
অনেকদিন পর তাহিরপুর এলো রুকু।
বাবার সাথে নয় হাজবেন্ডের সাথে। একমাস হলো রুকুর হাজবেন্ড ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এই উপজেলায় জয়েন করেছে। তাহিপুরের সবকিছু রুকুর চেনা।ওর শৈশব কেটেছে এখানে।
তাহিরপুরে পা রাখতেই রুকুর মনে হলো সে যেনো শৈশবে ডুকে গ্যাছে। পুরো শৈশব কেমন যেনো ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
তাহিরপুরেই রাশেদরা থাকতো। রাশেদ তার তিনবছরের সিনিয়ার। ওর বাবা সরকারী চাকুরি করতেন। রাশেদ তুখুর ছাত্র ছিলো। রুককুে এস,এস,সির পর তিন মাস প্রাইভেট পড়িযেছিলো।
সেই থেকেই ভালো লাগা। রাশেদ ভীষণ চাপা স্বভাবের ছিলো। কখনই মুখ ফুটে বলেনি রুকুকে ভালোবাসে।
কতোদিন রুকু উন্মুখ হয়ে বসে থাকতো কবে রাশেদ বলবে, রুকু আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু নাহ্ সেই বাক্যটা রাশেদের কাছ থেকে শুনতে পায়নি রুকু।
রুকু ভীষণ ব্যস্ত। নতুন করে রুম সাজাচ্ছে। ভুলেই গেলো রাশেদের কথা।
রুকু এস,এস সি পাশ করার পর চট্টগ্রাম চলে যায়।
ওর বাবার ট্রান্সফার হয় চট্টগ্রামে। এর পর থেকে রাশেদের সাথে আর যোগাযোগ নেই। কতো চেষ্টা করেছে। সম্ভব হয়নি যোগাযোগ করার।
আজ বিকেলবেলা রুকুর কেমন জানি মন খারাপ।
বারবার রাশেদের কথাই মনে পড়ছে। মনটা অস্থির হয়ে আছে। একবার ভাবলো রাশেদরা যেখানে থাকতো সেখানে যাবে। ঐখানে গেলে হয়তো ওর খোঁজ পাওয়া যাবে। এতোদিনে সেও হয়তো তার মতোই সংসারী হয়ে উঠেছে। এই কথা ভাবতেই বুকের কেমন যেনো একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো রুকু।
প্রথম প্রেমগুলো আসলেই ভুলার ক্ষমতা রাখেনা মানুষ। রুকু ও পারেনি রাশেদ কে এক মূহুর্তের জন্য ভুলতে। রাশেদ যেনো না থেকেও আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলো ওর মনে।।
সকাল সকাল সব কাজ গুছিয়ে রুকু রাশেদদের বাসায় গেলো। ওদের বাসাটা আগের মতোই আছে।
সবকিছু পরিচিত। রাশেদের আম্মা প্রথম রুকুকে দেখে চিনতে পারেনি। পরিচয় দেবার পর রাশেদের আম্মা রুকুকে জড়িয়ে ধরে বললো –
কেমন আছো রুকু। কতো বড় হয়ে গ্যাছো তুমি।
রুনু দেখে যা কে এসেছে! ভেতর থেকে রুনুর আওয়াজ,
কে এসেছে মা! আরে রুকু এসেছেরে!
