প্রতিটি মানুষের কিছু ব্যক্তিগত শখ থাকে, আমারও আছে। এই যেমন— সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার শখ। মৃত মানুষের সঙ্গে আড্ডা দেয়া যায় না, সে জন্য আমার এই শখটি কখনও পূরণ হবে না। অবশ্য, তিনি আমার জন্য দুই খণ্ডের ‘পঞ্চতন্ত্র’ রেখে গেছেন। শুধু পঞ্চতন্ত্র কেন? দেশে-বিদেশে, চাচকাহিনী, ময়ূরকণ্ঠী— কত চমৎকার সব বই আছে!
যা-ই হোক, আমার মন খারাপ হলে আমি প্রায়সময় পঞ্চতন্ত্র নিয়ে বসে পড়ি। এর প্রতিটি লাইন কতবার পড়েছি, আরও কতবার পড়ব কে জানে! কিন্তু তার শব্দের স্বাদ আজও মলিন হয় নি। অপূর্ব রসবোধ আর বৈঠকি চালের ভাষার সমন্বয়ে প্রতিটি বাক্য এতোটাই জীবন্ত যে, আমার কাছে তা কখনও পুরনো মনে হয় না। কারণ এই লোক নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, তাঁর কায়রো দেখতে লেগেছিল এক বছর— আর এর মধ্যে প্রথম ছ’মাস কাটিয়েছিলেন স্রেফ আড্ডা মেরে। বাড়ির ছাত থেকে পিরামিড দেখা যায় অথচ তাঁর সেখানে যাওয়ার আগ্রহ হয় নি। আর এ নিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ স্বীকারোক্তি— ‘এক গাদা পাথর দেখায় যে কি তত্ত্ব তা আমি পিরামিড দেখার আগে এবং পরে কোনো অবস্থাতেই ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারি নি।’
এই ঘটনাটি উল্লেখ করার কিছু কারণ আছে। গতবছর আমি কিছু সঙ্গীর সঙ্গে ভারত বেড়াতে গিয়েছিলাম। মূলত, শান্তিনিকেতন দেখার উদ্দেশ্যেই। শেষ পর্যন্ত অনেককিছু দেখা হলেও শান্তিনিকেতন দেখা হয় নি। সে কথা মনে পড়লে আমার এখনও মন খারাপ হয়। আমাদের বাঙ্গালীদের বেড়ানো মানে — টাকা খরচ করে এসেছি, যা পাই দেখব, ছবি তুলব, তারপর চলে আসবো— এসব থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। দুঃখের কথা থাক্, এরচে যে কথা বলার জন্য এতখানি ভূমিকা দিলাম এবার সেটাই বলি— মানালীতে সঙ্গীরা বরফের পাহাড়ে উঠবে, আমাকে বলল,— ‘তুমি উঠবেনা?’ আমি গম্ভীর গলায় বললাম,— ‘আমাদের বাসায় ফ্রিজ খুললেই বরফ দেখা যায়।’ যদ্দুর মনে পড়ে এই জবাব শুনে সবাই বিরক্ত হয়েছিলেন। কেন জানিনা আমার আগ্রহের ক্ষেত্র খুব কম। তবে এ কথা সত্যি, কল্পনাতে তাজমহল ছাড়া সবকিছুই সুন্দর।
নিজের কথা বললাম, এবার একটি শোনা কথা বলি। বাউলসাধক শাহ্ আবদুল করিমকে কোন্ একটা পদক বাবদ এক লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছে। তো, তিনি তা নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে এক চায়ের দোকানে বসে বিস্কুট চুবিয়ে চা খাচ্ছেন। এমন সময় কে যেন টাকার কথা বলল, তখন তিনি বললেন, এই টাকা দিয়ে আমি কী করব!
প্রসঙ্গ থেকে অনেকখানি দূরে সরে গিয়েছি, পুরনো প্রসঙ্গে ফেরা যাক্। আড্ডার সঠিক চিত্র মুজতবা আলীর মতন কজন আঁকতে পেরেছেন? তিনি বলেছেন,— ‘আমি ভালবাসি হেদো, হাতিবাগান, শ্যামবাজার। ও-সব জায়গায় তাজমহল নেই, পিরামিড নেই। তাতে আমার বিন্দুমাত্র খেদও নেই। আমি ভালোবাসি আমার পাড়ার চায়ের দোকানটি। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা হাজিরা দিই, পাড়ার পটলা, হাবুল আসে, সবাই মিলে বিড়ি ফুঁকে গুষ্ঠিসুখ অনুভব করি আর উজির-নাজির মারি।’
এবার একটু রান্নার দিকে যাই। পৃথিবীতে দু’রকম রান্না হয়, মশলাযুক্ত ও মশলাবর্জিত। একসময় তুর্ক পাঠানরা যখন ভারতবর্ষে আসে তখনও নাকি পশ্চিম ও উত্তর ভারত নিরামিষ খেত। সে যাই হোক— তারা মাংস খেত, কিন্তু সে রান্নায় মশলা থাকত না। তুর্ক-পাঠান-মোঘলরা যে রকম ভারতবর্ষের অলংকার কারুকার্যের সঙ্গে তুর্কিস্থানি ইরানী স্থাপত্য মিলিয়ে তাজমহল বানালো, ঠিক সেরকম ভারতীয় মশলার সঙ্গে তাদের মাংস রান্নার কায়দা মিলিয়ে এক অপূর্ব রান্না সৃষ্টি করল। রান্না নিয়ে মুজতবা আলীর সরস উক্তি— ‘আপনারা তাজমহল দেখে ‘আহা’ ‘আহা’ করেন, আমি করি না। কারণ তাজমহল চিবিয়ে খাওয়া যায় না। আর খাস মোগলাই রান্না পেলেই আমি খাই এবং খেয়ে ‘জিন্দাবাদ বাবুর আকবর’ বলি— যদিও তাঁরা বহুকাল হল এ-জিন্দেগীর খাওয়া দাওয়া শেষ করে চলে গিয়েছেন।‘
