পারিবারিক সহিংসতা এবং পৃথিবী জুড়ে এর করুন কাহিনী  

 

গল্প  ( এক)

রান্না করতে করতে আমিনা দেখত রান্না ঘরের  জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির রীতার মা স্কুলে যাচ্ছে টিচিং করতে। রীতার মা  স্থানীয় একটা গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা । তারই বয়েসি রীতার মা  যাচ্ছে  শিক্ষিকা হয়ে আর সে তখন ব্যাস্ত বিরাট পরিবারের  রান্নায় । তার কোন ফ্রি টাইম নাই।

আমিনা ভাবে সেও যদি তার মতো টিচার হতে পারতো ! তার কত ইচ্ছা ছিল প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার কিন্তু সে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। তার  বাবা তার পড়াশুনার দিকে কোন নজর না দিয়ে বিয়ে দিয়ে ‘কন্যা পার’ করেছে।

মাত্র ১৫ বছর বয়েসে তার বিয়ে । বিয়ের পর স্বামীকে কত বার বলেছে আমাকে পড়াও ,স্বামী কি সেই কথা শুনে ! তাকে নিয়ে আসা হয়েছে সংসারের ঘানি টানার জন্য। বিয়ের বছর যেতে না যেতেই গর্ভ ধারণ এর তার পর চলতে থাকে লম্বা ট্রেনের সারী । প্রতি দুই বছর যেতে না যেতেই একটা করে বাচ্চার জন্ম । প্রথম দিকে তিনটি  বাচ্চাই মেয়ে, একটা ছেলে ।কিন্তু স্বামীর তো আরও ছেলে দরকার।চারটার পর ছেলে হতে থাকে এবং সব কটাই পর পর ছেলে হয় এবং সব মিলে দশ।স্বামী তো মহা খুশি । ছেলে বলে কথা ! ‘পুত্র সন্তানের বাবা’  বলে বুক ফুলিয়ে চলা যাবে!

বাচ্চা হতে হতে আমিনা রক্ত শূন্য হয়ে পড়ে। কিন্তু কোথায় ওষুধ ? কোথায় পুষ্টি কর খাবার? কোথায় চিকিৎসা ? ভালো খাবার সব স্বামীর পাতে ,চিকিৎসা তাও তার। পুষ্টিকর খাবার গুলো স্বামীর পাতে অবশই দিতে হবে কারণ সে হল উপার্জনকারী ।

বিরতিহীন ভাবে বাচ্চা হতে হতে কঙ্গালসার আমিনা অনেক বার বলেছে ‘আর নয় আর নয় ‘ । সে কথায় কোন কর্ণ পাত করেনি স্বামী । কর্ণধার তো স্বামী ।

আমিনার সব আক্ষেপ  গিয়ে পড়ে নিজ বাবার উপরে।কেন তাকে স্কুলে পাঠানো হয়নি ? বাবা মারাই মেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছা  কেয়ার না করে  বিয়ে দায়, কোন কিছু না দেখেই পাত্রস্থ করে, তারাই সম্পত্তি থেকে কন্যাকে বঞ্চিত করে। তারাই সন্তান জন্ম দিয়ে শিক্ষা,  চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

গল্প ( দুই)

 

লোরাকে  আজ দেখতে আসবে। চারদিকে বড় বড় ডেকচিতে রান্নার   আয়োজন চলছে। দেখতে আসলে যে এতো বড় আয়োজন করতে হয় সে অভিজ্ঞতা  নুতুন বাবার জানা ছিলনা। আর তিনি এটা ভাবেছেন হয়তো তার এতো শিক্ষিত মেয়েকে অপছন্দ না করে কেউ যাবেনা। বর পক্ষ কে খুশি করতে হবে।

লোরার বাবা এলাকার মধ্যে শিক্ষিত এবং ধনী বলে পরিচিত। সেই পরিবারের ভার্সিটি শেষ করা  মেয়ে লোরাকে সাজানো হচ্ছে।

