পৃথিবীর পথে পথেঃ ইটালি ,মাউন্ট ভিসুভিয়াস ,ভ্রমণ ,কাহিনী পম্পের মৃত ব্যাক্তির সলিড মমি
পম্পেই ,ক্যাফ্রি আইল্যান্ড এবং মাউন্ট ভিসুভিয়াস (ইটালি) সাল ২০১২
” Volcanoes are nature’s way of reminding us how small we are”
ভিসুবিয়াস এর জ্বালামুখ থেকে গ্যাস দেখা যাচ্ছে
আমাদের ট্র্যাভেল পরিবার গ্রুপের এবারের গন্তব্য পম্পেই । ইটালি লন্ডন থেকে বেশি দূরে নয় । ৩ ঘণ্টার ফ্লাইট । প্লেনে চেপে বসলাম । ইটালির নেপলেস ছিল আমাদের ল্যান্ডিং এরিয়া। আগে থেকেই বুকিং দিয়ে একটা ভিলা রিজার্ভ করা ছিল। যা মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের একেবারে কাছে। ভিলার এক জানালা দিয়ে দেখা যায় সমুদ্র আর এক জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো জানালা ঘেঁষা পাহাড়ের দেয়াল। সমুদ্রের পানি ঘন নীল ।আমরা হোটেলের ম্যানেজারকে বললাম আমরা কি কি দেখতে চাই । ম্যানেজার সব কিছু এরেঞ্জ করে দিলো । পরের দিন সকালে আমরাকে নিয়ে যাবে এক গাইড তার বিরাট কোচে করে। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর আমাদের গাইড নেপলেসের সব হোটেল থেকে টুরিস্ট তুলে নিয়ে সে চললো পম্পেই এর উদ্দেশ্যে । গাইড ইটালিয়ান ইংলিশ স্পিকিং একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হাসি খুশি গাইড।
যেতে যেতে সে আমাদের কে দুই পাশের দৃশ্য আর স্পট দেখাতে দেখাতে আর তার বর্ণনা দিতে দিতে নিয়ে চলল । কি ভাবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতের টুরিস্টকে একত্রে আনা যায় এবং তাদের খুব কাছে টানা যায় সে ব্যাপারে সে ছিল খুবই অভিজ্ঞ । গাইড হিসাবে তার ছিল ভালো ট্রেনিং । তার উপরে তার ছিল , পম্পেই এর ইতিহাস এবং ভিসুভিয়াস এর উদগিরন সম্বন্ধে অনেক নলেজ ।
আমাদের বিরাট টুরিস্ট এর দলটিকে সে ভালো ভাবে তো সব কিছু দেখালই এবং বর্ণনা দিলো নিখুঁত ভাবে । যথা সময়ে আমরা এসে পড়লাম পম্পেই শহরে । যা কিনা ঢাকা পড়েছিল শত শত বছর ধরে মাটি চাপা দিয়ে।আর সেই মাটি বা ছাই উদ গিরন হয়ে ছিল মাউন্ট ভিসুভিয়াস থেকে। আমরা গাইড কে ফলো করতে করতে দেখতে লাগলাম আর সেই ভয়াল আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাতের পরিণতি অনুধাবন করতে লাগলাম।
১৭০০ সালের দিকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে পড়া এই গ্রীসিও রোমান শহর টি মানুষ আবিষ্কার করে।এখানে প্রায় ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ মানুষ বসবাস করতো। পুরো শহরটি প্রায় ২৩ ফিট পর্যন্ত ছাই, লাভা আর ডেবরী দিয়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ।
পম্পেইঃ
পম্পে ইটালির এক প্রাচীন শহর যা কিনা প্রিজার্ভ হয়ে আছে মাউন্ট ভিসুভিয়াস থেকে উৎগারিত ভস্ম, গলিত লাভা আর পাথর আর পাথরের গুঁড়া দিয়ে গভীর মাটির নিচে ঢাকা পড়া এক সিটি, শত শত বছরে ধরে এটি এভাবেই ছিল । এটা নেপলেস থেকে দক্ষিণে ১৪ মাইল দূরত্বে ।
