নদীর পারের এই গুঁড়িগুলো ভীষণ পছন্দ রুদ্রের। জোয়ার ভাটায় তার নিত্যসঙ্গী এরা।পানি কমুক বাড়ুক-সে একদম নদীর কাছাকাছি থাকা অনাথ কাঠের টুকরোটার ওপর বসে থাকে- অন্যগুলোতে থাকা হয় খুব কম… তবে হ্যাঁ,ঐ যে আরেক কোণে একটা নাম না জানা গাছ আছে ওটার নিচে ফেলে রাখা শ্যাওলা ধরা যে মূলগুলো,ওদেরকেও মাঝে মধ্যে ‘বন্ধু’ বানায় সে।
ঘাটের লোকেদের এখন আর চোখে লাগে না এসব-‘পাগলা কবিয়াল’ আইছে রে,এই হাঁকটাও আগের মতো দেয় না তারা… ‘আচছা,কবিয়াল কি?’-রুদ্র নিজেকে জিজ্ঞেস করত তখন।
রুদ্র তো জানত না সে ‘চারণ কবি’। তাল-সুপুরি গাছদের রহস্য ঘেরা রাতে তাঁরা সুর করে পুঁথি পড়তেন,পুঁথির শুরুটা যেমন তাঁর জানা,উত্তরন থেকে আখ্যান সব জানেন একজন চারন কবি। রুদ্রর ‘কথামালা’দের শ্রোতা এই কাঠগুলো… প্রায় প্রত্যেকটা মোটা গুঁড়ি অজান নদী পাড়ি দিয়ে নিজেরাও নৌকা হয়ে যায়… তাদের গায়ে মিশে থাকা গল্পগুলো তখন নদীও শোনে… নদী কি কাঁদে? নদীর কান্নার স্বাদও কি লবনাক্ত?
“-রুদ্র,এই কৌটোটা দেখ, বলতো কি আছে?
-কি আছে,নীরু?
-সাহেব বাবুর সাথে ঝগড়া হয় আমার,আর সেই যে প্রথম দিকে তুমি একটা টিউবলাইট ছিলা?
-খোঁচা দিতে ভালো লাগে বুঝি? তখন কি জানতাম সব জেনে তুমি আমাকে এত ভালবাসবা?
-তা এই কৌটায় তখন থেকে এখন পর্যন্ত যত কান্না করসি সবগুলা পানি জমা করসি…
-তুমি জান এই কৌটা টা কি আমার জন্য?
-কি আবার,তোমার ঝগড়াইটটা বউ এর নিদর্শন…
-তুমি তো লক্ষ্মী ঝগড়াইটটা,নীরু… এটা একটা ছোট্ট সমুদ্র, যেটা তুমি ছাড়া আর কেউ বানাতে পারবে না…
-কেন মশাই? কি আছে এতে? কতগুলা ঝগড়ার ফসলই তো..
-এটায়? এত্ত এত্ত ভালোবাসা আছে, গ্যালন গ্যালন অভিমান আছে, বোতল বোতল আব্দার আর একটা মানুষের প্রেমিক হওয়ার গল্প আছে…
-তাই না?
-হা,কিন্তু আমার একটা আব্দার রাখবে?
-তোমার জন্য সব…
-পানির হাইটটা আর বাড়িও না,প্লিজ…
-তাহলে,তুমি বল যে তুমিও আমি রাগ করলে অমনে লুকায়া কাঁদবা না…
-তুমি জানো?
-হ্যাঁ,মিস্টার আমি জানি…
-আমি তোমাকে খুউউব ভালবাসি,নীরু…
-আমিও…
-আমার চাইতে বেশি না…
-না,আমি বেশি…
-না,আমি…’’
এই সব ক্ষয়ে যাওয়া গল্পগুলো রুদ্রনীল সেদিন বলছিল প্রিয় কাঠের গুঁড়িটাকে… রাত পেরিয়ে সকাল হতেই সেদিন মহাজন এসে ডাক দিলো তাকে…
“-ও বাজান,উঠবেন্ না? কাঠ তো বেপারিয়ে লইয়া যাইব…
-সব কাঠ?
