
প্রতি বছরই নিয়ম করে লাল মুনিয়ার ছবি তুলতে উত্তরা যেতাম। বরাবরই সঙ্গী ছিল বণ্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আদনানের সঙ্গে উত্তরায় ছবি তুলছিলাম। এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় মডেল, ফটোগ্রাফার আরিফ আহম্মেদ ও বার্ড ফটোগ্রাফার চপল ভাই। ছবি তোলার ফাঁকে আমরা সবাই চা-পানের জন্য একটি টঙের দোকানে গেলাম। চা পান শেষে আদনান বলল, নির্মাণাধীন দালানের পাশে একটি লেক আছে। আমরা সবাই লেকের ধারে গেলাম। হরেক প্রজাতির মাছখেঁকো পাখি সেই লেকে বিচরণ করছিল। বেশ কিছু পাখির ছবি তুলছিলাম।
এমন সময় বাঁশের খুঁটিতে একটি পাখি বসা ছিল। আদনান আমাকে বলল ছবি তুলতে। এটি আমাদের দেশে বিরল আবাসিক পাখি। আমরা সবাই পাখিটির ছবি তুললাম। পরে আদনানের কাছে পাখিটির পরিচিতি জানতে পারি- এটি পাকড়া খঞ্জন বা সাদা-ভ্রু খঞ্জন।
White browed Wagtail বা পাকড়া খঞ্জন Motacillidae পরিবারের অন্তর্গত ২১ সে.মি. দৈর্ঘ্যের ও ৩০ গ্রাম ওজনের একটি ভূচর পাখি। এদের দেহের উপরের দিক কালো, আর পেটের দিকটা সাদা। চোখের উপরে ভ্রুর জায়গাটিও সাদা। কাঁধে সাদা ডোরা রয়েছে। লেজের বাইরের দিকের পালকগুলোও সাদা। পাখিটি বেশ হালকা-পাতলা গড়নের, এছাড়া আছে লম্বাটে চটপটে লেজ। এর ঊর্ধ্বাঙ্গ, মাথা এবং বুক লম্বাটে এবং বৃহৎ সাদা ডানা। সাদা খঞ্জনের মতো এদের মাথার চূড়ায় সাদা রং নেই। শরীরের নিম্নাংশের বাকিটুকু সাদা।
স্ত্রী পাখির শরীরের রঙ, পুরুষের তুলনায় কিছুটা হালকা। অপ্রাপ্ত বয়সে স্ত্রী পাখিরা বাদামি-ছাই রঙের হলেও প্রাপ্তবয়স্ক হলে কালো রঙ ধারণ করে। দলে সাধারণত দুটি পাখি থাকে। এদের লেজ লম্বা। পা, ঠোঁট, গলা ও বুক কালো রঙের; নিচের দিক সাদা পালকে আবৃত থাকে। চোখের ওপরের ভ্রু সাদা। ডানায় সাদা রেখা থাকে, লেজের বাইরের পালক সাদা।
বাংলাদেশে Motacilla গণের পাঁচ প্রজাতির খঞ্জনপাখি দেখা যায়। পাঁচ প্রজাতির মধ্যে চার প্রজাতির খঞ্জন শীতের শুরুতে আসে এবং গ্রীষ্মে চলে যায়। শুধু দেশে স্থায়ীভাবে বাস করে ও বাসা বাঁধে সাদ-ভ্রু খঞ্জন। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে দেশে সাদা-ভ্রু খঞ্জন সংখ্যায় খুব কম এবং এরা মানুষের অবাধ পদচারণার কারণে বাসা করার জন্য কোনো নিরাপদ জায়গা পায় না। ঢাকার চারপাশে ক্রমাগত জলাশয় ভরাট করে ফেলায় এদের স্বাভাবিক আবাস হারিয়ে গেছে। এরা নদীর পাড়, বড় পুকুর ও বড় জলাশয়ের কাছাকাছি কোনো জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। তবে নগরের পরিবেশেও এরা খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
খাবারের জন্য এরা চষে বেড়ায় এবং একটু পরপরই ডেকে ডেকে জায়গা পরিবর্তন করে। খাবারের তালিকায় আছে ফড়িং, পোকামাকড়, ছোট শামুক ইত্যাদি। এদের প্রজননকাল মার্চ থেকে মে মাস। প্রজননকালে জলাশয়ের কাছাকাছি নিরাপদ জায়গায় বাসা বানায়। এদের বাসার আকৃতি গোলাকার কাপের মতো। চটের আঁশ, শুকনো ডালপালা, নরম ঘাস ইত্যাদি জড়ো করে বাসা তৈরি করে। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখিটি ৩/৪টি ডিম পাড়ে। দুজন মিলেই সংসার করে ও বাচ্চাদের পরিচর্যা করে।