৭৯ CE, আগস্টের ২৪ তারিখ দুপুর বেলা। চারদিকে মানুষ যে যার কাজে ব্যাস্ত কেউ বুঝতেই পারিনি কি ভয়াবহ কাণ্ড তাদের জন্য অপেক্ষা করছে । হটাৎ করে বিরাট এক ভলকানোর আগুন, কালো ধোঁয়া, গ্যাস, ডেবরি পাথর, ছাই আর গলিত লাভা বের হতে লাগলো তাও আবার বিরাট আকারে। চার দিক অন্ধকারে ডুবে গেলো। কিছু মানুষ এর থেকে জীবন বাঁচাতে সমুদ্রের দিকে দৌড় দিলো কিছু ঘরের মধ্যেই আশ্রয় নিলো । কিন্তু যে যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে পড়ে মরে গেলো। এক দল মানুষ একেবারে সমুদ্রের কাছে সমুদ্র পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল ।সেখানে কোনো লাভা যায় নাই কিন্তু তবুও তাদের মৃত্যু হয়। কারন বিষাক্ত গ্যাস আর ধুঁয়া ।
সমস্ত ঘর বাড়ির ছাদ ভেঙ্গে পড়েছিল। পুরো শহর ছাই আর pumice দ্বারা ঢাকা পড়ে যায়। ছাই আর ডেবরির পরিমাণ এতো বেশি যা ২৫ মিটার পর্যন্ত গভীর।
শতাব্দীর পর শতাব্দী এগুলো মাটির তলেই পড়ে থাকে এবং মানুষের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তবে ১৭০০ সালে এই গ্রীসিও রোমান সিটি টি মানুষ আবিষ্কার করে । যা ছিল মাটির অনেক নিচে। এখানে আবিষ্কার হয় পাবলিক বিল্ডিং, ধনী মানুষের ভিলা, এমফি থিয়েটার ,বাজার ,রেস্টুরেন্ট রাস্তা, পাবলিক বাথ আর সারী সারী মানুষের মৃত দেহ। যা কিনা ছাই সিমেন্টের মতো শক্ত হয়ে মানুষের আকার ধারণ করে আছে । কেউ বসা, কেউ বাচ্চা কোলে, কেউ হামাগুড়ি দেয়া অবস্থায় যে যেখানে যেমন অবস্থায় ছিল তেমন অবস্থায় মারা গেছে। বেকারি রুটি বানাচ্ছে এবং তার রুটি ওভেনের মধ্যেই রয়ে গেছে। পম্পেই সার্ন নদীর মহোনায় । পম্পেই এর কাছাকাছি আরও কিছু শহর যেমন হেরাকুলানিয়াম, স্তাবিরাক , টরে, আনুনবিয়াটা ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়। ১৯৯৭ সালে পম্পেই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে অন্তর্ভুক্ত হয়।আমরা সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর ভাঙ্গা ঘরবাড়ি গুলো দেখতে দেখতে অগ্রসর হচ্ছিলাম ।
সবকিছু দেখার পর এটাই মনে হল আমারা এই পৃথিবীর মানুষ প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায়।
মাউন্ট ভিসুভিয়াসঃ
পম্পেই দেখার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মাউন্ট ভিসুভিয়াস । কোচে উঠেপড়লাম আর কিছু দূর যাওয়ার পর আমরা এসে গেলাম সেই ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরির কাছে।