আমার একটা আকাশ খুঁজি…

রিফাত নওরিন ২৩ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ০৫:৩৭:১২অপরাহ্ন গল্প ৮ মন্তব্য

হাতের কাছের হ্যান্ডব্যাগটাতে যা পেলাম তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিলাম,
দুটো জামা, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ আর হালকা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস।
অনেক তো হলো, অপমান আর কত সহ্য করা যায়
এক জীবনে, এবার না হয় চলি।
এইভেবে চোখদুটো মুছে আমি বেরিয়ে পরলাম।
গাড়ি চালিয়ে বাড়ি থেকে ঘন্টাখানেক দূরে এসে
জে-মারফি পার্কটাতে এসে বসলাম।

না চাইতেও এলোমেলো বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো মনের মাঝে ঘুরতে লাগলো বারবার…
সেই বহু পুরোনো দিনের ঘটনাগুলো হুড়মুড় করে চোখের সামনেই ভেসে উঠতে লাগলো ।
আজ দুদিন ধরেই আরিফের সাথে ঝগড়াগুলো দানা বাঁধছ প্রচণ্ড ।
প্রতিদিন টুকটাক কিছু লেগেই যায়, বেশীরভাগ সময়ই চুপ করে থাকি আমি কিন্তু আর কত সহ্য করা যায় ।

আরিফ কি বরাবরই এমন ছিলো ?
– ভাবতে বসি আমি , মনের ছবিগুলো যেনো ভেসে আসে
ঠিক যেনো স্বপ্নের মতো করে, সেই যে বাবার পছন্দে বছর বিশেক আগে আরিফের সাথে বিয়ে হয়ে গেলো আমার ।
– বলা নেই, কওয়া নেই একদিন হুট করে সন্ধ্যাবেলায় বাবা আরিফকে বাসায় নিয়ে আসলেন, আর বললেন, তমা তৈরী হয়ে নে মা, আজ তোর বিয়ে ।
– বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি, সবসময় জেনে এসেছি লক্ষী মেয়েরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হয় না।
এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলাম আমিও, তার মধ্যে ছিলাম বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
না করতে পারতাম না তাদের, তাই আরিফের সাথে বিয়েটা আমার
হয়ে গেলো ।

বিয়ের পরের সময়গুলো যেনো হাওয়ায় ভর করে ফানুস হয়ে উড়ছে, সে একটু চুপচাপ স্বভাবের ছিলো কিন্তু তবুও তাকে প্রচণ্ড ভালবাসতাম।
আমাদের সুখী সংসারে আনন্দে কানায় কানায়
পূর্ন ছিলো, যা আরও বেড়ে গেলো যখন আমি ডিভি লটারিটা পেয়ে গেলাম।

জামাই-বৌ সব প্রসেস শেষ করে আমেরিকায় আসলাম,
আমিতো ভীষন খুশি, আমেরিকা আহ্ কি শান্তি আর সুখের, এই ভাবনাটা বদলাতে আমার দুদিনও লাগেনি।
কথা ছিলো এখানে এসে বছর দুয়েক একটু থিতু হয়ে পড়াশুনাটা শুরু করবো আমি ।
– কিন্তু বছর না ঘুরতেই আমি প্রেগন্যান্ট, প্রচন্ড অসুস্থ হওয়ায় সুপার স্টোরের চাকুরিটাও ছাড়তে হলো।
আরিফ তখন গ্যাস স্টেশনে চাকুরি আর পাশাপাশি নিজের এম.বি.এ ডিগ্রিটা নেওয়ার জন্য পড়াশুনায় বেশ ব্যাস্ত।
আমাকে সময় দেওয়া নিতান্তই অসম্ভব তার কাছে।
হয়তো আমাদের মাঝের দূরত্বের সেই শুরু ।
তবুও আশায় বুক বাঁধতাম আর স্বপ্ন দেখতাম স্বামী, সন্তান আর সুখের একটা সংসার ।

এভাবেই সময়
গড়াতে লাগলো, আমার প্রথম সন্তান তিথি
যেদিন জন্মালো আমার খুশি আর দেখে কে, এতোদিন পরে যেনো নিজের এক টুকরো অবলম্বন
পেলাম ।
যদিও তার ঘরের বাইরে থাকাটা আরও বেড়ে গেলো,
এরি মধ্যে সে খুব ভালো একটা কোম্পানীতে চাকুরি পেলো।
ভেবেছিলাম তিথি একটু বড় হলে আমি পড়াশুনাটা আবারও
শুরু করবো, কিন্তু সন্তানকে কার কাছে রেখে যাবো, তাদের পিতার ব্যাবহার বাইরের মেহমানদের চেয়ে খুব বেশী কিছু না।
তার মধ্যে যে কয়দিন বাসায় থাকে ঘরে সবসময়ই অশান্তি লেগে থাকে,
সংসার ও সন্তানের প্রতি যেনো তার কোন দায়িত্বই নেই, সব একা হাতে সামলাচ্ছি আমি ।
কতবার ভেবেছি আমি দেশে
চলে যাবো।