সাদা ভ্রু খঞ্জন বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে পাওয়া যায়। এছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
বাংলা নাম: পাকড়া খঞ্জন বা সাদা ভ্রু খঞ্জন
ইংরেজি নাম: White browed Wagtail
বৈজ্ঞানিক নাম: Motacilla maderaspatensis (Gmelin 1789)
১৩টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
নদীর নাম অঞ্জনা, নাচে সেথা খঞ্জনা সখি লো।
সেই পাখি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। পাখি এবং তার অজানা তথ্য জানলাম।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো আপু।
ইঞ্জা
সাদা ভ্রু খঞ্জনা, খুব সুন্দর নাম পাখিটি যেমন সুন্দর।
আমার মনে হয় অনেকেই একে দেখে দোয়েল মনে করতে পারে, যেমন আমি করেছিলাম।
অসাধারণ বর্ণনায় তার জীবনাচরণ সম্পর্কে খুব সুন্দর বিশ্লেষণ পূর্বক লিখলেন ভাই, খুব ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ভাই।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো ভাই।
ইঞ্জা
ভালোবাসা জানবেন ভাই। 💕
তৌহিদ
ইয়া মাবুদ! আমিতো ভেবেছি দোয়েল! দেখতেয়ো একইরকম মনে হচ্ছে। খঞ্জন এর নাম আজই জানলাম।
আপনি ব্লগে না থাকলে এই অধমের পাখিজ্ঞান শুন্যই থেকে যেতো ভাইজান। সাধুবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই আপনাকে।
চমৎকার এবং শিক্ষণীয় লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
ঠিকই বলেছো ভাইয়া। যে কেউ প্রথম দর্শনে দোয়েলই মনে করে। তবে দোয়েলের পিঠের উপরি ভাগ কারো বুকটা সাদা। ধন্যবাদ ও ভালোবাসা অহির্ণিশ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমিও ভেবেছি দোয়েল দেখতে একদম সেরকমই।
শুভ কামনা পাখি ভাই। ভালো থাকবেন।।।।
শামীম চৌধুরী
শুধু আপনি না আপু্। আমরা যারা বার্ড ফটোগ্রাফী করি তারাও দূর থেকে দোয়েলই মনে করি।
শুভেচ্ছা জানবেন।
পপি তালুকদার
সাদা ভ্রু খঞ্জনা সত্যি দারুণ নাম।পাখিটি সম্পর্কে জেনে ভালো লাগলো। তবে পাখিটি দেখতে দোয়েল পাখির মতো আমার কাছে তাই মনে হয়।।
বিভিন্ন পাখি সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিয়ে অনেক অনেক উপকার করছেন।কতো কিছু যে জানা ভেবে অবাক হই।
ধন্যবাদ সুন্দর পোষ্টের জন্য।
শামীম চৌধুরী
আপনাদের জানাতে পেরে নিজের কাছে খুব ভালো লাগে।
আপনার জন্য শুভকামনা রইলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খঞ্জনা নামটি দারুন ভাইয়া। সাথে সাদা ভ্রু যুক্ত হওয়ায় আরো মজা লেগেছে নামটি মনে রাখার দারুন উপায়। বার্ড ফটোগ্রাফিতে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন
শামীম চৌধুরী
অনেক অনেক শুভকামনা রইল দিদিভাইয়ের জন্য।