প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত নারীরা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পেশার পুরুষের কাছে বিভিন্ন ভাবে ধর্ষিত হচ্ছে! রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে বাসের ড্রাইভার, সবজি-ওয়ালা থেকে শুরু করে মাছ-ওয়ালা, ফলের দোকানি থেকে শুরু করে কাপড়ের দোকানির কাছে প্রতিটা জায়গায় প্রতিটি মুহূর্তে মেয়েরা লাঞ্ছিত অপমানিত হচ্ছে! এ থেকে কবে আমরা পরিত্রাণ পাবো? এই সমাজের পুরুষেরা কবে মেয়েদের শুধু মেয়ে নয়, মানুষ রূপে দেখবে? কবে? কবে? কবে?

একজন সবজি-ওয়ালা হরেক রকম সবজি নিয়ে বসলেও মেয়েদের দেখলে প্রথমেই বলবে আপা বেগুন লাগবে? মোটা মোটা বেগুন আছে, দিয়ে দেই? মাছের বাজারের চিত্রও ঠিক একই রকম! কৃষি-মার্কেট মাছের বাজারে একজন মাছ-ওয়ালার কাছে পাবদা, ট্যাংরা, শিং, টাকি আরও কয়েক রকম মাছ থাকে, অথচ সেই মাছের দোকানি মেয়ে দেখলেই বলবে আপা মোটা মোটা টাকি-মাছ আছে দিয়ে দেই?

আমি নিজেই অনেক দিন এইরূপ অশালীন ইঙ্গিতপূর্ণ হয়রানির স্বীকার হয়েছি। এরই ধারাবাহিতায় গতকাল কাঁচাবাজারে সবজি কিনতে গেলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে! ছবিতে হাস্যোজ্জল মানুষরূপী যে জানোয়ারকে দেখছেন ওনার নাম চুন্নু, উনি কৃষি মার্কেট বাজারের ফুটপাতে সবজি বিক্রি করেন। ওনার নিজের ঘরে তিন মেয়ে রয়েছে! ইতিমধ্যে দুই মেয়ের বিয়েও দিয়েছে! অথচ ওনার মেয়ের বয়সী মেয়েরাও তার অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত থেকে রেহাই পায় না! গতকাল দুপুরে বাজার নিতে গিয়ে ওনার সবজির ঝুড়ির কাছে দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করলো আপা বেগুন লাগবে না করল্লা?(!) মুহূর্তেই মাথায় রক্ত চড়ে গেলো, চোয়াল শক্ত করে রক্ত চক্ষু নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওখান থেকে চলে আসলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় এতোটাই মর্মাহত হয়েছিলাম যে কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না আমি আসলে কী বাজার নিতে আসছি! বার বার আমার কানে বাজতে থাকলো সেই সবজি-ওয়ালার ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা! কিছুক্ষণ মন খারাপ করে এদিক সেদিক ঘুরছি আর ভাবছি হারামজাদাকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার! ঘুরে আবার সেখানে গেলাম। গিয়ে ওনার সবজির ঝুড়ি সহ তার ছবি তুলতে দেখে জানতে চাইলো কেন তার ছবি তুলছি! ছবি তোলা শেষ হতেই চিৎকার করে গালি দিয়ে জানতে চাইলাম এতো এতো সবজি থাকতে কেন বেগুন আর করল্লা নিয়ে সাধলি! আমার গালাগালি আর চিৎকারে আশেপাশের অনেক জন ছুটে এলেন! সবসময় এই বাজার থেকেই নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার নিয়ে থাকি! সেই সুবাদে মোটামুটি সবাই কমবেশি চিনে। তাই সবাই আমার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। হারামিটাকে সবাই যখন জিজ্ঞেস করলো কেন আমি তাকে গালাগালি করছি? নির্লজ্জভাবে হাসতে হাসতে বলে আমি কিছু বলিনি আফায় খালি খালি গালি দিচ্ছে! ততক্ষণে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে! কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না! হাতের কাছে কিছু না পেয়ে জানোয়ারের ঝুড়িতে রাখা ধুন্দুল তুলে তাই দিয়ে বেটার মুখের বাইড়ানো শুরু করলাম! একটা করে মারি আর ধুন্দুল গুড়াগুড়া হয়ে যায়। রাগ সামলাতে না পেরে সামনে রাখা সবজির ঝুড়িতে লাথি মেরে ফেলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত স্যান্ডেলও ছিঁড়ে যায়! ততক্ষণে বাজার কমিটির কয়েকজন খবর পেয়ে ছুটে এসে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে প্রতিজ্ঞা করে বিষয়টা তারা দেখবে বলে! তবে একটা দুঃখের বিষয় মোবাইলে স্পেস না থাকায় আমি পুরো ঘটনার ভিডিও ধারণ করতে পারিনি। বাজার কমিটির একজন আমাকে রিকশায় তুলে দেয়। কোনরকম ওখান থেকে বাসায় আসি। এরপর এলাকার গণ্যমান্য কয়েকজনকে তাৎক্ষণিক বিষয়টা জানালে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজার কমিটির লিটন নামের একজন সহ আরও দু’একজন মিলে সেই হারামজাদাকে ধরে নিয়ে আসে! এলাকার সবার উপস্থিতিতে মাফ চেয়ে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং লিটন নামের ভদ্রলোক ফোন নম্বর দিয়ে বলে যায় এরপর কেউ কোনরকম অশালীন আচরণ করলে আমি যেন কমিটিকে জানাই!

