হাতের পেপার ওয়েটটার ওজন একটু বেশিই মনে হচ্ছে ডাক্তার হাফিজ এর। একটি সরকারি মানসিক হাসপাতালে ৩ বছর ধরে কর্মরত আছেন তিনি।কেস হিস্ট্রি টা আরেকবার পড়ার জন্য হাতে নিলেন।বাইরে দমকা হাওয়া বইছে। কালো মেঘগুলোর মতই ছড়িয়ে পড়ছে দুশ্চিন্তা তাঁর নিউরনে।
দেড় বছর আগের একটা দিনে ফিরে গেলেন তিনি-হসপিটাল এর রুম নং: ১৪৩,যেসব মাথার কলকব্জাগুলো অচল হয়ে গেছে তাদের ই একজনকে রাখা হয়েছে সেখানে।সেই বছর দেড়েক আগে,কোন অচেনা একজন রাস্তা থেকে তুলে দিয়ে গেল একে-আর কেউ কম্মিনকালেও দেখতে আসেনি ।হয়তো লোকটার কেউ নেই-ভেবেছিলেন তিনি। পাগলটার ছেড়া পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগে পাওয়া একটি ফটোগ্রাফ এর পেছনে লেখা ছিল রুদ্রনীল- এই মাথা খারাপ লোকটার ই ছবি সেটা।তাই দেখেই রেজিস্ট্রি করেন হাফিজ সাহেব-“রুদ্রনীল-১৪৩ নং রুম।” ৩৪ সাঁটা বদলে দেওয়া পোশাকটা পড়িয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঘরটায়। দেড় বছরে একটুও উন্নতি হয়নি- বরং বেড়েছে পাগলামি।রুদ্র নামটাও হারিয়ে গেছে তার নাট বল্টুর সাথে সাথে।”পাগলা নাম্বার ৩৪”-এভাবেই ডাকা হয় তাকে এখানে।
কেস হিস্ট্রিতে ৩৪ নাম্বার রোগীর অতীত ব্যাপারগুলো লেখা নেই। তার আচরণ অ্যানালাইসিস করে ওষুধ থেকে শুরু করে শক ওয়েভ সবই চেষ্টা করা হয়েছে।কাজ হয়নি তেমন।ডা. হাফিজের মনে পড়ে যায় প্রথম চেক আপের দিনটা… রুদ্রনীল বসেছিল এক কোণায়। তিনি কাছে গিয়ে দেখেন বাতাসে অনবরত গিট্টু দিচ্ছে সে-
“-কী করছেন?
-গিট্টু লাগাই। শক্ত কইরা গিট্ না দিলে সব চইলা যাইব।সব সব যাইব..সব যাইব…
-কী বাঁধছেন?
-এই যে প্রথম টায় বানতেছি সুখ, দুই নাম্বারটায় ভালোবাসা আর তিন খানের টায় নী…”
এই পর্যন্ত বলেই রুদ্রনীল হঠাতৎই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছিল।
কথাটুকু শেষ করেনি-কিংবা করেছিল, তার জান্তব চিত্কার বুঝতে দেয়নি ডাক্তারকে হয়তো।এরপর অনেকগুলো সেশন গেল। পাগলটা এখন ও গিট্ লাগায় বাতাসে- সুখ বাঁধার চেষ্টা করে। নী কথাটুকু কোনোদিন পূর্ণ করেনি রুদ্র তার সামনে।
ডা. হাফিজ জানেন না-রুদ্র প্রায় ই বিড় বিড় করে “নী মানে হইল নীরা। নীরা জানি কে? কে জানি? নীল শাড়ি,না না লাল ওড়না? কে কে?”
