১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার বিকাল বেলা, অন্যান্য দিনের তুলনায় শুক্রবার আমার জন্য আলাদা গুরুত্ব বহন করে, সপ্তাহের এইদিনে একটু আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ি, কারণ প্রতি শুক্রবার আমার জন্য ভিন্ন সব অদ্ভুত ঘটনার জন্ম দেয়। যাই হোক- আমার বাসার সামনে প্রচুর মানুষ, আজ বাহিরে প্রতিটা মানুষ নেমে এসেছে। বর্তমানে আওয়ামী সন্ত্রাসী হামলার শিকার সর্বস্তরের জনগণ, শিশু থেকে স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী কেউ বাদ যাচ্ছে না, প্রতিবাদ করলেই যারে তারে যখন তখন গুলি করে মারছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন পরিচালনায় চরম ব্যর্থতা নেমে আসছে, তার অত্যাচার আর দুঃশাসনে মানুষ অতিষ্ঠ, সবার এখন এক দফা এক দাবি, হাসিনা স্বৈরতন্ত্রের পতন চাই।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে, বাসায় আর এক মূহুর্ত থাকা যাচ্ছে না। আমার ভাই, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন কেউ ভালো নেই, অর্থনৈতিক ভাবে প্রত্যেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, বিচারহীনতা আর যার-তার কণ্ঠস্বর চেপে ধরা, দিনে রাতে গুম, খুন আর মন্ত্রী-মহোদয়ের বেফাঁস কথাবার্তায় সবাই হতাশ।
আমার বাসার ইলেক্ট্রনিক মিটারে টাকা নেই, লাল বাতি জ্বলছে নিভছে, যেকোনো সময় কারেন্ট চলে যাবে, বাসা থেকে স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে বাহিরে কি হচ্ছে, পুলিশ অনবরত সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে চেষ্টা করছে, যেন গুলশান রামপুরা বাড্ডা থানার পুলিশের সাথে ছাত্রলীগ আর যুবলীগের শুয়োরের বাচ্চা গুলো এক সাথে হায়েনার মতো আচরণ করছে। সাধারণ নিরস্ত্র মানুষগুলোকে যেখানে পাচ্ছে সরাসরি গুলি করছে।
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিছে, সারাদেশ ব্যাপী কোথাও কোন ইন্টারনেট নেই, কাজকর্ম কিছুই করা যাচ্ছে না, অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইমেইল ছিল, ক্লায়েন্ট রেসপন্স না করতে পারলে আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে আমার, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। হুট করেই রাস্তায় নেমে গেলাম, আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করলাম, ন্যায্য অধিকারের দাবিতে রাজপথে নিজেকে সপে দিলাম। সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে পুলিশের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম, গুলি খাওয়ার ভয় কাজ করছে না, মনে হচ্ছে আমি অন্য কেউ, এতো দুঃসাহস কোত্থেকে এলো! যেন আবু সাঈদের মত কলিজা আমার, স্বাধীনতার জন্য বুক পেতে দিতে কুণ্ঠিত নই। সরাসরি পুলিশের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম, আমার ঠিক পেছনে দুইটা টিয়ার শেল পড়লো, কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ জ্বলতে শুরু করলো, দম বন্ধ হয়ে আসতেছে, চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, হঠাৎ মনে হলো পথভ্রষ্ট হয়ে গেছি, গ্যাসের ধোঁয়া পেড়িয়েই দেখি একটা দল আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেলো, যারা আমার ভীষণ অপরিচিত, যদিও তারা কেউ ছাত্র নয়, নয় কোন সাধারণ পথচারী, পুলিশের ছায়াতলে যারা এতো সব নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে তাদের মধ্যে খুব খাটো করে একটা ছেলে বলে উঠলো ধর ধর, আমি চিৎকার দিয়ে বললাম- ভাই আমি সাধারণ মানুষ, তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করলো