যা নেপলেসের কাছাকাছি। যা কিনা জীবন্ত এবং প্রায় প্রতি বছর একবার করে উদগিরন হয়। তবে খুব ভয়ঙ্কর ভাবে অগ্নুৎপাত হয় মাঝে মাঝে। যেতে যেতে কিছু দিন আগে বের হওয়া লাভার প্রবাহ দেখতে পেলাম। যা কালো আর শক্ত হয়ে গিয়েছে। উপর দিয়ে লাভা প্রবাহের ঢেউ খেলানো দৃশ্য এখনো রয়ে গেছে। এতো বেশি শক্ত লাভা যে তেমন গাছ পালা জন্মাতে পারেনা। আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগুতে থাকলাম উপরের দিকে জ্বালানী মুখের কাছে। এখানে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় নাই। কিছুদূর যাওয়ার পর আর একটা ঘাসও চোখে পড়লো না ।শুধু কালো ছাই আর কয়লার গুঁড়ার মতো ডাস্ট । হাইকিং করতে করতে আমরা উঠতেই আছি উপরে । পুরো মাউনটেনের উচ্চতা ১২৮১ মিটার । তবে যতবার অগ্নুৎ পাত হয় ততবার এর উচ্চতা এদিক ওদিক হয়। প্রায় ২/৩ মাইল হাঁটার পর আমরা একেবারে জ্বালানী মুখের কাছে এসে পড়লাম । সে এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি। কারন এখনও সেখান দিয়ে ক্রমাগত ধোঁয়া বের হচ্ছে। এটা একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালা মুখ আর যেখান দিয়ে আগুন,লাভা,আর ডেবরী বের হতে পারে যখন তখন। ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে হাজার হাজার টন লাভা আর ডেবরী বের করে। আর যে কিনা একটা শহরকে ধংষস্তুপে পরিণত করেছিল।
মনে মনে খুব ভয় লাগছিল ।আমরা মাথা বাড়িয়ে cratea বা জ্বালামুখের ভিতর দেখছিলাম,চারদিকে ঘুরে ঘুরে ।
ভয় লাগছিল এই বুঝি শুরু হবে প্রলয়ঙ্কর জ্বলন্ত লাভার উৎগিরন ।তবে এখন অনেক টেকনোলজি বের হয়েছে যা কিনা আগাম বার্তা দিয়ে মানুষকে সচেতন করে। আমরা দেখলাম সেই টেকনোলজির কারবার । অর্থাৎ বিরাট বিরাট মেশিন বসানো আছে আর সেগুলো পর্যবেক্ষণ করছে একদল বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ারর দল একটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে । তাদের কাজ কেমন অবস্থায় আছে এর গভীর উদগিরনের অবস্থা বা কখন তা বেরিয়া আসবে এই সব ব্যাপার।
অনেক টুরিস্ট সেখানে ভিড় করে দেখছিল ।আমরা অনেক ছবি নিলাম । তারপর নামার পালা । সেই ছাই আর ডেবরীর পথ বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে থাকলাম ।
৭৯ CE পর থেকে ১০৩৭ সাল পর্যন্ত আরও অনেকবার অগ্নুৎপাত হয়। সেগুলো ২০৩,৫১২,৬৮৫,৭৮৭,৯৬৮,৯৯১,৯৯৯এবং ১০০৭ সালে । ৫১২ সালের টা খুব বড় ছিল । ১৬৩১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর একটা ভূমিকম্প এবং অগ্নুৎপাত দুইটা একসঙ্গে হয় এবং এর লাভা গড়িয়ে সমুদ্র পর্যন্ত যায় ।তখন ৩০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ।
Cratea বা জ্বালামুখ দুই ভাবে ওপেন হয়। ১) eruptire ২) quieseent । গাইড বুঝিয়ে দিলেন quieseent এর সময় জ্বালামুখ এতো বেশি বড় হয়ে যায় যে তখন সেখান থেকে টন কে টন অনর্গল লাভা গ্যাস, ডেবরী আর আগুন বের হতে থাকে সারা দিন ধরে।
৭৯ ce সালে পম্পেই কে ধ্বংস করা বিশাল অগ্নুৎপাত এর বিষদ বিবরণের বর্ণনা দিয়েছিল বেঁচে যাওয়া এবং কাছ থেকে দেখা লেখক pliny the younger তার দুই পাতার এক চিঠিতে, ইতিহাসবিদ Tacitus এর কাছে। যা বিখ্যাত হয়ে আছে এখনো ।