অতি প্রিয় সেই মুখটার আদল অস্পষ্ট ভাবে আসে তার সামনে-আবছা ঘোরে রুদ্রের কানে কথা আসে –“রুদ্র,তোমাকে সুখ বেঁধে দেব-ভালোবাসার দড়ি দিয়ে…”
মরচে পড়া স্মৃতি টা চাড়া দিলেই সে বসে যায় গিট্টু দিতে। নীরার কথা বলবে না সে সুঁই অলা মানুষটাকে। বড্ড জ্বালায়-গিঁট দেওয়ার সময়, নীরার কথা মনে হলেই তো সব ওলট পালট হয়ে যায় তার। নীরাটা যেন কে? কী যে হয় তার-কিচ্ছু মনে থাকে না তার। তারপর রুমে আর চার কুঠুরিতে ভাংচুর চলে।
পাগল নং ৩৪ কে শিকল পড়িয়ে রাখা হয় এখন। ডাক্তার এ কথা জানেন। গিট্টু উপাখ্যান জানেন না তিনি,নীরা রূপকথাও তার অজানা। হাত পায়ের বদলে চার কুঠুরিতে মায়া নামক শেকল শূন্যতা তাই তার চোখে পড়েনি। গুপ্তধনের খোঁজ কে কাকে দেয়? রুদ্র ও দেয়নি।তাই নী পর্যন্ত বলেই থেমে যায় সে।
ডা. হাফিজ বেশ খেয়াল করেছেন বৃষ্টির দিনে রুদ্রের পাগলামি বেড়ে যায়। না,বর্ষাকাল নয়-যে কোনো বর্ষার দিন-যাচ্ছেতাই অবস্থা হয় তার। কাছেই যাওয়া যায় না। প্রায় বর্ষাকাল তাকে খাটের সাথে বেঁধে রাখা হয়। ডা. হাফিজ চিন্তিত-সেপ্টেম্বর এর সকালে আকাশে মেঘ হানা দিয়েছে হঠাৎ। ভোর বেলা কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না-৩৪ নং কে বেঁধে রাখা দরকার।।
ওদিকে ১৪৩ নং রুমে,ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশ দেখে রুদ্র-হাতে পায়ে শেকল।দুষ্ট লোকের কাজ। কিন্তু কালো কালো জিনিসগুলো যেনো কী! পানির মত ওগুলো কেমন যেন শব্দ করে-রুম ঝুম না না রিম ঝিম.. উফ্ফ রিন ঝিন রুম ঝুম… কত কাল আগে, সে নীরার হাতে এমন মেঘলা দিনে পড়িয়েছিল এক গোছা চুড়ি।নীরা হাত নেড়ে বজ্রনাদ ঢেকে দিয়েছিল-তখন রুদ্র জানত ঐ রিন ঝিন মানে ভালোবাসা। এখনকার পাগল নং ৩৪ এর কানেও উঠেছে সেই রিনঝিন সিম্ফনি।।
“নীরা-রিনঝিন”,বিড় বিড় করতে করতেই হাত দু’টো দিয়ে মাথায় চাপড়ে দেয় নিজের- শিকলের ঝন ঝন শব্দ তার ময়লা জমা কানে ঝিন ঝিন করে ওঠে।
“ডাকতর সাব,আইসা দেখেন পাগলায় কী করতাছে?”-কর্মচারীর এই ডাকে মোটামুটি নিশ্চত হয়েই ১৪৩ নং রুমে ছুটে যান হাফিজ সাহেব। পাগলটা তখন শিকল দিয়ে মাথা চাপড়াচ্ছে। মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে তার..কিন্তু হাফিজ সাহেব দাঁড়িয়ে শুনছেন-
“ রুন ঝুন রিম ঝিম,রিম ঝিম রুন ঝুন..”
একমনে বকে যাচ্ছে পাগলটা আর শিকল দিয়ে রক্তাভ ক্যানভাসের গাঢ়ত্ব বাড়াচ্ছে।।
ব্যাকগ্রাউন্ডে বৃষ্টি ছিল।সময়ের মঞ্চে পাগলের পার্টে ছিল রুদ্রনীল,আখ্যানভাগ না জানা দর্শক ছিলেন হাফিজ সাহেব।
আরও একজন ছিল মুখ্য ভূমিকায়-সে নীরা।।
আড়ালে থাকা নীরা কি জানত???