বর পক্ষের অপছন্দের খবর আসে । ভেঙ্গে পড়ে সবায়। এটা যে কত খানি  অপমান আর গ্লানিকর   একটা মেয়ের জন্য তা সেই ভুক্ত ভোগীই  জানে।

তারপর তোড়িঘড়ি করে যে পাত্র আসে তার হাতেই সমর্পন করা হয় লোরাকে। তা ছাড়া লোরা এই অপমান থেকে বাঁচতে একটা যেন পথ পায় ।

বিয়ে দিয়ে বাবামা মনে করে বাঁচলাম । মেয়েটার একটা সুরাহা হল । কিন্তু মেয়েটা কি বাঁচলো ? “মেয়েদের বাঁচা আর জীবন বিয়ের আগ পর্যন্ত তারপর মেয়েদের যে বাঁচা বা জীবন তাকে জীবন বলে না” একজন ভারতীয় গবেষকের উক্তি।

শিক্ষিত লোরার জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে এই স্বামী দ্বারা । সন্দেহ বাতিক,  একটুতেই উত্তেজিত , অপমান, আর শারীরিক অত্যাচার । যা সে কাউকে বলতে পারেনা লজ্জায় । তার শিক্ষার কোন দাম নাই তার কাছে । উত্তেজনা হয়ে পড়ার পর যখন কিছুটা শান্ত হয় তখন নমনীয় হয় আর ভালো মানুষ সাজে এমনকি মাফ চেয়ে নায় ।  লোরা ভাবে ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু কিছুদিন পর আবার সেই একই ক্যারেকটার আর এভাবেই বিবাহিত জীবন চলতে থাকে। যাকে বলা হয় ‘চক্রাকার অত্যাচার’ ।

গল্প ( তিন)

চার দিকে সরিষা ক্ষেত, ফুল ফুটেগেছে, হলুদের ছড়াছড়ি। আল দিয়ে লাফাতে লাফাতে কিশোরী মেয়েটা কিছু ফুল তুলে  চূলে দায়।

কিছু দূরে আর একটা ক্ষেতে বোরো ধান । গোড়ায় পানি জমা। ডাঁড়কানা  আর পুঁটি মাছ দলে দলে  ঘুরে  বেড়াচ্ছে । গামছা নিয়ে সখি নিয়ে নেমে পড়ে রাবেয়া । মাছ ধরে বাড়িতে নিয়ে এসে মাকে দায়।

এইভাবে রাবেয়ার কিশোরী জীবন স্বাধীন ভাবে চল ছিল ।

তারপর সমস্ত আনন্দ আর স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে শুরু করতে হল বিবাহিত জীবন। “বিয়ে  একটা হিন্দি ফিল্ম নয়।” (Marriage Is not a Hindi film) । বিয়ের আগে বোঝানো হয় না এর সাথে কি জড়িত আছে। কতখানি দায়িত্ব  বা কি হতে পারে।

একদিনই মেয়েরা সেজে রানী হয় তারপর চাকরানী । ছেলে ভার্সিটিতে পড়ে তাকে পড়ার খরচ দিতে হবে । এই শর্তে বিয়ে হয়। পড়াশুনা শেষ করে পাত্র কলেজের শিক্ষক হয়। ছাত্র পড়ায় কলেজে ,মানুষ গড়ার কারিগর।বাইরে এক রকম ভীতরে আর একরকমের পারসোনালিটি ।  যার হাত দিয়ে ছাত্র ছাত্রী মানুষ হবার কথা সে বাড়িতে বউ পেটায় । অপমান করে, গালি গালাজ করে, মানুষ বলে গণ্য করেনা। এই হল শিক্ষক। আর এই হল তার  শিক্ষা।

এই ধরনের কাহিনী পাকভারত উপমহাদেশের  ঘরে ঘরে। পারিবারিক সহিংসতা তো শুধু একটা রূপ নয় ,তার অনেক রূপ আছে ।যেমন কন্ট্রোলিং ,মানসিক, অর্থনৈতিক এবং যৌন অত্যাচার।

