নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কিছু কথা
শহরের আবহে বড়ো হওয়া রীতার, গ্রামীণ জীবন কেমন তা খুব কাছ থেকে এবং ভিতরে প্রবেশ করে জানার সুযোগ হয় ।
বাইরে থেকে আমরা জানি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সুন্দর দৃশ্যে ভরা একটা মোহময় জীবন। কিন্তু কজন খোঁজ রাখে কি ভাবে চলে এর মেকানিজম।এই সুন্দর দৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে কতো দুঃখ বেদনা আর কষ্ট আর যার বেশির ভাগেই মেয়েদের কপালে।
“কোন রণে কত খুন দিলো নর লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিলো সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে ” । অর্থাৎ মেয়েদের শ্রম দিয়ে এখানে পুরুষরা সম্পত্তি করে নাম হয় পুরুষটার নারীর নয়।
এই বাড়িতে আসার পর আস্তে আস্তে তাদের স্বভাব আর আচরণের ঝাঁপি উন্মোচন হতে থাকে। ইউনিভারসিটি শেষ করা রীতা এভাবেই বড়ো হয়েছে যে সে একদিন চাকুরী করবে। বাবা এমন ভাবেই তারা কে বড়ো করেছে।
সাধারণত দেখা যায় একটা মেয়েকে শাশুড়ী জ্বালায় কিন্তু এখানে শ্বশুর ব্যাক্তিটি কে মনে হচ্ছে কন্ট্রোলিং । বেচারা শাশুড়ী মা যেন জীবন্ত একটি সেবা দাসী। দেখতে দেখতে শাশুড়ি মা তার খুব ঘনিস্ট হয়ে উঠলো । রীতাও তার খুব কাছের হয়ে গেল ।রীতার কাছে জীবনের গল্পের এটা ওটা নানান সময়ে ঘটা বিষয় গুলো তিনি অকপটে বলতে থাকেন ।
রীতা জানতে পারে এখানে ঘোটে চলেছে কার্ল মার্ক্সের শোষণ সূত্রের থিওরি ।
এক শ্রেণীর শোষণ করা শ্রম দিয়ে উৎপাদন হয় , যার কোন বিনিময় মূল্য সে প্রয়োজনেও পায় না। আর একজন সম্পদের পাহাড় গড়ে। যেন মনে হয় সবই কর্তার কৃতিত্ব এবং তার একক পরিশ্রম। জমি জমা যতো আছে তার নামে সব কেনা।ফল স্বরূপ তার ক্ষমতাও অসীম । এর পেছনে যে আর একজন খাটছে সেটা উল্লেখ হয় না এবং টার বিনিময় মূল্যও পায়না । মেয়েটির অসুখে চিকিৎসা খরচ হয় না। জীবনের বেসিক প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন কাপড় বা শাড়ি যা দায় তা নিয়েই কৃতার্থ হতে হয়।তার উপর যে রোলার কস্টার চালানো হচ্ছে সেটা রীতার উপরও চালানোর পরিকল্পনা করেছিল শ্বশুর মসায়। ছলে বলে কৌশলে,মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করে,খারাপ ব্যাবহার করে রীতাকে অনেকবার কর্ণ গোচর করিয়ে ছিল, ‘ উপার্জন করে সব টাকা স্বামীর হাতে দিতে হবে। তোমার টাকা তোমার নয় ,তোমার পরিশ্রম লব্ধ টাকা আমাদের।কারন ছেলের টাকা দিয়ে তিনি অনেক জমি কিনেছেন এবং সেটা তিনি চালিয়ে যেতে চান। এটা তো দেখছি রীতিমত ডাকাতি।”রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি” ।
“জুলুমের কালে তুমি যদি নিরেপেক্ষ থাকো তাহলে তুমি জালিমের পক্ষেই নিয়েছ” আর্চবিশপ ডেসমন্ট টুটু
এর প্রতিবাদ করার সময় রীতার শাশুড়ি রীতার দিকে হয়েছিলো । সাহস দিয়ে ছিলেন তিনিই ।পায়ের তলে মাটি পেয়ে ছিল রীতা। একজন তার পক্ষে আছে।
রীতার যে চাকুরী টা একটি ইন্টার ন্যাসান্যাল ওমেন অরগানাইজেসানে । পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তাকে মিটিং এ যেতে হয় ।
