পৃথিবীর পথে পথেঃ ভ্রমণ, নেপাল,( চিতোয়ান ) ২০০৮
চিতোয়ান ন্যাসানাল পার্ক , তেরায় , কালি- গন্ধাক নদীতে র্যাফটিং ( দ্বিতীয় খণ্ড)
“The Mountains are calling And I must go”
ওয়াটার র্যাফটিইং
কালী গন্ধাক রিভারে হোয়াইট ওয়াটার র্যাফটিং
অন্নপূর্ণা ট্রেকিং শেষ করে চিতোয়ান যাওয়ার পথে বুকিং দেয়া ছিল খরস্রোতা কালিগন্ধাক নদীতে হোয়াইট ওয়াটার র্যাপ্টিইং করার জন্য। । এটা ছিল একটা চমৎকার অ্যাডভেনচার ।রিমোট অঞ্চলের ভিতর দিয়ে কোথাও আবার ন্যারো গর্জ আর এই ভাবে হিমালয় কে আবিষ্কার। এক চমৎকার অনুভূতি।
‘কালি গন্ধাক’ এর অর্থ ‘The river of god’. অর্থাৎ ‘দেবী কালির নদী ‘। ধবলগিরি(৮১৬৭ মি ) আর অন্নপূর্ণা(৮০৯১মি ) এই দুই পর্বতের মধ্যে দিয়ে এই নদী প্রবাহিত এবং কোনো কোনো স্থান ২৫২০মি গভীর। ‘নহুবাইন হিমেল গ্লেসিয়ার’ এবং ‘ম্যান্সাইল (Manshail) পর্বত’ থেকে স্টার্ট।
যাইহোক আমরা ওয়াটার প্রুফ লাইফ জ্যাকেট আর হেমলেট পরে, শেল্ফ বেইলিং বোটে চেপে বসলাম। সবার হাতে প্লাস্টিকের বৈঠা । খরস্রোতা নদীর পানি সর্বক্ষণ নাচানাচি করছে একের পর এক পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পানি খুব বেশি নাচানাচি করছিল।
দুপাশে ঘন জঙ্গল,’ছেত্রি’ গ্রাম পাশ দিয়ে গেলো ।মানুষ হাত তুলে নমস্কার দিলো।আমরাও দিলাম। এই র্যাপ্টিং এর মধ্যে দিয়ে অন্নপূর্ণা মাউন্টেন রেঞ্জ কে অন্য ভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। যারা থ্রিল পছন্দ করে তারা খুব পছন্দ করবে। কারন এই নদীর ছুটে চলার গতি খুব বেশি আর চারদিকে পানির স্রোতও বেশ ভয়ের ।
চিতোয়ান ন্যাসান্যাল পার্ক
হাতির পিঠে সাফারি
র্যাপ্টিইং শেষে আমরা ট্যাক্সি যোগে রওনা দিলাম চিতোয়ানের উদ্দস্যে । খাড়া পাহাড়ের ধার কেটে রাস্তা বানানো । নিচে গভীর খাদ । একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ি একেবারে গভীর খাদে।সে একবারে ভয়ঙ্কর দৃশ্য। কিছুক্ষণ আগেই একটা ট্রাক চালের বস্তা নিয়ে সেই যে ডুবে গেলো তার কোন চিহ্ন পাওয়া গেলো না। গভীর গর্জে বিলীন হয়ে গেলো। হিমালয় এই রকম ভয়ঙ্কর। পড়ন্ত বিকেলে এসে গেলাম চিতোয়ান ।
বড় বড় পর্বত আর নাই । ছোটো আকারের পাহাড় তাও তেমন নাই।চিতোয়ান জঙ্গলের শেষ প্রান্তে আমাদের থাকার রিসোর্ট । কি যে সুন্দর চারদিক । জংগলের মতই চারদিকে ঘন গাছ গাছালি। আর রাপ্তি নদী রিসোর্টের পেছনেই। একটু ফ্রেস হয়েই গাইড শেখর আমরাকে নিয়ে চলে আসলো আগে থেকে বুকিং দেয়া স্থানীয় ইয়ং ছেলেদের পারফর্ম করা একটা ‘নেপালি ফোক লাঠি ডান্স ‘দেখার জন্য। খুব উপভোগ করলাম গ্রুপ ড্যান্স টি। রিসোর্টে এসে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কারন সকালে আছে চিতোয়ান এডভেঞ্চার ।
থারু ড্যান্স
চিতোয়ান দক্ষিণ নেপালের ‘মাকয়ানপুরে’ ‘পার্সা ডিসট্রিক্টে’ । ৯৫২ .৬৩ স্কুয়ার কিমি এলাকা জুড়ে , সাব ট্রপিক্যাল ওয়েদার এবং প্রচুর হেভি বৃষ্টি পাত হওয়া একটা হিউমিড অঞ্চল। প্রতি ইঞ্চি জায়গা হাজার রকমের উইড দিয়ে ঠাসবুনানি। বোটানিসস্ট দের গবেষণার স্বর্গ রাজ্য। চিতোয়ানের উত্তরে নারায়ণী আর দক্ষিণে রাপ্তি নদী । নদীর পানিতে স্রোতের দাপট কম যেহেতু সমতল । সকালে নাস্তা খেয়ে চললাম রাপ্তী নদীতে বোট ট্রিপ আর হাতীর পিঠে উঠে জঙ্গল সাফারি করতে।
