পৃথিবীর পথে পথেঃ ইস্তাম্বুল, তুরস্ক,সাল ২০১৫ (ভ্রমণ কাহিনী )
‘সেন্টার অব আর্থ’ বা ‘সেন্টার অব ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ‘ ।
হ্যাঁ সেই ‘সেন্টার অব আর্থ ‘ অর্থাৎ তুরস্কের কথায় বলছিলাম ।
একটা সুন্দর ঝলমলে বিকেলে এসে ল্যান্ড করলো আমাদের প্লেনটি । বেশি দূরের পথ নয় ।মাত্র তিন ঘণ্টা লাগে লন্ডনের হিথরো রিসোর্ট এর জানালা দিয়ে দেখা বসবরাস
রপোর্ট থেকে ইস্তাম্বুল আসতে।মিনার হাগিয়া সফিয়া মসজিদ
বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ছয় গুন বড়ো ।লোক সংখ্যা মাত্র দেড় মিলিয়ন । এতো কিছু দেখার আছে যা একবারে কভার করা সম্ভব নয়। ‘ইজি জেট’ এবং ‘রাইনো এয়ার’ এর কল্যানে খুব কম খরচে এখানে আসা যায়। যার ফলে টুরিস্ট ব্যাবসা বর্তমানে একটা বুমিং ব্যাবসা।
আমাদের রিসোর্ট টি বসপরাস এর কাছে । তাই রিসোর্ট এর ছাদে ছাউনির নিচে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে বসপোরাস প্রণালীটি দেখা যায়।
সকালে ফজরের আজান শুনে ঘুম ভাঙলো ।তাও আবার ইস্তাম্বুলের ‘হাগিয়া সফিয়া’ থেকে আসা আজানের ধ্বনি । আজকে যাবো সেই ঐতিহাসিক ‘হাগিয়া সফিয়া’ মসজিদ দেখতে।
হাগিয়া সফিয়া
হাগিয়া সফিয়া
আমাদের পরিবার টিম রওনা দিলাম একজন গাইডের তত্তাবধানে। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত ‘হাগিয়া সফিয়া’ মসজিদ। আমাদের টার্কিশ ইংলিশ স্পিকিং গাইড দেখাচ্ছে এবং বলে চলেছে এর ইতিহাস।
+প্রথমে চার্চ
+তারপর মসজিদ
+ তারপর মিউজিয়াম
+ বর্তমানে পুনরায় মসজিদ
চার্চের ছবি মুছে ফেলে ইসলামী চিহ্ন লেখা হয়
৩২৫ সালে কন্সট্যানটাইন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কিন্তু ৪০৪ সালে আগুনে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। রোমান ইম্পেরার constans ১ , আবার ঠিকঠাক করেন। ৫৩২ সালে আবার পুড়ে যায় । তারপর jastinian ১ পুনরায় তৈরি করেন।
অটোম্যান ইম্পেরার টার্কিশ সুলতান ‘মেহমেদ’ ভিতরে নামাজ পড়ানোর জন্য মিনারাত বানান, বাইরে চার দিকে চারটি মসজিদের চিহ্ন ‘মিনার’ বসান । ভিতরে সিলিং এ একটি বিরাট স্যান্দেলিয়ার লাগান। এবং খুতবা পাঠ করার জন্য ‘মিনবার’ বসিয়ে একটি মসজিদে রূপান্তর করে নামাজ আদায় করেন। চারদিকে দেয়ালে এবং সিলিঙে যত খৃস্টান ধর্মের ছবি ছিল তা প্লাস্টার দিয়ে কভার করে দেন।