এমন লোকের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার শখ জেগে ওঠলে নিজেকে কি আর দোষ দেয়া যায়! আরেকটি তথ্য দিই— সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র। গল্পটা হলো, মুজতবা আলী তখন ক্লাস নাইনে পড়েন, এমন সময় রবীন্দ্রনাথ সিলেটে বক্তৃতা দিতে গেলেন। তো, কয়েকদিন পর কিশোর মুজতবা কবিকে চিঠি পাঠালেন। চিঠির বিষয়বস্তু ‘আকাঙ্খা।’ কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ সেই চিঠির উত্তর দিলেন। যার সারমর্ম ছিলো— আকাঙ্খা উচ্চ করতে হবে, নিজের কথা ভাবলে চলবে না, সবার কথা ভাবতে হবে। রবীন্দ্রনাথ একজন কিশোরের দেয়া চিঠির উত্তর দেবেন— কজন ভাবতে পেরেছিল! মুজতবাও ভাবতে পারে নি। এরপর কিশোর মুজতবা শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। এবং তিনি সেখানকার প্রথমদিকের ছাত্র। আর সে সময় রবীন্দ্রনাথ নিজে ক্লাস নিতেন।
পাদটীকাঃ ঐতিহ্য থেকে ৩০খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে, এর মুল্য প্রায় কুড়ি হাজার টাকার কাছাকাছি। পরশু নোমান ভাইয়ের কাছে সে কথা বলে কিছু দীর্ঘশ্বাসও ফেললাম। না, আরেকটু ধনী হলে ভালো হতো। আমার দাদী বলতেন,— ‘শখের দাম চল্লিশ তুলা।’ রবীন্দ্র রচনাবলী পড়তে পড়তে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি— চিন্তা করতেই তো ভাল লাগছে!
৮টি মন্তব্য
আবু খায়ের আনিছ
ভাই আপনার পোষ্ট আমি যত বার পড়েছি ততবার আমার আফসোস হয়েছে এমন একজন সঙ্গি না পাওয়ার যে বই এর পোকাঁ। অবশ্য একজন আছে বই এর পোকাঁ পরিচিত কিন্তু তার পেট থেকে কথা বের করা আমার কর্ম নয়। যাইহোক, বই খানা কোথায় পাব তাই যদি বলে দেন, একবার পড়ার ইচ্ছা জাগছে।
নাজমুস সাকিব রহমান
(সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাসমগ্র ১ম খণ্ড, আলাদাভাবে বইয়ের নাম -‘পঞ্চতন্ত্র।’ নীলক্ষেত এ পাবেন।)
আমি বইয়ের পোকা নই, আরও স্পষ্ট করে বললে একজন ধান্ধাবাজ পাঠক, যে না পড়লে লিখতে পারে না। সে জন্য বাধ্য হয়ে পড়তে হয়। যাই হোক, আপনার ফোন নাম্বারটা দিয়েন। যোগাযোগ করে আফসোস কমিয়ে দেব হা হা।
আবু খায়ের আনিছ
তবু পড়ছেন ত, আমি পড়ি নিজের শখের বসে আর জানার উদ্দেশ্যে। সাথে ভালো লাগাগুলোও মিশে থাকে।
আবু খায়ের আনিছ
জিসান ভাই, বা নীতেশ দাদা এর কাছে নাম্বার দিলে আমি যোগাযোগ করে নিব।
নীলাঞ্জনা নীলা
বিদেশ থাকি কিন্তু টাকাওয়ালী নই। বিশ্বাস কেউ করেনা। যখন চাকরীতে ঢুকলাম টরেন্টো গিয়ে বই কিনলাম $১০০। পার্ট টাইম চাকরীতে বেতন এসেছিলো $৩০০। তবু পারিনা লোভ সামলাতে বই না কিনে। যারা বই পড়ে, তারা আমার অনেক প্রিয়।
অপার্থিব
টাকা দিয়ে বই কেনার সামর্থ্য সবার থাকবে না এটাই স্বাভাবিক । এই জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেটা করা উচিত তা হচ্ছে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা।
কিন্ত এই লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকতার এখন বড় অভাব। যে কয়টা এখনো টিকে আছে সেগুলোও কোন রকমে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। ভোগ বাদী কালচারে দান খয়রাত যেটুকু হয় সেটা মূলত পরকালে সওয়াবের আশায় অর্থাৎ মসজিদ মাদ্রাসা এতিম খানায়। লাইব্রেরীতে কেউ দান করে না। একমাত্র লাইব্রেরীই পারে দেশে জ্ঞানের চর্চা বৃদ্ধি করে আলোকিত মানুষ তৈরী করতে এটা সরকারের বুঝতে হবে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বইয়ের খরচ কমিয়ে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত।
ইয়াসির রাফা
ভাল লাগলো।
ইঞ্জা
ছোটবেলা থেকেই বই পড়তাম শরৎচন্দ্র, নীহারঞ্জন, সুকুমার বসু আরো অনেকের বই পড়েছি তখন আর ইদানিং কাজের চাপে বই পড়া কমে গেছে বলে কষ্টই লাগে।