রাপ্তী নদীতে বোট ট্রিপ
রাপ্তি নদী তে বোটিইং
প্রথমে রাপ্তী নদীতে ডিঙ্গি দিয়ে বোট ট্রিপ করলাম । চারদিকে শালবন। কুমির আর ঘড়িয়াল রেস্ট নিচ্ছে নদীর কিনারে।নদীর দুই ধার আর উঁচু নয়। পাথরও নাই। ভ্যাপসা গরম । ঈগল, মাছরাঙ্গা আর কাঠবিড়ালি গাছে বসে আছে। চারদিকের ভু প্রকৃতি উত্তর নেপাল থেকে আলাদা।
বোট ট্রিপ শেষে হাতীর পিঠে জঙ্গল সাফারি করতে রওনা দিলাম। একটা খাল পার হয়ে হাতী গভীর জঙ্গলে বাঘের রাজ্যে প্রবেশ করলো। চারদিকে ‘এলফ্যান্ট গ্রাস’।অনেক লম্বা ঘাস তাই বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারবে সহজেই । একটা মৃদু বাঘের গলার মতো আওয়াজ শুনলাম। মাহুত সাবধান করে দিলো পা যেন উপরে তুলে রাখি। সে বলল আমরা বাঘ দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু বাঘ আমরাকে ঠিকই দেখছে।
যেতে যেতে মাহুত বর্ণনা দিতে থাকলো কি কি এই জঙ্গলে আছে । বেঙ্গল টাইগার,ল্যাপার্ড,ক্লাউড ল্যাপার্ড,শ্লথ, ভালুক,শেয়াল,বেজি,হায়েনা,সাম্বার,হরিন,হানি ব্যাজার,এক শিং ওয়ালা রাইনো , মেছোবাঘ আর কিং কোবরা। সাল গাছ ৭০% আর আছে চির পাইন । এটি ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের’ অন্তর্ভুক্ত ।
জঙ্গল সাফারি শেষে একটা ঘোড়া টানা টমটমে উঠে লোকালয় দেখে বেড়ালাম। গ্রামের বাড়িঘর মাটি বা বাঁশের তৈরি চার চালা খড়ের ছাদ। প্রত্যেক বাড়িতে কুকুর পোষে কারন রাতে বাঘ আসে । ঘেউ ঘেউ শব্দে সতর্ক করে দায়। হাতী যেন লোকালয়ে আসতে না পারে তাই ইলেকট্রিক তার দিয়ে উঁচু বেড়া আছে,সক লেগে পার হতে বাধা পায়। কিন্তু বাঘ লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ে ।
‘তরায় অঞ্চল’ টি পুরো নেপালের দক্ষিণ দিক জুড়ে।সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ৭০ মিটার উপরে। লম্বা ঘাস, সাল বোন আর পানি জমে থাকা নিচু এলাকা নিয়ে গঠিত । ভটকাপুর,বারাহী জঙ্গল, বান্দিপুর বুদ্ধা মায়া গার্ডেন আর চিতয়ান হল প্রধান সংরক্ষিত জঙ্গল ।এদের রুট ইন্ডীয়ান,চেহারা ইন্ডীয়ান । মিথিলি আর ভোজপুরি ভাষায় কথা বলে। পুর্বে ইয়ামুনা(yamuna) আর পশ্চিমে ব্রম্ভপুত্র নদী পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। পাহাড় থেকে নেমে আসা শত শত নদী নালা এই সমতলে এসে পড়েছে। তেরাই অর্থ Moist Landবা ভেজা অঞ্চল। পূর্বে পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশ ।
তেরায় হল হিমালয় ড্রামার শেষ counterpoint।
নেপাল অ্যাডভেনচার শেষ করে এবার আমাদের ফেরার পালা। তেরায় ভ্রমণ শেষ করে পোখারা হয়ে সোজা কাঠমুন্ডু । পরের দিন ফিরতি ফ্লাইটে চলে আসলাম লন্ডনে।
নেপাল মানস পটে থাকবে সারা জীবন। কারন এর বিরাটত্ব, বৈচিত্র্য , ন্যাচারাল বিউটি আর লুকিয়ে থাকা মিসট্রি যে কোনো মানুষকে মোহিত করবে।
লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস, লন্ডন