কিছু পুরুষ মানুষ মেয়েদের দুর্বল দিকটা খুঁজে আর তা দিয়ে বুলি করে। এখানে রাবেয়াকে এই পুরুষ টি  তার শিক্ষা নাই এটা দিয়েই কাবু করতে চায় আর নিজের ক্ষমতা ঝাড়তে চায়। কারণ অনেক পুরুষ মানুষ নারীর উপর ক্ষমতা আর দেখাতে পছন্দ করে আত্ম তৃপ্তি পায় ।

বার্টেনড  রাসেল বলে ছিলেন ” সমাজ বদলাতে হলে মানুষের চিন্তাধারা আর  নৈতিকতা বদলাতে হবে। সার্টিফিকেটের শিক্ষা দিয়ে নয়। প্রকৃত শিক্ষা”   ।

আমরা দেখি  শিক্ষিত ,  অশিক্ষিত , উচ্চ বিত্ত ,নিম্ম বিত্ত, মধ্য বিত্ত, শহরে কিংবা গ্রামে ,  দেশে বা সমস্ত পৃথিবীতে  মেয়েদের একই অবস্থা। অনেক দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে মেয়েদের উপর অত্যাচার তুলনামূলক ভাবে কম ।

কারণ তারা  জেগে উঠেছে , সোচ্চার হয়েছে প্রতিবাদ করে নারীর  উপর পুরুষের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আজকের অবস্থায় এসেছে।

এখন আমরা দেখবো কি সেই প্রতিবাদের গল্প,  কেমন করে আরম্ভ হল  কে আরম্ভ করলো ,  কখন থেকে আরম্ভ হয়েছে ,  তাঁদের উদ্দেশ্য কি এবং কোন পর্জায়ে আছে সেই আন্দোলনের ধারা ।

পারিবারিক সহিংসতা ‘Behind The Closing Door’ অর্থাৎ ‘বন্ধ দরজার পেছনে’ ঘোটে থাকে । মেয়েরা তেমন প্রকাশ করতে চাইনা চরমে না যাওয়া পর্যন্ত । যার ফলে রিপোর্ট হয়না।

বেশির ভাগ পুরুষ মনে করে,  এটা করা তাদের অধিকার । দরকার আছে বলেই তারা  করে। তাছাড়া একজন দোষ করলে তো তাকে মারধোর করতেই হবে।

ইউনাইটেড ন্যাসান এর মতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সহিংসতার  শিকার হয় একজন মেয়ে। কারণ   ‘দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার।’ যুদ্ধ কালীন সময়ে সমাজের নারী,বৃদ্ধ বৃদ্ধা আর শিশুরা কষ্টে পড়ে বেশি । অসহায়ত্বের শিকার তারাই  হয় । পেছনের কারণ তারা  দুর্বল । আর যুদ্ধ ছাড়া স্বাভাবিক সময়েও এই তিন শ্রেণি ক্ষমতাবান দ্বারা অত্যাচারের সম্মুখীন হয়।

ভায়োলেন্সের অনেক ধরনের ধরন আছে। যেমন শারীরিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার, কনট্রোলিং,চলাফেরার স্বাধীনতা না দেয়া, অর্থনৈতিক ভাবে কনট্রোলিং, গালাগাল দেয়া, ধর্ম ব্যাবহার করে অত্যাচার, যৌন হয়রানী, জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভ ধারণ করতে বাধ্য করা, কথা বলার অধিকার না দেয়া, জোর পুর্বক টাকা কামাতে বাধ্য করা এবং তা নিয়ে নেয়া অথবা চাকুরী করতে না দেয়া । এগুলো সবই অত্যাচারের মধ্যে পড়ে।

তা ছাড়া মেয়েদের গায়ে এসিড ছোরা , যৌতুক না দেয়ার জন্য অত্যাচার করা বা মেরে ফেলা বা আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে মারা।

