । যা বাংলাদেশও ছিল তখন অবশ্য ‘বাংলাদেশ’ বলে দেশ টি ছিল না । ভারতবর্ষ ছিল এই অঞ্চল ।
চন্দ্র গুপ্ত ২ এর আইরোন পিলারঃ
চন্দ্রগুপ্ত ২ , যার শাসন কাল ৩৭৫-৪১৫ CE, কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে আছে। লম্বায় ৭.২১ মিটার লম্বা। ড্যাইয়ামিটার ১৬ ইঞ্চি। যে লোহা দিয়ে তৈরি তাতে মরিচা ধরেনা। তার নাম লেখা আছে। যা কিছু লেখা আছে তা পাঠ উদ্ধার করা কঠিন । ভাষা পুরানো। হিন্দু আর্কিটেকচারে বানানো।
কুতুব মিনারঃ
ভারতের প্রথম সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেক এবং তার করা এই কমপ্লেক্স ।যেখানে আছে কুতুব মিনার ।তার নাম দিয়ে মসজিদ আর মিনারটির নাম হয়েছে। ২৩৬ ফিট লম্বা মিনারটি। ১১৯৯ সালে বানানো । ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে অন্তর্ভুক্ত হয়।এটা দেখার পর দেখতে গেলাম মুঘল আমলের সাইট।
মুঘল আমলের সাইট
পুরাতন দিল্লীর লাল দুর্গ , দিওয়ানি আম , দিওয়ানি খাস, চাঁদনি চক, জুম্মা মসজিদ, হুমায়ুনের কবর এগুলো ভিজিট করলাম।
দিল্লী ন্যাসানাল মিউজিয়াম
দিল্লী মিউজিয়াম এতো বড়ো আর এতো এতো কালেকশান জানা ছিলনা। হরপ্পা মহেঞ্জারো সভ্যতার কালেসান চমৎকার ভাবে সাজিয়ে রেখেছে।এই বিরাট মিউজিয়ামের টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। কতরকমের যে গ্যালারী ।
৩৩০০ BC -১৩০০ BC ইন্দাস ভ্যালি, হরপ্পা আর হারিয়ানা তে পাওয়া রাখিংগড় সভ্যতার সমস্ত প্রত্নতত্ত্ব ,রাখিংগড়ে পাওয়া ১১ টি কঙ্কাল এর একটি কংকাল যে ভাবে ছিল সেই ভাবেই রাখা হয়েছে। ইন্দাস ভ্যালিতে পাওয়া সেই নৃত্য রত মেয়েটির স্ট্যাচুটি দেখলাম। চন্দ্রগুপ্তা ময়ুরা যুগের গ্যালারী, কুসানা গ্যালারী, গান্ধার আর্ট গ্যালারী, মহা ভারতের ঘোটে যাওয়া দৃশ্য যা কিনা টেরাকোটা মাটিতে খোদায় করা আছে তা এখানে আছে।
পাথরে খোদায় করা বুদ্ধ দেবের মূর্তি এবং পাথরা খোদায় করে তার শেষ কৃত্য আঁকা স্তেলা বৌদ্ধ গ্যালারীতে রাখা আছে।
মুঘল আমলের বাদশাহ জাহাঙ্গীরের হুঁকা, জেড পাথরের তৈরি সুরায়, বানারস রাজার সিংহাসন , মুঘল আমলের নানা রকমের আর্ট ,জুয়েলারি, সিরামিকের বাসন পত্র, পোশাক আসাক, পুরানো লেখার স্তেলা, নানা আমলের দলিল দস্তাবিজ, বিভিন্ন আমলের মুদ্রা, কাগজের নোট,মেডেল এবং যুদ্ধে ব্যাবহ্রিত কামান এবং অস্ত্র রাখা আছে।
এক কথায় মিউজিয়ামটি যেন অতীত ভারতের নানা ঘটনার সাক্ষী সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা আছে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে অনেক সময়ের দরকার।
পরের দিন চললাম আগ্রা। কারন আগ্রার তাজমহল তো দেখতেই হবে। আগ্রা দিল্লী থেকে ২৩৫ কিমি দূরে । একটা ট্যাক্সি নিয়ে চললাম আগ্রার পথে আমাদের পরিবার ট্র্যাভেল টিম। প্রচণ্ড রোদের তাপ। মানুষ কিভাবে এখানে থাকে তাই ভাবছিলাম। প্রবেশ ফি দিয়ে সামনে এগুলাম ।সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘তাজমহল’। সামনে মুঘল আমলের ডিজাইনের বাগান। মাঝে মাঝে ফোয়ারা । পাতা আছে বেঞ্চ । যেখানে বসে সরাসরি সামনের দিকে তাকালেই তাজমহল।