যেন আমি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী থেকে ধেয়ে আসছি। ছাত্রদলের কেউ ভেবে আক্রমণ করে আমার উপর। আমাকে ছাত্রলীগের পুলাপাইন মারছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীর ছেলেপেলেরা পাল্টা ধাওয়া দিয়ে আমাকে বাচাইছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ঘটতে থাকলো ঘোরের মধ্যে, গুটিকয়েক আমাকে টার্গেট করে একটা মার্ডার করতে চাইলো, হত্যাকাণ্ডই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য, আতঙ্ক সৃষ্টি করা। মানুষের ভীর ঠেলে আমি দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলাম, এই সন্ত্রাসী হামলার আক্রমণে আমি বহুবার রাস্তায় ছিটকে পড়ি, তারা আমার মোবাইল, মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়, এই মারামারি দেখে আশেপাশে মানুষ জড় হতে থাকে, আমাকে কার আগে কে মারবে বুঝতে পারছে না, কেউ কিন্তু স্পষ্ট করে কিছুই জানে না কি জন্য কারে মারছে, যারা ঝামেলা সৃষ্টি করছে তারা স্বার্থ হাসিল করে ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছে এবং আমার সবকিছু ছিনতাই করে নিয়ে গেছে, তাদের কাউরে এখন আর দেখা যাচ্ছে না, আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে তারা সরকার-পন্থী ছাত্রলীগ ছিল। ততক্ষণে আমার মাথা থেকে রক্ত ঝরছে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমাকে মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে, এমন ভাবে আহত করছে যেন বেঁচে না ফিরি।
হঠাৎ করে উপচে-পড়া জনতার হুশ আসে, তারা আমাকে কেনো মারছে তারা নিজেরাই জানে না, মারার দরকার তাই মারছে। দলের একটা লিডার আমার গলা চেপে ধরে, আমাকে জিজ্ঞেস করে- তোরে কে পাঠাইছে? তুই এখানে কেন? তুই কি ছাত্রলীগ? ততক্ষণে আমার মুখ থেকে শব্দ বের করার মত শক্তি হারিয়ে ফেলছি, যেন জুড়ে গলায় কথা চাইলেও বলতে পারছি না, ছোট্ট করে বললাম- ভাই আমি সাধারণ মানুষ, আমি ছাত্রলীগের কেউ না, গেঞ্জি আর প্যান্টের কয়েক জায়গা ছিঁড়ে গেছে, রক্তে সারা শরীর ভিজে আছে, চোখে অন্ধকার দেখছি, মনে হচ্ছে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছি, এই সব প্রশ্নের মাঝেই হুট করে কোত্থেকে ছেলে একটা এসে আমার বুকে লাথি মারে, তারপরেও আমি অজ্ঞান হয়নি, আমার বারবার মনে হচ্ছিল- আমি বোধহয় কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি, এইটা সত্যি না, আমার বোঝার বাকি থাকলো না, আমি একটা ছাত্রলীগের ফাঁদে পড়েছি। যারা ইতিমধ্যে আমার সবকিছু হাইজ্যাক করে পালিয়েছে।
আমার রক্তভেজা প্যান্টের পকেট থেকে কোম্পানির আইডি কার্ড খুঁজে পায়, অত:পর তারা বুঝতে পারে আমি একজন জার্নালিস্ট, যদিও আইডি কার্ড ভালো করে না পড়েই ট্যাগ দিলো আমি সাংবাদিক, পরে কার্ড হাতবদল হলে বুঝতে পারে আমি একটি গ্লোবাল জাপানি কোম্পানির কর্মকর্তা। আমাকে রীতিমতো ফাঁসানো হয়েছে, তাই অতি-সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণের পর অনুশোচনা থেকে আমাকে দুটি ছেলে ‘ঢাকা হেলথকেয়ার সিস্টেম হাসপাতালে’ নিয়ে যায়, মাথার রক্ত পড়া বন্ধের জন্য দ্রুত সেলাই করা হয়, যদিও শরীরের নানান জায়গায় ক্ষত ছিল। হাসপাতালে বাহিরে উৎসুক জনতা, তারা আরও ভালো করে আমাকে দেখতে চায়, আমি কি বেঁচে আছি না মারা গেছি, তখনও আমার হুশ ছিল, অনবরত বমি করছি, অক্সিজেন মাস্ক পরানো, ক্রমশ শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হতে লাগলো, ডাক্তার ভয় পেয়ে বললো- রুগীর অবস্থা ভালো না, তার দ্রুত উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন, মাথায় প্রচুর আঘাত পেয়েছে, সিটি স্ক্যান ছাড়া কিছুই বলা যাচ্ছে না, আমাদের তরফ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, পরবর্তীতে দু’জন অপরিচিত ছেলে এসে বললো, ভাই আপনাকে ‘এম জেড হাসপাতালে’ নিতে হবে, কোন এম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছে না, একটা সিএনজি রাজি হলো নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে, গাড়িতে ছেলে দুজন আমার দুপাশে বসে পড়লো, হাজারো মানুষের ঢল ভেঙ্গে সিএনজি ছুটে যাচ্ছে হসপিটালের দিকে। যাওয়ার সময় বহু আক্রমণের শিকার হলাম, ছেলে দুইটা পুরো রাস্তা জুড়ে চিল্লাইছে আর বলছে- ভাই রুগী, সাইড দেন ভাই, ইমারজেন্সি রুগী, সাইড প্লীজ।
আমি এখন এম জেড হসপিটালের সামনে, আমাকে রাস্তার পাশেই শুয়ে দিলো, হাসপাতালের ভেতরে কোন জায়গা নেই, প্রচুর আহত মানুষ এই হাসপাতালে ভীর করছে, কিছুক্ষণ পর পর আন্দোলনের কারণে আহত হয়ে মারা যাচ্ছে, একজন তরুণী ডাক্তার এসে আমার পেশার চেক করলো, হালকা-পাতলা গুঁতোগুঁতি করলো শরীর নিয়ে, বাকি যেসব জায়গায় সেলাই প্রয়োজন ছিলো তারমধ্যে ঠোঁটে সেলাই দিতে গিয়ে মনে হচ্ছি আমি এইবার মনে হয় সেন্সলেস হবো, আমার সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেছে। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো- এই হাসপাতালে থাকার চেয়ে বাসায় চলে গেলো ভালো হবে। আমি ছেলে দুজনকে বললাম- দয়া করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেন। আমার বাসায় যাওয়ার পথে আন্দোলনকারী সিএনজি উল্টে আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল, যদিও সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বাসায় পৌঁছে নিজেকে শুধু সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম- মনের জোর বাড়ানোর জন্য বারবার বলছিলাম আমার কিচ্ছু হয়নি, আমি ঠিক আছি, সারারাত ঘুমাতে পারিনি। এতক্ষণ যা সার্ভিস পেয়েছি তার সবই ফ্রি ছিলো। কোটা সংস্কার আনন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আমার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যথেষ্ঠ করছে, তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা সর্বদা অটুট থাকবে। সকালের দিকে বারবার মনে হচ্ছে- আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। আমি নিজেই বাসা থেকে বের হয়ে ফরাজী হাসপাতালে ভর্তি হই, ডাক্তার দেখাই কারণ আমার বাসায় ব্যাংকের চেকবই ছিল, তারা এই চেক নিতে চাচ্ছিল না, এমন কি আমাকে চিকিৎসা দিতে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের হাতেপায়ে রিকুয়েস্ট করে এডমিট হই। দুই ঘণ্টা পরেই আমার কাজিন আসে, তারে দেখার পর আরও ভরসা পাই, তার এই রকম সাহসী পদক্ষেপ দেখে আমি মুগ্ধ হই, সমস্ত পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে আমার এলাকায় ঢুকতে পারছে তা ভেবেই আমার বুকটা গর্বে ভরে উঠেছিলো, কারণ সেদিন কড়া কারফিউ ছিল।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাহিরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, আমার শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগলো, আমি যা খাচ্ছি তাই বমি করে দিচ্ছি, এমনকি নর্মাল পানি খেলেও বমি হচ্ছে, ফাহিম বললো- ভাই তোমাকে দ্রুত হসপিটালে নেওয়া উচিৎ, শরীরের অবস্থা ভালো ঠেকতেছে না, আমি বললাম, আমারও তাই মনে হচ্ছে, আমি শারীরিক প্রচণ্ড ব্যথায় মারা যাচ্ছি। দেশের পরিস্থিতি থমথমে বিরাজ করছে, বহু আক্রমণ আশংকা পেরিয়ে বসুন্ধরা