অনেক সময় সহিংসতা করাকে নিজস্ব পারিবারিক ব্যাপার বলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটি একটা ট্র্যাপের মধ্যে পড়ে। আর সেটা  হল একদল অত্যাচার কারী মানুষের সাথে সর্বদা বসবাস । কারণ হল অত্যাচার করে একজন মেয়েকে কাবু করে নিজের আন্ডারে রাখা।

অনেক সময় অনেক সমাজ ভাবে এটা তাদের কালচার বা প্রথা। অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল  থাকা ভয়,লজ্জা অথবা সন্তানের কথা ভেবে  একজন নারী এই সহিংসতার মধ্যেই জীবন কাটাতে বাধ্য হয়।

পারিবারিক সহিংসতার শিকার মেয়েরা নানা রকম শারীরিক এবং মানসিক অসুখে  ভুগে।যেমন Dysregulated aggression, vicarious disorder, Traumatization, Hypervigilance to threats, Post tranmaticstress, কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলা এবং কনফিউজড হয়   ইত্যাদি।

যেহেতু এটা একটা সুস্থ পরিবেশ নয় তাই এর মধ্যে থাকতে থাকতে একটা মেয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

ইতিহাসঃ

ব্রিটেনের ইতিহাসে ১৮০০ শতকের গোড়ার দিকে ‘স্ত্রীকে মারধোর’ স্ত্রীর উপরে স্বামীর অধিকার হিসেবে ধরা হতো । সে সময় একটা মেয়ে স্বামী দ্বারা গুরুতর আহত বা মৃত্যু হলে  শাস্তির নিয়ম থাকলেও ছোটোখাটো অত্যাচার জরিমানা দিয়ে সম্পন্ন হতো। অনেক সময় স্বামীকে অত্যাচার না করার গ্যারান্টি চেয়ে নেয়া হতো ।

১৬৪১ সালে আমেরিকায় আইন পাস হয় স্বামী স্ত্রীকে আঘাত করতে পারবেনা। নিউ হামসায়ার ফোজদারি মামলায় স্ত্রীকে মারধোর নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকায় বিপ্লবের পর স্থানীয় বিচার পতির  হাত  থেকে রাজ্য আদালতের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। তখন নিষ্ঠুরতা এবং প্রহারের শিকার নারী বিবাহ বিচ্ছেদ নিতে থাকে বেশি।

উনিশ শতকে নারীবাদী আন্দোলনে ফলে ব্রিটেন,আমেরিকা, জার্মান, ফ্রান্স সহ পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলোতে পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত আইন পরিবর্তন হতে থাকে।

১৮৫০ সালে USA তে স্ত্রীকে প্রহার একেবারে নিষিদ্ধ হয়। ১৮৭৮ সালে ব্রিটেনে নারীকে অত্যাচারিত স্বামী থেকে আইনী ভাবে বিচ্ছেদ অধিকার কার্জকর হয়।

বিস শতকের প্রথম দিকে পুলিশ নারী অত্যাচারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা পায়। অত্যাচারিত নারী কত্রিক পুলিশ ডাকা একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় ।ব্রিটেনে এবং পশ্চিম ইউরোপে,   পুলিশের নুতুন ক্ষমতা হল,  একটা মেয়ে পুলিশ ডাকলে মেয়ে যদি নারাজ থাকে  পুরুষ টিকে ধরে নেয়ার ব্যাপারে তবে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবেনা। কিন্তু দ্বিতীয় বার পুলিশ ডাকলে সেই একই মেয়েটি না চাইলেও , পুলিশ ধরে তো নিয়ে যাবেই তার নাম রেকর্ড হয়ে থাকবে এবং পরবর্তিতে তার চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে।

বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে  আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউ আরম্ভ হয়। তখন সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনী  অনুশীলন জোরদার হতে থাকে।

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ দ্বারা এর বিরুদ্ধে আইনী কৌশল প্রকাশ করে। তারেই ফলে সারা বিশ্বে পারিবারিক সহিংসতাকে অপরাধ বলে গণ্য হতে থাকে।