কামাল আতারতুক ১৯৩৪ সালে সেকুলার সরকার চালু করেন এবং এটাকে মিউজিয়াম বানান। কিন্তু ২০২০ সালে আবার বর্তমান সরকার এটাকে মসজিদ হিসাবে ব্যাবহার করার নির্দেশ দেন এবং নামাজ আদায় করেন। তবে দলে দলে সব ধরনের,সব দেশের এবং ধর্মের টুরিস্ট এই স্থাপনা দেখতে আসছে। কোথাও কোথাও প্লাস্টার সরিয়ে বেরিয়ে আসছে খ্রিস্টান ধর্মের মেরী, যীশু এদের ছবি।
কাছাকাছি একই এলাকায় আছে Hagla irene অরথাডেক্স চার্চ , ব্লু মস্ক (Blue Mosque)এবং সুলতান আহমেদ মস্ক । যা ১৬১৬ সালে নীল রঙের টাইলস দিয়ে তৈরি । যার ১৩ টি ডোম আর ৬ টি মিনার আছে ।
টপকাপি প্যালেস
তপকাপি চত্বরে মিশরীয় মিনার এনে স্থাফন,কারন এক সময়ে মিশর অটোম্যান দের দখলে ছিল ।
হাগিয়া সফিয়া দেখার পর রওনা দিলাম টপকাপি প্যালেস দেখার জন্য। বিরাট লম্বা কিউ পাড়ি দিয়ে টিকিট কিনে রওনা দিলাম অটোম্যান ইমপ্যায়ার এর সুলতান দের ‘টপকাপি প্যালেস’ দেখার জন্য । আমাদের গাইড আগে আগে যাচ্ছে আমরা তাকে ফলো করছি। এতো বিশাল প্যালেস কোথায় কি হত তা সঠিক ভাবে জানতে অভিজ্ঞ গাইড দরকার।
অটোম্যান পিরিয়ডে ৩০ জন সুলতান ৬ শত বছর ধরে এখান থেকে শাসন কার্জ পরিচালনা করেছেন। মেহমুদ ২ এর সময় ১৪৫০ সালের শেষ দিকে এর নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয় এবং বসবাস আরম্ভ হয় ১৪৭৮ সালে।
১৪৫৩ সালের ২৯ সে মে অটোম্যান ইমপেরার, বাইজেনটাইন অর্থাৎ ইস্টার্ন রোমান সাম্রাজ্যের পতন করে । তখন ইস্তাম্বুলের নাম ছিল কন্সটানটিনপেল । মেহমুদ ২ এখানে থেকে তার রাজত্ব পরিচালনা আরম্ভ করেন।
ইসলামিক এবং ইউরোপিয়ান আর্কিটেকচারের মিশেলে এর নির্মাণ কাজ । হেরেমের ৩০০ নারী সহ ১০০০ থেকে ৪০০০ মানুষ এখানে বাস করতেন।
চার দিকের উঁচু দেয়াল দেয়া চারটি কোর্ট ইয়ার্ড সহ অনেক ঘর সহ এই প্যালেস । একেক কোর্ট ইয়ার্ডে একেক কাজ পরিচালনা হত । প্রধান গেটের সামনে নানা রকমের প্রসেসান,জনসেবা এবং সিরমনি অনুষ্ঠিত হত। একে বলা হয় আউটার কোর্ট ইয়ার্ড ।
দ্বিতীয় কোর্ট ইয়ার্ডে শাসন কার্জ পরিচালনা হত। অফিসার এবং ভিজিটার আসতো এবং সুলতান গ্রিল দেয়া একটা ঘরে বসতেন এবং তাদের কথা শুনতেন। ভাইজার মিটিং পরিচালনা করতেন। এই কোর্ট ইয়ার্ডে বিরাট কিচেন বা রান্না ঘর। সেখানে রাখা আছে রানায় ব্যাবহ্রিত বড়ো বড়ো ডেকচি, হাতা ,থালাবাসন,পরিমাপে দারীপাল্লা আর ওজন করার পাথর।সে এক এলাহি কাণ্ড। প্রতিদিন ১০০০ মানুষের জন্য রান্না চলতো ।
তারপরের ইয়ার্ডে মিউজিয়াম সেখানে রাখা হত নানান দেশ থেকে আসা উপঢৌকন । তারপরে লাইব্রেরী ,অন্দর মহল ,বাগান, আর হেরেম ।হেরেমে ৪০০ ঘর আছে সেখানে কংকুবাইন ,রাজমাতা, রানী, ছেলেমেয়ে এবং চাকর বাকর বাস করতো।
১৯২৪ সালের ৩য় এপ্রিল সুলতানি আমলের অবসান হয় এবং কামাল আতারতুর্ক এই প্যালেসকে মিউজিয়াম ঘোষণা করেন।
