তৃতীয় অংশ…
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রাত বারটা বেজে গেল। কমলেশ বললেন, বোগাস, আরে ওসব কিছু নয়! গ্রামের লোকের গুজব ছাড়া আর কিছু নয়।
–যা রটে তা কিছু বটে, চাপা স্বরে বিশুমাস্টার বলে ওঠেন।
–ঠিক আছে আর আধ ঘণ্টা দেখে যাই, তারপরে ঘরে চলে যাব, কমলেশ অনিচ্ছায় বলে ওঠেন।
–সেটাই ভালো হবে, শিক্ষকদের মধ্যে থেকে এক জন বলে উঠলেন।
আর এক জন বলে ওঠেন, রোজ রোজ ঘুম নষ্ট করা আর ভালো লাগে না বিশু বাবু!
–রাত একটা তো বাজতে দিন, বিশু বাবুর গলা, ওঁর মতে রাত বারটার পরে ভূতদের অবাধ গতি শুরু হয়, আর রাত একটা মানে তো ওদের শরীর আরও হালকা হয়ে অবাধ চলা ফেরায় সামর্থ্য হয়ে ওঠে, বিশুমাস্টারের ফিসফিসানি সমানে চলতে থাকে। রাত একটা বেজে পনের, কমলেশ হতাশ হলেন, ঘরে যাবার জন্য ব্যস্ত হলেন।এক মাত্র বিশুবাবু তার ব্যতিক্রম। তিনি সবাইকে ভূত দেখানোর ক্রেডিট হাত ছাড়া করতে চান না। ফিরে যাবার সময় বড় রাস্তা ধরে কিছুটা চড়াই পথ পড়ে, সে পথটুকু পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন সবাই, উদ্দেশ্য ঘরে ফিরে যাবার। কলোনির কুয়াটারে পৌঁছাতে হলে এবার রাস্তা ধরে উতরাইয়ের দিকে নাবতে হবে। কমলেশের কেন যেন মনে হল শেষ বারের মত একবার পিছু ফিরে দেখে যাওয়া যাক! পেছন ফিরে তাকালেন তিনি, একি! হাটের কোন থেকে একটা আলো দেখা যাচ্ছে না! নিজের অজ্ঞাতেই তাঁর মুখ থেকে কথাগুলি বেরিয়ে এলো। সবাই দেখতে পেলেন একটা আলো, তার থেকে অন্য একটা আলো বেরিয়ে, আগেরটার অস্তিত্ব মুছে দিয়ে এগিয়ে চলেছে তার নির্দিষ্ট পথে। কমলেশ কিছু সময় থমকে দাঁড়ালেন, মুখ থেকে তাঁর অস্পষ্ট উত্তেজিত আওয়াজ বের হল, আপনারা দেখছেন! ঐযে একটা আলো এগিয়ে যাচ্ছে!
উত্তেজিত হয়ে গেলেন বিশু মাস্টার, চাপা গলায় বলে উঠলেন, আলেয়া, আলেয়া!
কমলেশের শরীরে রোমাঞ্চ জেগে উঠলো, তিনি দৌড়ে নামতে লাগলেন ঢালান রাস্তা ধরে। তাঁর পেছনে পেছনে বাকী সঙ্গীরা এগোতে লাগলেন। উত্তেজনায় দিশে হারা কমলেশ আলোর দিকে ছুটে চলেছেন, দেখলে মনে হবে কোন অদৃশ্য শক্তির তাড়নায় এমনি ছুটে চলেছেন তিনি!
তাঁর ছোটার গতির সঙ্গে সঙ্গে আলোর গতিও একই হারে বেড়ে যেতে লাগল, সঙ্গীদের পিছে ফেলে তিনি অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আলো আর মাত্র দশ হাতের মত দুরে! স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আলোটা, দাঁড়ালেন না কমলেশ, লক্ষ্য করলেন তাঁর ছোটার গতির সঙ্গে আলোর যাওয়ার গতিটাও ক্রমশ: বেড়ে যাচ্ছিল! হলুদ রঙের স্থির উজ্জ্বল আলো, তার জোর গতিতে শন শন এক ধরণের শব্দ ছিল!
পেছন থেকে সাথীরা বলে চলেছেন, আর যাবেন না, থামুন, থামুন কমলেশ বাবু!
আর মাত্র তিন হাত দূর..হঠাৎ দপ করে নিভে গেল আলো! অন্ধকারে থমকে দাঁড়ালেন কমলেশ। চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল।কিছু সময়ের মধ্যে সাথীরা সবাই কমলেশের কাছ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। বিশুমাস্টার অবাক হয়ে কমলেশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, বোধ হয় তিনি দেখতে চাইলেন কমলেশ ঠিক ঠাক আছেন কি না! অশরীরী কোন লক্ষণ তার মধ্যে ঢুকে যায় নি তো!
কমলেশ ভালো করে লক্ষ্য কর ছিলেন আলোটার দিকে তিনি যত জোরে ছুট ছিলেন প্রায় তত জোরে আলোও ছুট ছিল আর আলোর বেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া কাটার সাঁই সাঁই শব্দটাও বেড়ে যাচ্ছিল। অনেক চেষ্টা করেও আলোটার সঙ্গে কোন লোক জনকে দেখেন নি কমলেশ। কেবল আলো তার নিদিষ্ট গতি পথ ধরে চলেছে—অকম্পমান একটা আলো!
পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে তারা যখন ঘরের দিকে রওনা হলেন দুরে নদীর তীরে কয়েক মুহূর্তের জন্য আলেয়াটাকে জ্বলে উঠতে দেখা গেলো–কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্বলে উঠে আবার সেটা নিভে গেল!
ঘটনা অলৌকিক, বিশ্বাস না করে পারেননি কমলেশ। সত্যি, পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু আছে, তার নাম যে যাই দিক না কেন! ভূত, প্রেত যাই হোক না কেন! এ ঘটনার পর থেকে মানসিক এক ধরণের ভয় পেয়ে বসে ছিল কমলেশকে। রাতের অন্ধকারে মনে হত এই বুঝি তিনি কোথাও আলেয়া দেখে ফেলবেন! কৌতূহলী মনটা ক্রমশ ভয়ে দমে যাচ্ছিল।
পাঁচ ছ মাস আগের কথা, বিশু মাস্টার তাদের সঙ্গে আলেয়ার খোঁজে গিয়ে ছিলেন। আজ তিনি নিজেই অলৌকিক রাজ্যে চলে গেলেন! কে জানে তিনি নিজে আর আলেয়ার খোঁজে ঘুরবেন কি না! অথবা স্বয়ং আলেয়া হয়ে গেলেন কি না! তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় কমলেশের সঙ্গে সব টিচার, গ্রামের অনেক লোক গিয়ে ছিলেন।
বিশুমাষ্টারের মৃত্যু রহস্য, রহস্য হয়েই থেকে গেল। অস্বাভাবিক মৃত্যু অথবা নিরেট দুর্ঘটনা তা আর নিরূপিত হল না! কেউ জোর দিয়ে এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না।
৩
আবার একদিন কাক ডেকে উঠলো। আবার কি ঘটনা ঘটবে ভাবছিলেন কমলেশ।
কমলেশের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে, তখনও উড়িষ্যায় শিক্ষকতা করেন তিনি। অবিবাহিত। স্কুলে প্রতি বছরের মত সামার ভেকেশন ছিল প্রায় পঁয়তাল্লিশ দিনের মত। ঠিক করলেন কলকাতা ঘুরে আসবেন। সেখানে তাঁর আত্মীয় স্বজনের অভাব নেই। বেহালাতে বড় কাকু, মামা বারুই পুর, মাসীরা কালনায়, ত্রিবেণীতে, জ্যাঠামশাই রানাঘাট, এমনি সবাই ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকেন।
কমলেশ উঠলেন বড় কাকার ঘরে, বেহালায়। কাকা কাকিমা দু জনেই খুব ভালোবাসেন তাঁকে। কলকাতা গেলে অনেক জাগাতেই যেতে হয়। দু তিন দিন করে প্রায় সবার সঙ্গেই দেখা করে আসেন তিনি। তখন বেহালার কাকার বাড়ি আছেন, ভোরের দিকে কাক ডেকে উঠলো, সে ডাক কতটা করুণ ছিল কমলেশের জানা নেই। ওই দিন তাঁর এক নতুন জাগায় যাবার সাধ হয়ে ছিল। তিনি ছোট বেলায় টালিগঞ্জ হরিপদ দত্ত লেনে থাকতেন। তাঁর বয়েস কতই বা হবে তখন—এই পাঁচ, বড় জোর ছয়! বাবা মা আর দুই ভাই মিলে চৌত্রিশের এক, অনিল কুটির বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ওঁরা। সে সময় বাড়ীওয়ালা ছিলেন অনিল সরকার। তাঁর মেজ ছেলে দিলীপ, কমলেশের ছোট বেলার বন্ধু ছিল। ওই বয়সে ছেলে মেয়ে বন্ধু বান্ধবীর কোন বাচ বিচার থাকে না। তাঁর খেলার সাথীদের মধ্যে অনেকের কথা তাঁর স্পষ্ট মনে আছে–দিলীপ, খোকন, কল্পনা, চায়না, খুকু, পুতুলেদের সঙ্গেই তিনি খেলতেন–বালক পটের সে স্মৃতি কমলেশের মন থেকে আজও মুছে যায় নি!
আজ ষোলো সতের বছর পরে তাঁর মনে হল তাঁর বালক বেলার ফেলে আসা সঙ্গীদের একবার খোঁজ নিতে যাবার কথা। অদ্ভুত ইচ্ছা বটে! হয়তো কেউ তাকে চিনবে না–আর চিনলেও তেমন রেসপন্স দেবে না, অথবা এমন হতে পারে তারা কেউ আর ওখানে নেই। অনেকেই কর্মক্ষেত্রে বা মেয়েরা অন্য কোন খানে বৌ হয়ে চলে গিয়ে থাকবে। তবু তিনি একবার ঘুরে আসার অদ্ভুত ইচ্ছে দমন করতে পারলেন না।
ভোর রাতে কাকের ডাক শুনলেন কমলেশ। থেমে গেলেন না তিনি, ট্রামে বাসে ঝুলে পড়লেন, সেই টালিগঞ্জ, আনোয়ারশা রোডের হরিপদ দত্ত লেনে যেতে হবে তাঁকে।
ক্রমশ…
৪টি মন্তব্য
স্বপ্ন নীলা
দারুন জমেছে ——চলুক
তাপসকিরণ রায়
অনেক ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
পুর্বের পর্ব সহ এই পর্ব আগেই পড়েছি দাদা।
সময়ের অভাবে মন্তব্য করতে পারিনি।
অপেক্ষা করছি পরের পর্বের জন্য।
তাপসকিরণ রায়
আপনি আমার নিয়মিত পাঠক–অনেক ধন্যবাদ।