২৪টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
একবারেই পড়ে ফেললাম আপনার লেখাটি। লিখতে জানেন আপনি, আপনার লেখা দুটো পোস্টেই আপনি এর প্রমাণ দিলেন। দুটো লেখাতেই আপনার লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম ভাইয়া। লেখুন নিয়মিত এখানে।
নীহার
ধন্যবাদ ভাইয়া,চেষ্টা করব নিয়মিত লেখার… 🙂
ব্লগার সজীব
আপনি প্রতিশ্রুতি রাখছেন, ধন্যবাদ আপনাকে -{@
অনিকেত নন্দিনী
শক্ত ও আকর্ষণী লিখনি। প্রথম পাঠেই ভক্ত হয়ে গেলাম।
শুভকামনা রইলো। -{@
নীহার
আপনার প্রশংসায় পুলকিত,আনন্দিত তথা হর্ষিত… ধন্যবাদ আপু… \|/
জিসান শা ইকরাম
পাগলা গারদে এক সময় এদের আর নাম থাকে না, কক্ষ বা রোগী নাম্বার হয়ে যায় এদের নাম।
আপনার লেখায় পাঠকদের ধরে রাখতে পারেন আপনি,
প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত লেখায় কোনো ছন্দ পতন হয়নি।
পাঠকদের দুর্ভাগ্য যে আপনাকে রেগুলার পাচ্ছেন না তারা।
শিকল দিয়ে রুন ঝুন রিম ঝিম,রিম ঝিম রুন ঝুন.. শব্দ অন্য রকম আবহ এনে দিয়েছে লেখায়।
শুভ কামনা -{@
নীহার
নিরন্তরব ধন্যবাদ আপনাকে… নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করব… :3
লীলাবতী
গল্প এমনই হওয়া চাই। মনে হচ্ছে যেন বাস্তব। কল্পনা করে এমন লেখা যায়! আপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম মনে হচ্ছে। আমাদের সোনেলা পরিবারে স্বাগতম আপনাকে -{@
নীহার
হয়তো বাস্তবই… হয়তো না…
নিরন্তর ধন্যবাদ আপনাকে… 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
খুউবই ভালো লেগেছে। অসাধারণ লিখনী আপনার।
নীহার
অসংখ্য ধন্যবাদ… 🙂
ইলিয়াস মাসুদ
আগের লেখাটাও পড়েছিলাম,অনেক দিন মনে থাকবে
এই লেখাটাও তেমন
খুব ভাল লেখা 🙂
নীহার
অসংখ্য ধন্যবাদ… 😀
খসড়া
নীরা অক্ষরগুলি উল্টালেই রানী। রানীরা হয় অনুভূতিহীন হাতপা বাঁধা এক বস্তু যার নিজের কিছুই নেই সবই অন্যের। পথের ধারে দরিদ্র বালকারও নিজের একটা মন থাকে নিজের শরীর থাকে। রানীদের তাও থাকে না।
নীহার
আমার এই রানীর সবই ছিল… সে বদলে গেছে… 🙂
মোঃ মজিবর রহমান
অপূর্ব কথামালায় লেখেছেন অসম্ভব এক গল্প জাতে আছে পাঠককে মন বসিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়া র দায়ীত্ব দারুনভাবে কলমের ডগায় তুলে এনেছেন।
নিরন্তর শুভেচ্ছা।
নীহার
আপনার প্রশংসা চলার পথে উতসাহ দিয়ে যাবে… ধন্যবাদ… 🙂
মোঃ মজিবর রহমান
ভাল লিখুন পড়ার ইচ্ছে সবসময় আমি পড়ি লিখতে পারিনা।
মৌনতা রিতু
অপূর্ব কথামালা সাজালেন। আসলেই পাগলাগারদে পাগলদের আর নিজস্ব নাম থাকে না। পায়ে শিকল, হাতে শিকল, একটা ছোট কামরা, এ যেন চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী। আমি পাবনা পাগলাগারদ দেখতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে নিজেকে বড় অপরাধি মনে হয়েছিল। মনে হল, তারা কি চিড়িয়াখানার ভয়ঙ্কর কোনো জানোয়ার? হয়ত যাদের অনুভূতি আছে, তারা আমায় দেখে ভাবছে,”দেখতে এসেছ? কি দেখতে এসেছ? আমরা কেমন উদ্বট? ফিরে যাও তোমাদের সভ্য জগতে”।
আমি ওখানে একজনের দৃষ্টিতে আসলেই কি যেন দেখলাম!
যাইহোক, সুন্দর লেখনি আপনি।
নীহার
সেই ব্যাকগ্রাউন্ড টা কেউ তো জানিনা… প্রত্যেক পাগলের পেছনের পাগলামির ইতিহাস টা জানা গেলে হয়তো আর ঐ শিকল এর দরকার পড়ত না… 🙁
নীহার
সেই ব্যাকগ্রাউন্ড টা কেউ তো জানিনা… প্রত্যেক পাগলের পেছনের পাগলামির ইতিহাস টা জানা গেলে হয়তো আর ঐ শিকল এর দরকার পড়ত না… 🙁
মেহেরী তাজ
এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলেছি আপু! লিখুন নিয়মিত! অনেক অনেক অনেক ভালো লেগেছে!
নীহার
অসংখ্য ধন্যবাদ… 🙂
অপার্থিব
ভাল লেগেছে লেখা। চালিয়ে যান নিয়মিত।