কর্ম ক্ষেত্রে নারীর উপরে  পুরুষের যৌন হয়রানী বন্ধের ঘোষণা আসে। ২০০২ সালে EU Dairective দ্বারা কাউন্সিল অফ ইউরোপে পাস হয় পৃথিবীর সব দেশে নারীর উপরে পুরুষের সহিংসতা বন্ধের।

শারীরিক অত্যাচার বাদে, যৌতুক নিয়ে বিয়ে বা তার জন্য মেরে ফেলা সহ অত্যাচার, বাল্য বিবাহ, ১৮ হওয়ার আগে বিয়ে এগুলোর দিকে নজর দেয়া হয়েছে ।

২০১৩ সালে ইউনাইটেড ন্যাসান স্যাব্যস্থ করেছে এবং রেজোলিউশান পাস করেছে প্রত্যেক রাষ্ট্র থেকে জোর পুর্বক বিয়ে এবং আন্ডার এজ বিয়ে বন্ধ করতে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

কারন সংসার অনেক বড়ো ব্যাপার মানসিক পরিপক্বতা না আসলে কারোরেই সংসার করা উচিত নয়। তাছাড়া আন্ডার এজ বিয়ে বা বাল্য বিয়ে একটা শিশুর জন্য হারমফুল ।

স্ত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও যৌন সম্পর্ক বৈবাহিক ধর্ষণ ১৯৬০সালে আন্তর্জাতিক ভাবে অপরাধ বলে গণ্য হয়।

১৯৯০ সালে স্বামী দ্বারা গায়ে হাত তোলা আইন দ্বারা বন্ধ করা হয়েছে।

১৯৫০ সালে ‘শেয়ার আরনিং শেয়ার প্যেরেন্টইং ম্যারেজ’  চালু হয় যাতে স্বামীর একক ক্ষমতা খর্ব হয়।

ভারতে অনেক প্রচারের পর ২০০৫ সালে নারী সুরক্ষা আইন পাস হয়।

কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল এবং USA নিহত নারীর ৪০% -৭০% নিজ ঘরে স্বামী দ্বারা হত্যার শিকার হয় ।

জাতীসংঘ ঘোষণা পত্র ১৯৯১

“নারীর প্রতি সহিংসতা নারী পুরুষের অসম শক্তির বহিঃ প্রকাশ”, জাতীসংঘ  ঘোষণা পত্রে বলা হয়েছে,  পুরুষের আধিপত্য নারীকে এগিয়ে যেতে বাধা সৃষ্টি করে।

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা দূর করতে তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে জাতিসংঘ ব্যাবস্থা নিয়েছে ।

১) পরিবারের মধ্যে সহিংসতা

২) সমাজে তৈরি অত্যাচার

৩) রাষ্ট্র দ্বারা উপেক্ষা করাও একটি সহিংসতা

জাতীসংঘের ঘোষণা , রাষ্ট্রকে ব্যাবস্থা নিতে হবে,  সমাজের মানুষকে বুঝাতে  হবে নারীর উপর অপরাধ একটি অন্যায় ।

তালাকপ্রাপ্ত নারী ,সিঙ্গেল মা, বিধবা নারী এরাও মানুষ এবং এদের অধিকার আছে মানুষ হিসেবে ।  তাদের থাকার ব্যাবস্থা, ট্রেনিং, চাকুরীর ব্যাবস্থা  ভাতা প্রদান এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যাবস্থা করা  তাদের বাচ্চাদের বিনা পয়সায় লেখাপড়া চালানো এবং ফ্রি চিকিৎসার   দায়িত্ব সরকারের নিতে হবে।

সমাজ এবং পরিবার কত্রিক  বহিষ্কৃত হবার ভয়ে অত্যাচার সহ্য করেই  থেকে যায় অনেক নারী। কারন তালাক প্রাপ্ত মেয়ে রক্ষণশীল পরিবারে প্রত্যাখান  হয় সেখানে সন্মান পাওয়া যায়না বা সমাজ ভালো ভাবে দেখেনা । এই কলঙ্ক এড়াতে অনেক নারী নির্জাতন সহ্য করে থেকে যায় ।