সাদা ধবধবে মার্বেল দিয়ে তৈরি ইয়ামুনা নদীর তীরে তাজমহল । ১৬৩১ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মুমতাজ বেগমের সমাধির উপরে এটি নির্মাণ করেন । যার আর্কিটেকট উস্তাদ আহমেদ লাহোরি ১৬৩২ সালে নির্মাণ কাজ আরম্ভ এবং শেষ হয় ১৬৪৮ সালে। ৪২ একর জায়গার উপরে এটি নির্মাণ করতে খরচ হয় ৪৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা দেখতে প্রতি বছর ৭/৮ মিলিয়ন টুরিস্ট আসে। ২০,০০০ আর্টিস্ট এখানে কাজ করেছিল। সমাহিত করার দিন হাজার হাজার শোকাহত মানুষের সমাবেশ হয়ে ছিল । “The jewel of Muslim Art in India” এই ক্যাট্যাগেরিতে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেয সাইটের অন্তর্ভুক্ত হয়।
আগ্রা ছিল মুঘল সুলতান দের রাজধানী । রাজপুত রাজা ‘পৃথ্বীরাজ চৌহান’কে পরাজিত করে ‘মুহম্মদ ঘোরি’ ভারত দখল করে ১১৪৯ সালে । শুরু হয় মুসলমানদের রাজত্ব।সব দেশ বাসী ভারতীয় আর শাসক মুসলমান । যারা এখানকার নয়।
সুলতান দের পরে আসে মুঘলরা । মুঘলদের অনেক স্থাপনা এখানে আছে। তার মধ্যে যা আমরা দেখলাম তা হলঃ আগ্রা দুর্গ , শিশমহল, জাহাঙ্গীর প্যালেস, দিওয়ানি আম আর দিওয়ানি খাস, সাম্মান, জাহাঙ্গীরের বাথ টাব, ফতেপুর সিক্রি, আকবরের কবর, অঙ্গুরি বাগ, মেহতাব বাগ এবং মরিজম জামালি। প্রত্যেকটি স্থাপত্য ইরান বা উজবেকস্থানের সাথে মিল।
রাজধানী হয়ে উঠে মুঘল সুলতানদের কালচার,ধর্ম আর দর্শনের কেন্দ্রস্থল । আমরা দেখতে পেলাম এখন অনেক কারিগর কাজ করছে মুঘল আমলের আর্ট নিয়ে। তাদের হ্যান্ডক্রাফট , জুয়েলারী মার্বেল, চামড়া এবং কার্পেট এখনো বেশ চলমান। বিভিন্ন জায়গাতে এসব বিক্রি হচ্ছে। আমরাও কিছু কিনলাম বাজার ঘুরে ঘুরে।
এবার ফিরে আসলাম দিল্লী ।
ভারতে অনেক বস্তি আছে। বস্তি গুলো যেন বলছে “India is a rich country where live most poor people”. এই বস্তি গুলি এখন টুরিস্ট সাইট। বস্তি এলাকা ভেঙ্গে তাদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয় বটে কিন্তু আবার গ্রাম থেকে কাজের আশায় দরিদ্র পরিবার এসে জড়ো হয়। আবার বস্তির সৃষ্টি হয়। বস্তি হল সেই স্থান যেখানে বেকার,সল্প মজুরী পাওয়া লেবার, অতি অল্প জায়গায় গাদাগাদি অবস্থায় বাস করে যা কিনা অস্বাস্থ্যকর এবং নিজেদের প্রাইভেসি বলে যেখানে কিছু নাই। বস্তি দেখে এসে মনে হল “India is rich but Indians are poor” .
“India is great grand mother of tradition”
ভারতবাসীর জীবন এবং পরিবারের গঠন দেখে মনে হল তারা পুরানো পন্থা মেনে চলে। যা যুগে যুগে চলে আসছে। এক ছাদের নিছে যৌথ পরিবার বা জয়েন্ট ফ্যামিলি এক সঙ্গে বাস করে। যেখানে দাদা দাদী , চাচা চাচী, ফুপু কাজেন এক বাড়িতে থাকে। যা শহর হোক বা গ্রাম।যার ভালো মন্দ দুই দিকই আছে। ধর্ম তাদের প্রত্যহিক আচার আচরণের একটা অংশ।
ভারত দেখে চলে আসলাম । নিয়ে আসলাম সাথে করে জানা অজানা অনেক ইতিহাসের স্বচোক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে । এবার ফেরার পালা ।
লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, লন্ডন
একটি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
ভারত বর্ষের ইতিহাস আসলেই খুব প্রাচীন। অনেক আগে থেকেই এখানে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। আর এর ঐশ্বর্য ও সম্পদের লোভে বাহির থেকে কতো জাতি এসেছে। এক খবরে দেখলাম আমাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার খনন করতে যেয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু আবিষ্কার হয়েছে। সেটার বয়স খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে। অর্থাৎ ঢাকার পত্তনও খুব প্রাচীন। ধন্যবাদ আপনাকে।