
বছর খানেক হলো দেখা নেই। কথা নেই, শুনতে পায়না তার সুমধুর কন্ঠ অনেক দিন হলো। বুকের ভেতরটা তখন থেকেই খালিখালি লাগে। প্রদীপ জ্বলা নিভে গেছে চিরতরে। সূর্যমুখী মুখ স্মৃতির পাতায় এসে মাঝেমাঝে এসে হানা দেয়। টানতে থাকে, হাসতে থাকে, একাধারে কথা বলতে থাকে, আরও কতকিছু করতে থাকে। তখন বুকটা এতো সুখের ভিড়ে আরও বেশি করে কাঁপতে থাকে। আনমনা, অবুঝ হৃদয় শুধু তাঁরই কথা বলে। না ফেরার দিনগুলো প্রতিবারই এসে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে যায়।
আমি সুখে আছি। তবে কেন যেন মাঝেমধ্যে বুকের ভেতরটা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এটা কি হারানোর ব্যাথা নাকি প্রিয়জনের শোক? নাকি ভালোবাসার ফলস্বরূপ। হবে হয়তো কিছু একটা। ফেলে আসা স্মৃতিগুলো আমি নিযেও ভুলতে যেতে চাইনা। এভাবেই বেঁচে থাকতে চাই।
সেঁজুতিরও সাত বছর হতে চললো। ওর শত শত বায়না। শত শত আবদার। শত শত মিষ্টি কথা আর দুষ্ট হাসি আমাকে এক নিমিষেই পাগল করে ফেলে। পিতৃত্বের সম্পর্কটা বুঝি এরকমই। এটাই বুঝি আত্মার আত্মীয়, অস্তিত্বে মিশে থাকা রক্তের সম্পর্ক। যেটা সবসময় অনুভব করি। সেঁজুতির একটা আবদারে আমি সবসময়ই হার মেনে মুখ লুকিয়ে কাঁদি। গোপনে অশ্রু ফেলি নিরন্তর। জানো, মাঝখানে কয়েকদিন সেঁজুতি চোখ মুছিয়ে দিয়েছিল তখন বুকটায় আরও বেশি ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দৃশ্যটার কথা মনে পরলে এখনো বিয়োগ বেদনায় ভুগি। হাহাকারটা তখন থেকেই পিছু নিয়েছে। চিৎকার করে যে কাঁদব সে সাহস টুকু তখন থেকেই হারিয়ে ফেলেছি। শত শক্তি উদ্দীপনা, রঙিন স্বপ্নগুলো এখনো তারিয়ে তারিয়ে নিস্তেজ করে ফেলে নিজেকে। বাহুবলে শুধু শক্তির অপচয়।
শেষ কথাটি এখনো কানে বাজে। সেকি মায়াময় কথা। সেকি হৃদয়বিদারক কথা। আঘাত করার নানা উপায় ছিলো সেদিন কিন্তু এভাবে যে আঘাত করে বুকটা ফেটে দেবে বুঝিনি। “সেঁজুতিকে দেখে রেখো ” এই কথার পর আর কোন কথা কানের মিছিলে এসে পৌছায়নি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা। সেই অপলক দৃষ্টিতে এখনো আমি আকর্ষিত।
ভেবেছিলাম একটি বৈশাখী শাড়ি, কিছু রঙিন চুড়ি, একটি লাল গোলাপের সাথে দেখা হবে। আর একটি নতুন চাঁদের সাথে আলাপ হবে আমার। কিন্তু তুমি আর ফেরনি সেদিন। নতুন চাঁদ উঠবে বলেও ডুবে গেছে চিরতরে। সন্তানের মুখ দেখাও হয়নি আমার। ফিরেও পায়নি তোমায়। হতভম্ব হতভাগ্য কপাল যাকে বলে। বৈশাখ কি তবে আমার বিষাদের দিন ছিলো। মৃত্যুর কোলাহলে সেদিন বুঝি আকাশের ভাঁজে ভাঁজেও মেঘ জমেছিল। একদম কালো মেঘ। ঝড়ের মতোই অগোছালো। সবকিছু এক নিমেষেই ওলট-পালট।
সেই থেকেই আমি বৈশাখ খুবই ভয় পাই। না জানি আবার কাকে কেড়ে নেবে চিরতরে। আবার নতুন করে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে। হারানোর ব্যাথা হয়তো সহ্য করে উঠেছি, কিন্তু ভুলতে পারিনি। হয়তো আঁধারে হাঁটতে এখন কিছুটা সাহস কুড়িয়ে নিয়েছি কিন্তু অনুভূতিগুলোকেও বিসর্জ্জন দিয়েছি। হয়তো সামনে একা হাঁটতে গিয়ে কিছু স্মৃতি ভুলে গিয়েছি কিন্তু প্রিয় জীবনসঙ্গিনীর মুখটা এখনো ভুলিনি।
১০টি মন্তব্য
তৌহিদ
লেখাটি পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো ভাই। সন্তানের জন্য মাতৃশোক সারাজীবন দগদগে ক্ষত হয়ে থাকে মনে। ছোট্ট অবুঝ শিশুটি অকালেই মাকে হারানোর বেদনায় ব্যথিত হলাম। সেঁজুতি ভালো থাকুক এটাই কাম্য।
লেখা ভালো লেগেছে ভাই।
নৃ মাসুদ রানা
ধন্যবাদ প্রিয়, আমারও ভালো লাগলো।
নিতাই বাবু
আপনার লেখা পড়ে নিজের মনটাও খারাপ হয়ে গেল! আমিও এক সন্তান হারা ব্যক্তি। আমার চিতায় প্রদীপ জ্বালাতে এসেও হারি গেছে কালো আঁধারে। এখন আমার মৃত্যু পর চিতায় প্রদীপ জ্বালানোর মত আর কেউ রইল না। আমি এই পৃথিবীতে এক হতভাগ্য ব্যক্তি।
নৃ মাসুদ রানা
আহা! বেদনাদায়ক……
চাটিগাঁ থেকে বাহার
যে কোন মৃত্যু কষ্টদায়ক। আর তা যদি হয় আপন কারো মৃত্যু তাহলে তা আরো ব্যদনাদায়ক। সেজুতি ওপারে ভালো থাকুক….
নৃ মাসুদ রানা
ভালো থাকুক…
আরজু মুক্তা
সেঁজুতি ভালো থাকুক ওপারে।
নৃ মাসুদ রানা
ভালো থাকুক পরপারে
সাখিয়ারা আক্তার তন্নী
এটাই বুঝি আত্মার আত্মীয়, অস্তিত্বে মিশে থাকা রক্তের সম্পর্ক।
খুব ভালো লাগলো।
নৃ মাসুদ রানা
এটাই বুঝি আত্মার আত্মীয়, অস্তিত্বে মিশে থাকা রক্তের সম্পর্ক।