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে এইগুলো কি শুধু আমার সাথেই হয়?(!) আবার কিছু কিছু ন্যাকা মহিলারা আছে তারা বলবে আমরাও তো বাজারে যাই আমাদের সাথে তো হয়না! কী জানি বাপু তোমার সাথেই কেন যে হয়? অনেকেই আবার ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে আমাকেই বলবে, দেখো দেখো কিরকম বেহায়া মেয়ে-গো বাবা, বেগুন আর করল্লা দিতে চেয়েছে তাতে দোষের কি আছে? তাই বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাজার মাথায় করেছো, দেখো কাণ্ডখানা! আমি হলে বাপু এই কাজ কখনই করতে পারতাম না! আরেক শ্রেণী আছে যারা বলবে পুরুষ মানুষ তো এইরকমই, তাই বলে এমন করতে পারে এ আমি বাপের জন্মেও দেখিনি – ঘেন্না ঘেন্না!
বলছিলাম কি, আম্মারা, খালাম্মারা, ভাবিরা, আফারা আপনারা যারা এইরূপ চিন্তাপ্রবণ দয়া করে এই লেখাটা এড়িয়ে যাবেন! এই রকম চিন্তা করা মহিলাদের বেগুন আর করল্লা ভরে দিলেও লোকলজ্জার ভয়ে হজম করে বলেই আমরা গুটিকয় প্রতিবাদী নারী সমাজের চোখে নষ্টা মেয়ে! আজ্ঞে আপনাদের বলছি! ইয়ে মানে, আপনারা যারা এইরূপ অন্যায়ের সম্মুখীন হয়ে লোকলজ্জার ভয়ে, অথবা প্রতিবাদ করলে জাত যাবে জাত যাবে বলে রাস্তাঘাটে রিকশাওয়ালা, সবজি-ওয়ালা, বাসের ড্রাইভার বা কাপড়ের দোকানির কাছে ‘হাত মারা’, ‘পাছা মারা’ সহ অশ্লীল বুলিতে শিহরিত হয়ে দিনশেষে ঘরে ফিরে সতীসাধ্বী হয়ে পতিব্রতা সাজেন আপনাদের কারণেই আরও দশটা মেয়ে এইসব নোংরামি আর হয়রানির স্বীকার হচ্ছে! কিছু মানুষকে দেখেছি পাশেই অন্য একজনের সাথে অন্যায় হচ্ছে দেখেও কি ভীষণ নির্লিপ্ততায় দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায়! হয়তো ভাবে, আমার সাথে যেহেতু হয়নি কি দরকার নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর! সমাজের প্রতিটি নারী পুরুষ, সর্বোপরি প্রতিটি মানুষের কাছে অনুরোধ করছি যেখানেই অন্যায় দেখবেন রুখে দাঁড়াবেন দয়া করে! নয়তো এইভাবে চলতে থাকলে একদিন দেখবেন সেই নির্যাতিতার জায়গায় আপনার বোন, মা অথবা আপনার কন্যা! অথবা দেখবেন অপরাধী আপনার বা আপনারই পরিচিত কারো সন্তান!

৮৩২জন ৮৩০জন

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