এভারকেয়ার হসপিটালে যাই, সেখানে ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্টে কথা বলি, তারা মুখের উপর সার্ভিস দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তারা জানায় আন্দোলনকারী কাউকে এই হসপিটালে এডমিট করা যাবে না, সরকারের উপরমহল থেকে চাপ দিচ্ছে যেন আন্দোলনকারী কেউ চিকিৎসা না পায়, বরং কোন প্রকার চেকাপ ছাড়াই তারা নয়-ছয় বুঝ দিয়ে আমাদের তাড়িয়ে দেয়, আমি তখন বড় চাচার নির্দেশনা পাই, তিনি বললেন ইবনে সিনা হসপিটালে যেতে, তাছাড়া সরকারি ভাবে নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপক করা হয়েছে প্রতিটি হসপিটালে, কোন প্রটেস্ট বা আন্দোলনকারীকে চিকিৎসা দিলেই প্রশাসনিক সিভিল লোক এসে মামলা ধরিয়ে দিচ্ছে, এই ভয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না, সামান্য মেডিকেল সুবিধা না পেয়ে বহু ছাত্র আন্দোলনকারী মারা যায়।
আমার কাজিনকে সাথে নিয়ে গাড়ি করে ইবনে সিনা হসপিটালের দিকে রওনা করি, ঢাকা মহাখালীকে মনে হচ্ছে একটা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত শহর। শুধুমাত্র ভালো চিকিৎসা পাওয়ার জন্য আমার ডাক্তার রাহাত ভাই এবং তার স্ত্রী কলি ভাবির রিকুয়েস্ট আমাকে হাসপাতালে ভর্তি নেয়, রাতে মাথা কামানো হয়, আমি গোসল করি, তারপর হামজা চাচ্চু নানান ফল ফ্রুটস নিয়ে আমাকে দেখতে হাজির হয়। তিনি খুবই আন্তরিক একজন মানুষ, সব সময়ই আমার পরিবারের পাশে ছিল, আমাদের খুব খারাপ সময়গুলোতে উনাকে পাশে পেয়েছি। আমার সুস্থতার জন্য প্রতিটা মানুষ আল্লাহর রহমতের ফেরেশতার মত কাজ করছে। এইদিকে আমার শরীর আরও খারাপ হতে থাকে, কিডনি প্রায় ড্যামেজ পর্যায়ে চলে গেছে, আমি ইবনে সিনায় সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছি না, তারপরের দিন রাতে আমার বাবা আর রাহাত ভাই মিলে স্পেশালাইজড হসপিটালে ভর্তি করায়, আমার বাবা ডাক্তারের কাছে সর্বোচ্চ চেষ্টা আর চোখের জলের বিনিময়ে আমাকে অবশেষে এডমিট করায়, যেন এক প্রকার ডাক্তারের কাছে আমার বাবা প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে। কারণ তাদের একটাই কথা কোন সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীর চিকিৎসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমার আত্মীয় স্বজনের সবার দোয়া আর অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমি আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছি, দীর্ঘদিন আইসিউতে জীবন মরণ লড়াই করে বেঁচে ফিরে আসছি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন ফ্যাসিবাদী সরকার। তার পতনের মধ্যে দিয়ে আমি এবং আমার বাংলাদেশ আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমরা আরও একবার স্বাধীনতা অর্জন করলাম। জয় বাংলা, আমার বাংলাদেশ চিরঞ্জীবী হোক, আমার মাতৃভূমিকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। একই সাথে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আশাকরি আগামীর দিনগুলোতে দেশের সংকটময় মুহূর্তে পুনর্গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখবেন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- ছাত্র আন্দোলনে যতগুলো হত্যাযজ্ঞ ঘটছে তার অধিকাংশ ছাত্রলীগ করছে, তারা এতদিন পুলিশের ছত্রছায়ায় টিকে ছিল। যদিও বাংলাদেশের পুলিশ যে খুব রসগোল্লা তাও না। চান্স পাইলে সাধারণ মানুষকে হেনস্তা আর অপদস্থ করতে দ্বিধা করে না, এই দেশের মানুষের বিবেক মূল্যবোধ নেই বললেই চলে, যেমন মানুষ তেমন পুলিশ। কারণ এতবড় সহিংসতার পরেও মানুষ আওয়ামীলীগের জন্য মায়াকান্না করে মিছিল করছে, হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আনতে চায়। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত দেশের অর্ধ-কোটি মানুষ, আগে এদের চিকিৎসা প্রয়োজন। যেই পরিমাণে পুলিশের উপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ জন্মাইছে তা এতো সহজে শুধরাবে না। সুযোগ পেলে রাস্তাঘাটে পুলিশকে একা পেলেই সুদেআসলে ইতিহাস বুঝিয়ে দিবে। একটা সহজ উপায় হচ্ছে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে জনসম্মুখে কিছু ভালো কাজ করে মন জয় করা, তারপর ধীরেসুস্থে মাঠে নামা উচিৎ হবে।
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন দেখে বুঝলাম বঙ্গবন্ধুকে কেনো গুলি করে হত্যা করছে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ – “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”। হে সুশীল নাগরিক সমাজ, তোমাদের হাতে ছাত্র শিশুদের রক্ত লেগে আছে। প্রতিটি হত্যার ছাপ এখনো জলজ্যান্ত, তোমরা প্রত্যেকই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খুনি। দীর্ঘ যুগের পর রেজিম হাসিনার চরম পতন ঘটলো। আমাদের ভাইবোনের দীর্ঘ ত্যাগের বিনিময়ে নতুন করে স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। বর্তমানে দেশ এখন সম্পূর্ণ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, দেশের প্রতিটি খাত পুনরুজ্জীবিত করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে, একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ মিস্টার ইউনূস যেভাবে দায়িত্ব নিলেন, মনে হচ্ছে দেশের মানুষ বহু বছর পর নিজেদের ভালোবাসা ফিরে পেয়েছে। আরও একবার অনুভব করলো- মুক্তভাবে কথা বলার বাক-স্বাধীনতা, আইনের সুশাসন আর সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন।
এছাড়া রাজনৈতিক আলোচনার বড় উপাত্ত বিষয় এখন- সাত বোন রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্স নামেও পরিচিত। এই সাত রাজ্যের মধ্যে জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও অনেক আগে থেকেই এরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সদৃশ। সেভেন সিস্টার্স সহ কলকাতা, মায়ানমার, নেপাল-ভুটান আমাদের হয়ে যাক। বর্ডার বিহীন দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখছি বহু দিন থেকে, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না- জাতীয়তাবাদী কিংবা ধর্মান্ধ আওয়াজ তুলে রাষ্ট্র নিজের পেছনে মানুষকে জমায়েত করতে চায়, সংঘাত আর বৈরিতার দেয়াল তুলতে চায় জনগণের মধ্যে। কিন্তু সব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ অভিন্ন।
সব দেশে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও আমরা যারা অভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করি, তারা মানুষের জীবনকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন বিচার করি। আর তাই প্রকৃতি-পানি-মাটি রক্ষা আমাদের কর্তব্য জ্ঞান করি। আমাদের কাছে শিক্ষা-চিকিৎসা অধিকার, ব্যবসায়ীর পণ্য নয়। আমরা নদী, পানি, বন ও খনিজ সম্পদকে আমাদের সবার সম্পত্তি মনে করি; এগুলো কোনোভাবে মুনাফাখোরদের হাতে যেতে দিতে চাই না। আমাদের কাছে মানুষের মর্যাদা সবার ওপরে, লিঙ্গ বা ধর্ম বা বর্ণ বা ভাষা বা জাতি নয়। আমরা মনে করি, এই বিশ্বে মানুষের জন্য সম্পদের কোনো অভাব নেই, কিন্তু লুটেরা দস্যুদের জন্য সেই সম্পদ মানুষের হাতছাড়া অথবা বিপর্যস্ত। তাদের দখল লোভের জন্যই যুদ্ধ সংঘাত নিপীড়ন আর এই রাষ্ট্রব্যবস্থা। এর বিরুদ্ধে মানুষের দক্ষিণ এশিয়ার কণ্ঠ অভিন্ন, জীবন ও মরণ অভিন্ন লক্ষ্যে নিয়োজিত।
