কাকের ডাক (ভৌতিক)

তাপসকিরণ রায় ৫ জানুয়ারি ২০১৫, সোমবার, ১১:১৪:০০পূর্বাহ্ন গল্প ৬ মন্তব্য

পরবর্তী অংশ…

অবিবাহিত কমলেশের বয়স তখন বাইশ তেইশ হবে। ভূতটুতে তখনও বিশ্বাস ছিলনা, তবে কৌতূহল ছিল অনেক। বিশু মাস্টারের গল্প শুনেই তিনি ঠিক করে নিলেন, যাচাই করে দেখতে হবে জিনিষটা কি! গাঁয়ের তিন চার জন শিক্ষককে রাজি করালেন, প্রত্যেকের মধ্যেই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কৌতূহল দেখা গেলো। ঠিক হল কোন শনিবার ধরে গভীর রাতে তাঁরা দেখতে যাবেন–আলেয়া। সত্যি জিনিষটা কি–তা পরীক্ষা হবে–আর ব্যাপারটা কতটা গুজব তাও  গ্রামের লোকদের বোঝানো সম্ভবপর হবে। উত্সাহে ভরপুর চার শিক্ষক মশাই সঙ্গে বিশু মাস্টারকে নিয়ে কমলেশ রাত বারটায় যাত্রা শুরু করলেন। ঠিক হল মেইন রাস্তা যেটার ওপর দিয়ে আলেয়া ক্রস করে তার প্রায় পাঁচ ছ শ গজ দুরে, যেখানে রাস্তা অনেকটা উঁচু পাহাড় কেটে নেমে এসেছে, সেই উঁচু জাগা থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করবেন সবাই। জাগাটার লাগোয়া যে গ্রাম আছে সেটা হল হাড্ডাপুট।

ধৈর্যর অপেক্ষায় চলতে লাগলো অনেক সময়, পাক্কা দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কিছুরই দেখা পাওয়া গেল না। এমনি অনুসন্ধান চলল তার পরের মঙ্গলবার আর শনিবারও।  আলেয়া ভূত দেখার স্বপ্ন ব্যর্থ হল, কিন্তু এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র কেউ ছিলেন না। কমলেশ গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সেই অলৌকিক আলেয়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে লাগলেন।

–হ, বাবু, শুনেছি অমাবইস্যা রাইতে বাইরয়, বলে গ্রামের এক জন অল্প বয়সের লোক।

নিজে কিছু দেখনি তুমি ? কমলেশ প্রশ্ন করেন।

–না বাবু, আমি তো দেহি নেই, তবে এ গ্রামের অনেকে দেইখছে! ওই লোকটা জবাব দেয়।

–কেউ দেখেছে এমন কারও নাম বল না, কমলেশ বলেন।

–হরেন খুড়ো সব জানে, তার কাছে গিয়া দেহেন, লোকটা বলে।

হরেন খুড়োকে গ্রামের সব লোক চেনে, মাতব্বর ধরণের লোক। খোঁজ নিয়ে খুড়োর ঘরে পৌঁছলেন কমলেশ, জিজ্ঞাস করলেন, হরেন মশাই, আপনার কাছে কিছু কথা জানতে এসেছি।

–কন না, মাষ্টার মশাই, কি জানতে চান ? কমলেশকে বসতে দিয়ে হরেন খুড়ো বলে।

–ভূত-টুত বিশ্বাস করেন আপনি ? কখনো নিজে চোখে দেখেছেন ? কমলেশের কৌতূহলী প্রশ্ন।

খুড়ো কমলেশের চোখ দুটো নিরীক্ষণ করে নিলো, খুব উৎসুকতার সঙ্গে বলল, হঠাৎ এমন কথা কচ্ছেন কেন মাস্টামশাই! আপনি কিছু দেখছেন নাকি ?

–না, তবে দেখার ইচ্ছা আছে, আপনাদের হাটের পাশে নাকি কোন আলেয়া অনেক রাতে বের হয়, এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন কি ? কমলেশ জিজ্ঞেস করেন।

–হ, ও তো কতবার দেখলাম, হাটের কাছে থে বাইরয় আলোডা, সিধা পাকা রাস্তায় ওডে, রাস্তা পার হইয়া নদীর পারে শ্মশান পর্যন্ত যায়! অনেকবার লক্ষ্য করছি। এহন আর অত গায়ে লাগাই না…হরেন খুড়ো গল্প করে যায়। হরেন খুড়ো ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন একই ধরণের কথা জানিয়াছে। তার মানে ঘটনাতে কিছু না কিছু সত্যতা রয়েছে বলে কমলেশের মনে হল।