-হ,ময়ুরপঙ্খী নাও গড়াইব… মেলা কাঠ এর পরয়োজন…
-উঠছি,কার জন্য? বলতে পার?
-হেতির নিকা হইছে গো বাজান… পিরীত করিয়া… বউ এর লিগা নাও গড়াইব…
-ও…..’’
রুদ্রনীল উঠে যায়… মায়া লাগিয়ে তার সাথে গুঁড়িটার কিছু ছাল ও চলে আসে…
আহা…এই ময়ুরপংখি নৌকোটার আধার গুলোকে সে বহুদিন ভুলতে পারবে না… নীরার গল্প করার জন্য সে বহুদিন কোন বন্ধু পাবে না…
আচ্ছা,নীরার কাছে সেই কৌটোটা কি এখনও আছে? বোধ হয় না… ভালোবাসা বদল হয়… আর কৌটো তো……
রুদ্রের একটা সমুদ্র দরকার… কে দেবে তাকে সমুদ্র?
রুদ্র এখন নদীর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা নৌকার অপেক্ষা করছে… যার পাটাতনগুলো তার গল্প দিয়ে তৈরি…
নদীর দেশে নৌকারাই নাকি চারণ কবি? ওরা সমুদ্র কে খবর দিতে পারে?
না হয় রুদ্রই সমুদ্র হয়ে যাক…
১৯টি মন্তব্য
লীলাবতী
গল্পে তো নীরু নিরা নীহার সব একাকার হয়ে গিয়েছে। যদিও কষ্টের গল্প তারপরেও পড়তে ভালো লেগেছে খুব। আচ্ছা কষ্টের গল্পগুলো মনে বেশিদিন থাকে কেন? এটি কি কবিয়াল রুদ্র জানে?
নীহার
গল্পে নিরু নিরা একাকার,নীহার কেবল দরশক…
কবিয়াল তো তার ই উত্তর খুঁজে যাচ্ছে…
জিসান শা ইকরাম
আপনার লেখাগুলো আলাদা। লেখা পড়লেই বুঝা যাবে এটি আপনার। যত পড়ি আপনার লেখা, ততই মুগ্ধ হই।
নিয়মিত লেখুন।
নীহার
চেষ্টা করি তো…
মৌনতা রিতু
ভালো লাগলো খুব। আসলেই মনের অনুভূতিগুলো আমরা কাউকে না কাউকে বলেই ফেলি। কোনো গাছ, ঐ নদী, ঐ সমুদ্র, সবাই আমার নীরব কথার সাক্ষী।
ঐ ময়ুরপঙ্খি নৌকাও আপনাকে মনে রাখবে।
নীহার
নিরন্তর ধন্যবাদ…
ব্লগার সজীব
কৌটায় কান্নার পানি জমা করে রাখা, মনে ধরেছে ভাইয়া/আপু 🙂 লেখা ভালো লেগেছে (y)
নীহার
আপু ই ঠিক আসে…… ধন্যবাদ অসংখ্য… 😀
ব্লগার সজীব
আচ্ছা এখন হতে নীহার আপু 🙂
দীপংকর চন্দ
মন ছোঁয়া লেখা!!!
অনিঃশেষ শুভকামনা জানবেন।
ভালো থাকবেন। অনেক ভালো। সবসময়।
নীহার
ধন্যবাদ,ভাইয়া…
ইকবাল কবীর
ভালো লাগল, চালিয়ে যান নিরন্তর।শুভ কামনা রইল।
নীহার
ধন্যবাদ,ভাইয়া…
খসড়া
সুন্দর। আপনি কি বাউল, কবিয়াল, বয়াতি।কোনটা।?
নীহার
চারন কবিই হইতে চাই…
মোঃ মজিবর রহমান
সুন্দর খুব ভা ল লা গ ল।
নীহার
ধন্যবাদ,ভাইয়া…
নীলাঞ্জনা নীলা
এতো ভালো লেখেন কি করে? ;?
নীহার
কই আর ভালো লিখলাম… আরও কত কিছু শেখা বাকি…