বিবাহ বিচ্ছেদ হলে নারী স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে । নারীর সামনে তখন দুটি পথ খোলা থাকে ১) হয় ঘরে বসে সহিংসতা সহ্য কর  ২)  না হয় রাস্তায় ভিক্ষাব্রিত্তি কর।

বহু দেশেই পুরুষ মানুষ বুঝতে পারেনা যে স্ত্রীর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো আইন বিরোধী ।বুলগেরিয়ায় একজন অত্যাচারী স্বামীকে আদালতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো সে বুঝতে পারছে কিনা যে সে অন্যায় করেছে ? উত্তরে সে বলেছিল ‘সে তো  আমার স্ত্রী , স্ত্রী কে তো একজন স্বামী মারতেই পারে, আমি তো অন্য মানুষকে মারছিনা’ এই ব্যাক্তিটি বুঝতেই পারছেনা স্ত্রীকে মারধোর আইন বিরোধী। এই রকম পুরুষ সব দেশে হাজারে হাজারে।

নির্জাতনের কারনঃ

১) শারীরিক বা মৌখিক নির্যাতন কে গ্রহণযোগ্য মনে করা

২) মাদক বা ড্রাগ আসক্ত

৩) বেকারত্ব

৪) মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

৫) মোকাবেলা করার দক্ষতার অভাব

৬) নির্জাতকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা

৭) নৈতিকতার  অভাব

৮) মারধোর করে আত্মসন্তুষ্টি

৯) নির্যাতনের পর প্রেমময় বা দয়ালু সাজা তখন নির্যাতিত মেয়েটি আশাবাদী হয় যে পরিস্থিতি বদলে যাবে ,তারপর উত্তেজনা আবার বাড়ে এবং পুনরায় অত্যাচার এবং নির্জাতন চালাতে থাকে যা চক্রকারে চলতে থাকে ।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নববধূ স্বামীর ঘরে আসে তখন তার অবস্থা সবচেয়ে নিচে থাকে। পুত্র বধূর আগমনে শ্বাশুড়ীর  মর্যাদা বাড়ে। তিনি নিজেও নির্জাতিত ছিলেন । এখন তিনিই আবার নববধূর উপর নির্জাতন চালান । যেটাই এখন রীতি হয়ে চলে আসছে।

অর্থনৈতিক ভাবে অত্যাচার বা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাবিউসঃ

১) জোরপূর্বক ডকুমেন্টে সিগনেচার দিয়ে সম্পত্তি বিক্রি বা সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া

২) জোর পুর্বক উপার্জন করতে পাঠানো তারপর তার উপার্জিত অর্থ কেড়ে নেয়া ৩) অথবা তাকে উপার্জন না করতে প্রেসার দেয়া যাতে সে অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল থাকে  এবং তাকে দুর্বল পজিসানে রাখা দেখে মজা পাওয়া।

৩) স্ত্রীর জমানো অর্থের দিকে লোভী দৃষ্টি এবং সে কথায় খরচ করছে তা চোখে চোখে  রাখা । পৃথিবীর অনেক দেশে নারী পুরুষের ইনকামের উপর নির্ভরশীল বা নারীর ইনকামের সুযোগ কম। অনেকের নিজস্ব ব্যাঙ্ক এক্যাউনট নাই  । নারীর এই অবস্থা তাকে বিরাট সমস্যার মধ্যে ফেলে দায়।

নারী এবং  মেয়ে শিশুর অপুষ্টি জনিত সমস্যাঃ

পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে নারী এবং মেয়ে শিশুকে পুষ্টিকর খাবার দেয়া হয়না। মনে করা হয়  পুত্র এবং পুরুষ ভালো খাবার পাওয়ার অধিকারী । খাবার বণ্টনে অসমতা একটা রেওয়াজ অনেক পরিবারে।