হাতে অফুরান সময় কমলেশের, কি করবেন, উত্সাহ নিয়ে তিন দিন গভীর রাতে শিক্ষক সাথীদের সাথে ঘুরে এসেছেন–আলেয়ার দেখা পাওয়া যায় নি। ওঁরা ধরে নিলেন ঘটনাটা গুজবই হবে।

এমনি দিনে একদিন বিশু মাস্টার এলেন। দিনটা ছিল শনিবার। কমলেশের শিক্ষক সাথীদের অনেকেই বসে ছিলেন কমলেশের ঘরে। সন্ধ্যে হয়ে গিয়ে ছিল, চা আর তেলে ভাজার আসর জমে উঠে ছিল।বিশুমাস্টার হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে ছিলেন, আজ যাবেন নাকি ?

কমলেশ তাকালেন বিশু মাস্টারের দিকে, অবাক হয়ে বললেন, কোথায়?

–সেই আলেয়ার সন্ধানে! হেসে বিশুমাস্টার বললেন,

তিন দিন ব্যর্থ অভিযানের পর সময় সুযোগ করে আর একদিন যাবার ইচ্ছে মনের কোনে থাকলেও, সেটা চেপে গেলেন কমলেশ, মুখে বললেন, বোগাস, কিচ্ছু না! গ্রামের লোকদের রটনা।

–না, না, না, গুজব নয়, সব ঘটনা গুজব হতে পারে না ! তৎপরতার সঙ্গে বলে উঠলেন বিশু মাস্টার।

–কেন, গুজব নয় কেন ? একজন শিক্ষক প্রশ্ন করেন।

আজ প্রমাণ হয়ে যাক, আজ শনিবার, তার উপর অমাবস্যা, এ যোগে ভূতপ্রেত, পিশাচ যে যেখানে থাক না কেন, না বেরিয়ে পারবে না, ভুতে অগাধ বিশ্বাসী বিশুমাস্টার যেন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে বলে উঠলেন!

অগত্যা শেষ বারের মত ঠিক হল, কমলেশরা ভর অমাবস্যাতেই দেখতে যাবেন আলেয়ার কাহিনী কত

দূর সত্য মিথ্যা যাচাই করতে! রাত সারে এগারটায় বের হলেন সবাই, সঙ্গে বিশুমাস্টারও আছেন। আর সঙ্গে থাকলো টর্চ, শর্ত ছিল বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া টর্চ জ্বালানো যাবে না। হাতে কোন হাতিয়ার-টাতিয়ার নেওয়া হল না, বিশেষ প্রয়োজনে ইট পাথরের ব্যবহার চলতে পারে। চারিদিক ঘুটঘুট অন্ধকার–একে তো শনিবার, তার ওপর অমাবস্যা–অশরীরীদের এসময় নাকি পৃথিবীতে আনাগোনা বেড়ে যায়! ওদের শক্তিও বৃদ্ধি পায়। কমলেশের অত কিছু জানা নেই, ওঁর

নেশা–জানতে হবে ভূত বলে কিছু  আছে কি না! অপ্রমাণিত গল্প বা কাহিনী রোমাঞ্চকর হলেও অনেকটাই নিরস ধরণের হয়ে যায়।

সবার মনেই আতঙ্ক, রোমাঞ্চ, এগিয়ে চলেছে সেই স্থানের দিকে, যেখান থেকে আলেয়া সহজে দেখা যাবে। কারও মুখে টু রাটুকু পর্যন্ত নেই।

বিশুমাস্টার কথা বলেন বেশি,সামান্য সময় চুপ থেকেই ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, আমরা আরও দূরত্বে থাকব, এতটা কাছাকাছি থাকার দুঃসাহস না রাখাই ভালো। ঠিক হল আমরা আলেয়ার রাস্তা ক্রস করার জাগা থেকে কমসে কম পাঁচ শ ফিট পার্থক্য নিয়ে দাঁড়াব।

বিশুমাস্টারের কথার প্রত্যুত্তর কেউ দিলেন না, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে সবাই বিশু  মাস্টারকে অনুসরণ করতে লাগলেন। এক সময় পৌঁছানো গেল সেই পুরনো জাগায়, যেখান থেকে আমাদের আলেয়াকে  লক্ষ্য করতে পারব।

ক্রমশ

 

৫৬২জন ৫৬২জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