মা যতদিন ছিলেন আমাকে বলতেন-
মারে ধৈর্য ধর, আল্লাহকে ডাক,
পুরুষ মানুষতো, যা কিছুই করুক তুই চুপ করে থাকিস ।
তোর সন্তানের জন্য হলেও সবকিছু মেনে নিস।
আসলেই, মেয়ে মানুষের নিয়তি বলে কথা, মেনে নাও, মানিয়ে নাও।
তবুও তখন মাকে বলে মনের দুঃখ কিছুটা ভুলতে পারতাম, কিন্তু বাবা-মায়ের মৃত্যুর
পর যেনো নিঃশ্বাস নেওয়ার শেষ আশ্রয়টুকুও শেষ হয়ে গেলো ।

তবুও ভালো থাকার চেষ্টা করতে হয় অবিরাম আমাদের, এভাবে সময় গড়িয়ে যায়, তিথিকে পাঁচবছর বয়স থেকে স্কুলে দিয়ে আমিও একটা ছোটখাট চাকুরি শুরু করে দিই।
আমাদের মা-মেয়ে মিলে আমাদের জীবনটা অনেক পূর্ন এখন।

আর আরিফ, মাঝে খুব খারাপ একটা অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার পর বাসাতেই থাকে এখন,
ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে ছোটখাট একটা চাকুরি করে।
সারাদিন বাসায় থাকলেও সে থাকে
তার মতো, আমাদের সম্পর্কের সুতোটা কোথায় যেনো কেটে গিয়েছে।

মেয়ের স্কুল, অ্যাকটিভিটি ক্লাস আর আমার অফিস সব মিলিয়েই চলছে আমার ।

গতকাল তিথির জন্মদিন ছিলো, আহ্ সুইট সিক্সটিন, মেয়ের আবদারে সব পরিচিত বাঙালী পরিবারকে দাওয়াত করেছিলাম আমার বাসায় ।
সারাদিন রান্না করে, মেহমানদারী করে কাহিল আমি বয়স হচ্ছে তো এতো ধকল আর নিতে পারিনা।

মেহমানরা সবাই চলে গেলে খাবারগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিয়েই আমি শুয়ে পরলাম।
সকালে ঘুম ভেঙে উঠতেই শুনি আরিফের চিৎকার চেঁচামেচি, আমি নাকি অলস, কিচ্ছু করিনা
রাগে মাথাটা ধরে আসলো ।

রুম থেকে বের হতে গিয়েই মেয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো, তার বাবার খুব বাজে ব্যবহারে এতোটা অপমানিত আগে কখনো হইনি আমি, মনে হচ্ছিল আসলেই আমি অপরাধী।
চোখ ফেটে জল চলে আসলো, এরপরই আমি চলে আসলাম।

এলোমেলো ভাবনাগুলো শেষ হলে হাতঘড়িটা তুলে দেখি বিকেল পাঁচটা বাজে।
ঘরের কথা মনে পড়ে যায় আমার, ইস্ এতোটা বেলা হয়ে গেলো।
তিথি নিশ্চয় এখন ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে আসলো।
হঠাৎ করে মনটা আমার কেঁদে উঠলো, আহারে মেয়েটা আমার, খাওয়া দাওয়া কিছু হয়েছে কিনা জানি না, যদিও সে এখন যথেস্ট বড় হয়েছে তবুও মায়ের মন বলে কথা।

মাথার উপরে নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখি আর ভাবি,
“আমার একটা
আকাশ কোথায় যে খুঁজে পাই..
একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা কোথায় পাই”…

তোমরা বলবে ঘর ছেড়ে চলে আসো, কিন্তু আসলেই
কি তা করা যায় ।
মেয়ের মা তো আমি,
আজ যদি তিথির কাউকে ভালো লাগে, সে যদি
একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়েকে গ্রহন করতে না চায়?
তাহলে ?

আমার জীবনের বেশ অর্ধেকটা সময় তো চলে গেলো, আর কদিন বাঁচবো, মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে হলেও কাটিয়ে দিই বাকিটা জীবন।
হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে,আমি এবার বাড়ির
পথ ধরি..
পেছনে পরে রয় দুচোখের নোনাজলে, ভিজে থাকা সেই জনপথ।

~ রিফাত নওরিন
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র

৬৬৯জন ৬৬৯জন
0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