যৌন সংক্রান্ত নারী অত্যাচারঃ

কাজ দেয়ার কথা বলে নারী পাচার এবং তারাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন কাজে লিপ্ত করানো । অপ্রাপ্ত বয়স, অপরিপক্বতা,  অসুস্থতা,অক্ষমতা, বা মাদকের প্রভাব দিয়ে বা ভয়  দেখিয়ে  চাপ  সৃষ্টি করে একজন নারীকে যৌন কাজে ব্যাবহার করা নারীর উপর অত্যাচার ।

অনেক কালচারে একজন ধর্ষিত নারী অসন্মানের বলে বিবেচিত হয়ে সন্মান রক্ষার্থে তাকে হত্যা করা সহ পারিবারিক সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় ধর্ষণে গর্ভবতী হলে তার ক্ষেত্রে আরও বেশি লাঞ্ছনা নেমে আসে।

নারীকে মানসিক নির্যাতনঃ

১) জনসমক্ষে লাঞ্ছনা ২) অনবরত অবমূল্যায়ন ৩) নিরলস সমালোচনা ৪) জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ ৫) অহেতুক সন্দেহ প্রবণতা ৬)জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে স্বাধীনতা হরন ৭) মৌখিক অপমান করে পরনির্ভরশীলতা করা ৮) হুমকি দেয়া ৯) একা করে দেয়ার চেষ্টা

বিশ্ব জুড়ে সহিংসতা আছে । ধনী গরীব সব মেয়েকেই এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবে বেকার অল্প শিক্ষিত এবং এবং অল্প আয়ের নিন্মবিত্ত শ্রেণিতে এই সহিংসতার হাড় বেশি। সাব সাহারা আফ্রিকা , লাতিন আমেরিকা , দক্ষিণ এশিয়া ( বাংলাদেশ ,নেপাল,ভারত,পাকিস্তান, আফগানিস্তান ,শ্রীলঙ্কা ) উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যে নারীর উপর সহিংসতা বেশি।

পশ্চিম ইউরোপ, পুর্ব এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকায় নারীর উপর সহিংসতার  হার কম।

নারীর প্রতি অত্যাচার অনেক দেশে একটা কালচার

অনেক সমাজে বা দেশে এমন কিছু প্রথা চালু আছে যা নারীর জন্য অত্যাচারের সামিল। এই ধরনের জেন্ডার বেস অত্যাচার চালানো হয় যেহেতু সে একজন নারী। শুধু মাত্র নারী হওয়ার জন্য ,তার উপর অবিচার এবং তার সাথে খারাপ ব্যাবহার , গত দশকে আন্তর্জাতিক ভাবে সোচ্চার হচ্ছে ,প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে । বলা হচ্ছে এগুলো সভ্য সমাজে চর্চা কোন মতেও উচিত নয়।

যেমন টাকার বিনিময়ে বিয়ে দেয়া যাকে বলা হয় যৌতুক যা অনেক দেশে ছেলেকে দিতে হয় মেয়ের বাবাকে ,আবার অনেক দেশে মেয়ের বাবাকে দিতে হয় পাত্র  পক্ষকে। জোর পূর্বক বিয়ে, বাল্য বিয়ে এগুলো অত্যাচারের সামিল।

অনেক দেশে এমন কিছু প্রথা আছে যা দ্বারা নারী মানে পুরুষের সে সমকক্ষ সে নয় এবং সন্মান পাওয়ার যোগ্যও নয়। যেমন পুত্র হল বংশ  রক্ষা করা সন্তান কন্যা নয়।পুত্রের জন্য বাড়ি করে রেখে যেতে হবে কন্যার জন্য নয়। বিয়ের পর একজন নারী বাবার বাড়ি আর থাকতে পারবেনা কিন্তু পুত্র পারবে।

WHO বা ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেসান একটি গবেষণা চালায় যাতে উঠে এসেছে কি ভাবে একজন মেয়ে, শুধু মেয়ে হওয়ার জন্য প্রতি পদে হেনস্থা হয়।

১) জন্মের আগেই অত্যাচার (Pre-birth)গর্ভ ধারণ হওয়ার আগেই ঠিক করা হয় ছেলে না মেয়ে নিবে। ছেলে ভ্রূণ দিয়ে গর্ভ ধারণ করা হয় মেয়ে ভ্রূণ প্রত্যাখ্যান হয়।