লন্ডন আন্ডার গ্রাউন্ডের পিকাডেলি লাইন ধরে তাড়াতাড়ী আজকে রীতাকে যেতে হবে ওয়েস্টেমিনিস্টার টাউন হলে। প্রেজেনটেসান করতে হবে বিরাট এক গ্রুপের সামনে। ফ্লিপ চার্ট দিয়ে বোঝাতে হবে তার কাজের ধরন এবং অগ্রগতি । মেয়েরা কতখানি ভুক্তভোগী এইসব । তার সেই প্রেজেনটেসানে রীতা যে যে মেয়েদের কে রোল মডেল মনে করে উল্লেখ করেছিল, মেয়েদের এগিয়ে নেয়ার জন্য সাহস দেয়ার জন্য ,সেই লিস্টে সেদিন রীতা তার শাশুড়ির কথা উল্লেখ করে ছিল। শুধু অত্যাচারিত হওয়ার কথা নয় তার সাপোর্টের কথাটিও । লিস্টে থাকা নারীরা ছিল প্যাঙ্কহ্রাস্ট (Emmeline Pankhurst), Emily Davison, Epsom Derby, Margaret Benston, Maria Mies আর তার শাশুড়ি।
গ্রামে গঞ্জে বাড়িতে বাড়িতে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দায়িত্ব পেয়ে রীতা আজ একজন পরিচিত ব্যাক্তিত্ব । মেয়েরা তাকে সমীহ করে। রীতার কাজ এখন চিন্তায় চেতনায় কি ভাবে পৃথিবীর সব নারীকে অসহায় অবস্থা থেকে তুলে আনা ।
নারীর ক্ষমতায়ন
শক্তিশালী অর্থনীতি গোড়তে হলে দরকার সবার অংশ গ্রহণ । যা মেয়েদের বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।তাই প্রত্যেকটি সেক্টরে মেয়েরাকে ইনভল্ব হতে হবে । অংশ গ্রহণ করতে হবে কাজে । যাকিনা একজন মেয়েকে আত্মবিশ্বাসী করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। নারীর ক্ষমতায়ন রাজনীতিতে ,অর্থনীতিতে এবং সমাজে এক বিরাট ভূমিকা রাখে।
সন্তান লালন পালন এবং বড়ো করার দায়িত্ব স্বামী স্ত্রী উভয়ের । এই দায়িত্ব দুজনকেই ভাগাভাগি করে নিতে হবে।এবং দুজনকেই ইনকাম করতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই নারীর জীবন ঝুঁকি পুর্ন কারন সুস্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ক্ষমতা তাদের হাতে নাই।
বেশির ভাগ দেশে নারী পুরুষের চেয়ে শিক্ষায় পিছিয়ে। এমনকি তাদের ফর্মাল এডুকেসানও নাই । মেয়েদের যে সক্ষমতা আছে, জ্ঞান আছে, তা অনেক সময় রেকগনাইজও করা হয়না।
সময় এসেছে এই সব স্থান গুলো রিকগনাইজ করা এবং তার পরিবর্তনের । দরকার নুতুন পলিসি প্রনয়ন এবং প্রোগ্রামের ধারা পরিবর্তনের। যা দিয়ে একজন নারী ঘরে এবং বাইরের জগতে সমান ভাবে অংশ গ্রহণ করতে পারে। যার জন্য দরকার ম্যাস কমুনিকেসান ।
‘Everyone has the right to education’
৪০ বছর আগে ইউনাইটেড ন্যাসান থেকে এই ঘোষণা আসে।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে একটা দেশের উন্নতির জন্য একটা অংশকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। শিক্ষাই হল সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় যা দিয়ে নারীকে ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। যা দ্বারা একজন নারীর জ্ঞান, কর্ম দক্ষতা, এবং আত্মবিশ্বাসবৃদ্ধি পায়।
১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স’ এর মিটিঙে সমস্ত দেশের প্রধানরা একমত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই ব্যাবস্থা কার্জকরী করার জন্য নীতি নির্ধারণ করার।
সারা বিশ্বে ৯৬০ মিলিয়ন অক্ষর জ্ঞান হীন মানুষ আছে তার তিন ভাগ্যের দুই ভাগ নারী। তিন ভাগের এক ভাগ বয়স্ক মানুষ যাদের কোন অক্ষর জ্ঞান নাই এবং তার বেশির ভাগ বয়স্ক নারী। ১৩০ মিলিয়ন ছেলেমেয়ে যারা কিনা প্রাথমিক স্কুলেও যায়নি। তার ৭০% মেয়ে শিশু।