আশার কথা এই যে মানুষ নির্দিষ্ট মডেলের পতনে থেমে নেই, সব দেশেই জনগণের বিভিন্ন মাত্রার লড়াই আছে জল-জমি-জঙ্গলের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, লড়াই আছে কর্পোরেট আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে, লড়াই আছে শ্রেণি, জাতি, ধর্মীয়, লিঙ্গীয় নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে, লড়াই আছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে। এসব লড়াইয়ের মধ্যে যে ঐক্যসূত্র আছে, তা থেকেই আমরা একটি মুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি, যেখানে কর্পোরেট স্বার্থ নয়, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের নতুন চেহারা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। গণতন্ত্র, সাম্য ও মর্যাদা নিয়ে নতুন ইতিহাস পর্বে প্রবেশ করবে এই এলাকার মানুষ। কিন্তু এর জন্য জনগণের লড়াই ও মুক্ত চিন্তার যে সংহতি দাঁড় করা দরকার, সেখানে বড় ঘাটতি আছে।
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার দুরূহ অবস্থা। স্কুল-কলেজের বই পুস্তকে আমি কখনো আগ্রহ পাইনি। আমার গল্প, উপন্যাস আর কবিতা পড়তে ভালো লাগে। শিক্ষকদের প্রতি আমার তেমন আলাদা কোন অনুভূতি নেই, টিচাদেরকে টিউশন ফি না দিলে পরীক্ষায় ফেল করাই দিতো, তাদের দ্বারা আমি নানানভাবে অপদস্ত হইছি, যেনো ব্যবসায়ীক দোকান খোলে বসছে, আমরা কাস্টমার, তাদের গোয়ালঘরের কতগুলো গরু, বাধ্যের মত কাঠামোগত সংস্কার শিখাচ্ছেন আর আমরা অজ্ঞের মত গলাধঃকরণ করছি।
আমি কখনো রাজনীতিতে আসতে চাইনি, স্বয়ং রাজনীতি আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে বুঝিয়েছে; রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি ছোট থেকে পারিবারিক-ভাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে কঠোর নিষেধাজ্ঞায় ছিলাম। বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাকে বিশ্বজিৎ এর মতো হত্যা করতে চেয়েছিলো, তখনো কাউকে ভয়ে কিচ্ছু বলিনি। হতাহতের পর হাসপাতালে সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে- এতো জখম কিভাবে হলো, কারা আমাকে মারছে? প্রত্যুত্তরে বলছি- আমাকে টোকাই আর ছিনতাইকারী আহত করছে, কারণ আমি চাইনি জুলুম স্বৈরাচারী হাসিনার ফাঁদে আমার পরিবারের কোন ক্ষতি হোক। তারপরেও আমাকে আইসিউতে একদল যুবলীগ ডাক্তার টেকনিক্যালি মার্ডার করতে চেয়েছি, মা-বাবার দোয়ায় বেঁচে ফিরে আসছি।
সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে দেশ এখন ইউনুসের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের দুর্নীতি আর শাসন ব্যবস্থায় কোনপ্রকার অনিয়মের প্রতি আর আপোষ চলবে না, প্রয়োজন হলে জীবন দিবো, দেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে অটল থাকবো। আমি আওয়ামীলীগ, বিএনপি জামাত বুঝি না, আমি দেশের মানুষ বুঝি। আমার বাংলাদেশ ভালো আছে মানেই আমি ভালো আছি।
না, আমি আসিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই,
তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি ।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ,
দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে-কোষে যারা পুঁতেছিল আমাদেরই আপন জনেরই লাশ,
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে,
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের।
-শামসুর রাহমান।