এই ছিল টপকাপি প্যালেসের ইতিহাস।
সুলতাম মেহমুদ
তপকাপি প্যালেসের প্রধান ফটক
ইস্তাম্বুল
কারা এই টার্কিশ । কোথা থেকে তাদের আগমন ।
১৩থ সেঞ্চুরির শেষের দিকে তুরকিক নেতা ওসমান ১ ,সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে এসে তৎকালীন অ্যানাতালিয়ার (যাকে বর্তমানে তুরস্ক বলা হয়) উত্তর পশ্চিম শহর বেলসিক প্রদেশ দখল করেন। তারপর ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা বিস্তার করতে থাকে । সে সময় তুরস্ক বাইজেন্টাইন দের (রোমের পূর্ব দিক ) দখলে ছিল । ১৪৫৩ সালে মেহমুদ ২ বাইজেনটাইন দখল করেন।
তার আগে তুরস্ক প্রথমে গ্রীসের দখলে ছিল তারপরে ইটালির দখলে । তুরস্ক কখনো গ্রীস কখনো ইটালির দখলে ছিল।
ইস্তাম্বুলে তাই দুই দেশের অনেক স্থাপনা দেখা যায়। শুধু ইস্তাম্বুল নয় পুরো তুরস্কে এই দুই দেশের অনেক ঐতিহাসিক চিহ্ন ছড়িয়ে আছে।
বর্তমানে পুরো তুরস্কের ৩০% অর্থনীতি ইস্তাম্বুল কেন্দ্রিক । এবং ব্যাবসা বাণিজ্য কালচারের সেন্টার।
বসপরাস ক্রুজ, ডিনার ফোক এবং সুফি ড্যান্স
সূফী ড্যান্স ক্রুজের প্রধান আকর্ষণ
আমাদের ক্রুজ শিপ
এটি ছিল ইস্তাম্বুল ভ্রমণের একটা আনন্দের বিষয় । প্রত্যেক হোটেল থেকে আগে বুকিং দেয়া টুরিস্ট সংগ্রহ করে হোস্ট নিয়ে চলল বসপরাস ক্রুজে। রাতের দুইপারের প্রধান প্রধান স্থাপনা দেখা এবং তার সাথে ডিনার আর ড্যান্স । খুব অরগানাইজ ছিল পুরো ব্যাপারটি । হোস্ট সব গেস্ট কে কথা দিয়ে মজিয়ে রাখতে ওস্তাদ ছিল। প্রত্যেক টেবিলে সবায় যে যার মতো বসে গেলো । গেস্ট যে দেশের সেখান কার ফ্লাগ এবং টার্কিশ ফ্লাগ টেবিলে টেবিলে দিয়ে গেলো। উদ্দেশ্য তোমরা তুরস্কের ফ্রেন্ড। আমাদের টেবিলে এসে গেলো বাংলাদেশের ফ্লাগ আর তুরস্কের ফ্লাগ। আইডিয়া টি বেশ মজার ছিল।
তারপরে খাবার সার্ভ । খাবারের সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো তুরস্কের আঞ্চলিক বিয়ের ড্যান্স । ছোটো খাটো একটা গল্প কে ড্যান্স ড্রামা দিয়ে ফুটিয়ে তোলা । এই ড্যান্স শেসে সুফি ড্যান্স । দুটো আইটেমেই ছিল প্রফেসনাল আর্টিস্ট দিয়ে করা ।যা ছিল এক কথায় চমৎকার । আমাদের দেশ ট্যুরিজম প্রমট করার জন্য এই আইটেমটি করতে পারে ।
লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস ,লন্ডন
একটি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
তুরস্কের একটা সিরিয়াল দেখেছিলাম টিভিতে। ঐতিহ্য বাহী তুরস্কের সংস্কৃতি ভালো লেগেছিল। আপনার লেখা পড়ে তুরস্ক সম্পর্কে আরো জানা হলো।