ইউনাইটেড ন্যাসান দ্বারা শিক্ষা বিস্তারের জন্য রেগুলেসান পাস যা প্রত্যেক দেশ কে মানতে হবেঃ
১) যতো শীঘ্র সম্ভব নারী পুরুষের ব্যাবধান দূর করার পলিসি গ্রহণ করে নারীর শিক্ষার ব্যাবস্থা করা।
২) সরকারকে নুতুন মেকানিজমের ব্যাবস্থা করে মেয়েকে সমান সুযোগের ব্যাবস্থা দিয়ে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্ম কাণ্ড,সমাজ এবং পাবলিক জীবনে অংশ গ্রহণের ব্যাবস্থা করতে হবে এবং নারীর সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে তাতে অংশ গ্রহণের জন্য।
৩) নারীর যে যোগ্যতা আছে তাকে জাগ্রত করতে হবে এবং তাদের শিক্ষা বিস্তার স্কুলের উন্নয়ন এবং কাজে যোগদানের ব্যাবস্থা করে তারাকে উপার্জন ক্ষম বানাতে হবে। যা দিয়ে একজন নারী অজ্ঞতা দূর করে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হয়ে দুর্বলতা আর দুরভ্যগ্য থেকে রক্ষা পাবে।
৪) একজন নারীকে ডিসক্রিমিনেসানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যতো রকমের চর্চা আছে সমাজে সে গুলো বন্ধ করতে হবে।
৫) নারীর ইনকাম বৃদ্ধি করার জন্য পলিসি গ্রহণ করতে হবে। যাতে তারা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে শক্তিশালী হতে পারে।
৬) সোশ্যাল সিকিউরিটি সিস্টেম থাকতে হবে।
৭) চাকুরী দাতার ডিসক্রিমিনেসান বন্ধ করতে হবে
৮) এনন আইন থাকতে হবে যাতে তারা বাচ্চা জন্মদানের সময় এবং শিশু বয়েসে লালন পালন করার সময় পায়।
৯) পরিবার পরিকল্পনার ব্যাবস্থাদি হাতের নাগালে আনতে হবে।
১০) নারী নির্যাতন বন্ধ্যে কঠোর আইন পাস সহ বিনাপয়সায় আইনি সেবা থাকতে হবে।
১১) স্কুল, ক্লিনিক , সেবা প্রতিস্টান, হসপিটালে লিফলেট রাখতে হবে । প্রচুর প্রচারণা চালাতে হবে মিডিয়ার ব্যাবহার দিয়ে।
রীতা যখন প্রচার চালায় তখন সে বেস কিছু তার প্রিয় স্লোগান ব্যাবহার করে আর তা হলঃ ১) মেয়েরা শিক্ষিত হলে দেশ আলোকিত হয়।২) মেয়ের জন্ম হয় তাকে সন্মান দেয়ার জন্য ধর্ষণ করার জন্য নয়। ৩) হাসিখুশি মেয়ে মানে হাসি খুশি পরিবার ৪) একজন নারী শিক্ষিত হলে ভীত হয়না ৫) একটা দেশের নারীরা যখন শক্তিশালী তার মানে সেই দেশ টাই শক্তিশালী ।
রীতা পরিপূর্ণতা পায় যখন নারীকে ক্ষমতায়নের জন্য সে কিছু করতে পারে।
লেখক ও গবেষকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস , নারী ও শিশু অধিকার কর্মি ,লন্ডন।
২টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
ভালো লাগলো। সবচেয়ে বড় কথা, আমি অনেক জায়গায় দেখেছি। একজন নারী, আরেক নারীর কাছ থেকেই অত্যাচারিত হয়। নারীর ক্ষমতায়ন এর সাথে সাথে, আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
নার্গিস রশিদ
সঠিক মন্তব্য আপু। অনেক কিছু করার আছে । যেমন স্কুল থেকেই মেয়েদের কে শেখানো উচিৎ জেন্ডার ইকুইলিটি । চারদিকে প্রচুর লেখা লেখি দরকার । সর্বোপরি সরকার থেকে নিয়ম নিতি বানানো এবং মসজিদের ইমাম দ্বারা প্রচার চালানো । একজন মা যদি সচেতন হয় তবে পরিবার থেকেই সন্তান শিখতে পারে। কিন্তু অনেক মাই পক্ষপাত দুষ্ট ।