আবার যদি গর্ভ ধারণ হয়েই যায় তবে সিটি স্ক্যান করে যদি দেখা যায় কন্যা তবে তাকে অ্যাবরসান করে ফেলে দেয়া হয়।

২) শিশু বয়স (infancy) মেয়ে শিশু জন্ম হলে মেয়ে শিশু টিকে এবং তার মাকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।

৩) মেয়ে বয়স (Girl hood)মেয়ে হয়ে জন্মানর জন্য তাকে পরিপক্ব না হওয়ার আগেই জোরপূর্বক বিয়ে দায় ।

৪) বড়ো হয়ে উঠার আগে কিশোরী বয়সঃ এসিড ছূড়া,ধর্ষণ করা, যৌন হেনেস্থা বা হয়রানী ,জোরপূর্বক পর্ন গ্রাফি করানো ,কাজ দেয়ার নাম করে নারী পাচার, স্বামী এবং স্বামীর বাড়ির মানুষ দ্বারা অত্যাচার, যৌতুকের শিকার, শারীরিক বা মানসিক ডিজাবেলেটি বা ভারসাম্য হীন কে ধর্ষণ এবং গর্ভধারণ করানো, ইচ্ছার বীরুদ্ধে  বার বার গর্ভ ধারণ বা গর্ভ পাত করানো।

একজন নারী যাকে দিয়ে মাতৃত্বের মাধ্যমে একটা শিশু পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয় ।একজন নারী যিনি কিনা একটা পরিবারের,সমাজের এবং দেশের ফাউন্ডেসান স্টোন ,যার মাধ্যমে দেশ গঠন হয় ,দুঃখজনক ঘটনা হল সেই নারীকে  জেনারেশন থেকে জেনারেশন ধরে তার উপরে অবিচার,  আর অন্যায় আচরণ করে অসন্মান করা হয়। তার প্রাপ্য সন্মান পায়না এই পুরুষ শাসিত সমাজ থেকে।

এখানে প্রথা হল একজন নারী মানেই বিয়ের মাধ্যমে সে তার স্বামীর ‘sabordinet’ অর্থাৎ স্বামীর ‘   ‘অধস্তন’ । এই সমান পজিসান না থাকা বা নিচু করে দেখার প্রথা একটা নারীকে মানুষ হিসেবে অবমূল্যায়ন করা হয়।

নীরবে অশ্রু ফেলা আমাদের নারী সমাজ এই অসহায়ত্ব নিয়ে জেনারেশন থেকে যেনারেসন নীরবে দুঃখ কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যা আমাদের দেশের জন্য একটা ট্র্যাজেডি।

প্রত্যেকটি পরিবার একেকটা মেয়ে কোন না কোণ রকমের সহিংসতার শিকার। সে মাই হোক আর মেয়ে হোক বা পুত্রবধূ হোক বা বিবাহিত স্ত্রী হোক।

যদিও নারী পুরুষের অধিকার রক্ষা করার কথা মানবিক অধিকার রক্ষা আইনে আছে কিন্তু বেশির ভাগ মেয়েই জানেনা এই আইনের কথা, জানেনা কোথায় গেলে  আইনি সহায়তা পাবে । এই অত্যাচার যে পুরো দেশের গ্রোথ কে অ্যাফ্যেক্ট করে তার খোঁজ কে রাখে। গর্ভধারণের মধ্য দিয়ে তারপর জন্ম হয়ে জীবনের প্রতি ধাপে এই নিষ্ঠুর সমাজ তাকে নিচু করে আর তারা ডিস্ক্রিমিনেসানের শিকার হয়।

নারী   এখানে সেকেন্ডারি সেক্স এবং সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন।

লেখক এবং গবেষকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, নারী ও শিশু উন্নয়ন এবং অধিকার কর্মি,লন্ডন,  UK

 

 

 

৬৫৩জন ৬৪১জন
0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