কাফ্রি আইল্যান্ড ( নেপলেস ,ইটালি )
পম্পেই আর ভিসুভিয়াস দেখে আসার পরের দিন আমাদের গন্তব্য ছিল কাফ্রি আইল্যান্ড । আমরা সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে নেপলেসের কাছে মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের বে এর কাছে জেটিতে গিয়ে কাফ্রি যাওয়ার জন্য একটা সুন্দর ফেরির টিকিট করলাম । কাফ্রি আইল্যান্ড ১৬ natical মাইল দূরে যেতে ৫৮ মিনিট লাগে । এই সমুদ্র এখানে ‘টাইফ হোলি সী’ নামে পরিচিত । টুরিস্টদের একটা ডে ট্রিপের মধ্যে পড়ে। খুব সুন্দর একটা দ্বীপ । উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ । আমরা একটা ঘোড়া টানা গাড়ী নিয়ে চার দিক দেখে বেড়ালাম। সবচেয়ে উঁচু চূড়াটি ৩২৭ মিটার উচ্চতার । এখানে একটা ভিলা আছে। এখান থেকে পুরো ক্যাফ্রি আইল্যান্ড এবং মাউনট ভিসুভিয়াস দেখা যায়। বেশ কিছু পাখি যেমন রবিন ,ব্ল্যাক বার্ড , কয়ালস , ফ্যাল্কন , কাঠ ঠোকরা এবং মুলেট চারদিকে দেখা যায় আর নিচে লম্বা সিঁড়ি দিয়ে নামলে দেখা যায় নানা রকমের মাছের দল। চার দিকে ফুলের বাগান আর ফুল গুলো অন্য কোথাও দেখি নাই যা খুব সুন্দর।
নেপলেস
আমালফি কোস্ট ,নেপ্লেস ,ইটালি
কাফ্রি আইল্যান্ড থেকে নেপলেস চলে আসলাম সারা দিনের টুর শেষে । পরের দিন আমাদের নেপলেস দেখে বেড়ানোর দিন। লোকালয় ঘুরলাম একটা বাসে চেপে ।নেপলেস ইটালির দক্ষিণের একটি শহর যার গোরা পত্তন হয় গ্রীক দ্বারা ।তারপরে রোমানদের হাতে চলে যায় । এখানে একটা ১৩ থ সেন্চুরীর চার্চ ভিজিট করলাম ,লোকাল মার্কেটে বিখ্যাত ইটালির আইসক্রিম খেলাম, শহরের প্রান্তে গিয়ে লোকালয় দেখলাম। প্রত্যেক বাড়িতে প্রচুর লেমন গাছ দেখতে পেলাম যাতে প্রচুর লেমন ধরে আছে। লেমন যেহেতু বেশি হয় তাই এর উৎপাদন দিয়ে নানান কিছু বানানো হয়।লেমন প্রসেস করা একটা ফ্যাক্টরি ভিজিট করলাম ,লেবুর রস প্রসেস করে এরা কত কিছু বানায়।
পরের দিন খুব সকালে আমাদের ফেরার পালা । ইটালির নেপলেস কে বিদায় দিয়ে আমরা প্লেনে উঠলাম লন্ডনের পথে,একটা চমৎকার কিন্তু ভয়ংকর অনুভূতিকে সঙ্গে নিয়ে।
লেখক ও গবেষকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস ,লন্ডন
৪টি মন্তব্য
স্বপ্ন নীলা
ভ্রমনের বর্ণনা অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। লাভা ! ওর বাবা। পড়েই তো ভীষণ ভয় লাগছিল। আর আপনারা ঘুরে ঘুরে দেখেছেন।
নার্গিস রশিদ
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। শুভ কামনা ।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার ভ্রমণ কাহীনি মনোমুগ্ধকর। সুন্দর উপস্থাপনা।
নার্গিস রশিদ
অশেষ ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন এবং শুভ কামনা।