রুনু রাশেদের বড় বোন। রুকুকে ভীষণ ভালোবাসে।
হয়তোবা উনি বুঝেও ছিলেন রুকুর ভালোবাসার ব্যপারটা।
আরে রুকু, কত্তো বড় হয়ে গেছিস!আয়,আয় ঘরে আয়।
বাড়ির সবাই রুকুকে দেখে ভীষণ খুশী। রুকু কতোদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীদের নিয়ে এখানে আসতো তার কোন ইয়াত্তা নেই।
রুকু রাশেদের কথা জিজ্ঞেস করতে পারছেনা। ছেলেবেলার লজ্জাটা এখনো যায়নি ওর। একটু সাহস নিয়ে বলেই ফেললো – রাশেদ ভাই কেমন আছে আপা।
এই প্রশ্ন শুনার পর রুনু চুপ হয়ে গেলো। যেনো কথাটা শুনেও শুনেনি। ভিন্ন কথার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চাইলো রাশেদের ব্যাপারে জানতে চাওয়ার ব্যপারটা।
রুকু আবারো জিজ্ঞেস করলো। রুনু চুপ থেকে বললো, রাশেদ আমাদের সাথে থাকেনা। ওর সাথে যোগাযোগ হয়না আমাদের।
রুকু নিশ্চুপে শুধু শুনলো কিছুই বললো না আর। এদিকে বেলা হয়ে যাচ্ছে। রুকু রুনুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলো।
রাতের বেলায় রুকুর ঘুম আসছে না। বারবার শুধু রাশেদের কথাই মনে পড়ছে। ভাবছে রাশেদ তো এমন ছিলোনা। ও-তো ওর পরিবারকে ভীষণ ভালোবাসতো। বিভিন্ন চিন্তা রুকুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হিসেব মিলাতে পারছেনা।
পরদিন খুব সকালে রুকু রাশেদের বাড়িতে গেলো।
উঠানেই রুনু আপা।
রুকুকে দেখে কেমন জানি বিমর্ষ ভাঙিতে তাকিয়ে আছে। রুকু এবার একটু জোড়ালো গলায় বললো,
রাশেদ ভাই কই আপা। রুনু চুপচাপ।
প্লিজ চুপ থেকো না আপা, বলো।
রুনু রুকুর হাত ধরে বাড়ির দক্ষিণ দিকে নিয়ে গেলো। একটা কবর দেখিয়ে বললো, এই যে বকুল গাছটা দেখছিস এর নিচেই রাশেদ ঘুমিয়ে আছে।
রুকু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীটা ভীষণ ভারী লাগছে ওর। এতো ওজন কোনদিন অনুভব করেনি সে।
তোমরা যাবার পর রাশেদের ব্রেন ক্যানসার ধরা পড়ে। বাঁচানো গেলো না।।
ওহ্, রাশেদ তোমার জন্য একটা ডাইরী রেখে গেছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে সে বলেছিল যদি কোনদিন তোমার দেখা পাই এই ডাইরীটা যেনো তোমাকে দেই।
ও বলেছিলো তুমি আসবে। একদিন আসবেই।
রুকু রাশেদের ডাইরিটা হাতে নিয়ে চলে এলো।
কি আশ্চর্য! রুকুর চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই।
বাসায় এসে রুকু ডাইরিটা খুললো, একটা ছবি আটা দিয়ে আটকানো।ছবির নিচে লেখা –
প্রিয় রুকু,
আমি রাশেদ বলছি। যখন আমার লেখা পড়ছো, স্পর্শ করছো, তখন হয়তো আমি থাকবো না।
তুমি ঠিক আমাকে অনুভব করতে পারবে। খুব তীব্র হবে সে অনুভব। ভীষণ জীবন্ত। যেই ছবিটা তুমি দেখছো, মনে পড়ে সেই দিনের কথা?
বৃষ্টির দিন ছিলো। তুমি এস,এস,সি’র রেজাল্ট জানাতে এসেছিলে। দুজনেরই ছাতা ছিলো, অথচ আমরা ভিজে গিয়েছিলাম, প্রেমে, বৃষ্টিতে। আমি বরাবরই মুখচোরা স্বভাবের। কোনদিন মুখ ফোটে বলতে পারিনি তোমাকে ভালোবাসি। আমি প্রতিদিন তোমাকে পড়িয়ে এসে কাগজে লিখে রাখতাম – রুকু তোমাকে ভালোবাসি।ভীষণ ভালোবাসি।
আমাদের হয়তো আর কোনদিন দেখা হবেনা।
আমি জানি আমি বাঁচবো-ও না বেশিদিন। তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। জানি পৃথিবীতে সব ইচ্ছে পূরণ হয়না। পূরণ হতে নেই। সবকিছু পূরণ হলে পৃথিবী বিস্বাদ লাগে।
জানো রুকু, আমার যখন অসহ্য যন্ত্রনা হতো আমি এই ছবিটার সাথে কথা বলতাম। ছবি কতো শক্তিশালী জিনিস তাই না! আমাদের কেমন ফ্রেমের ভেতর জীবন্ত করে রেখেছে, দেখো! কারো বয়স বাড়বে না। ব্যপারটা খুব সুন্দর না!
রুকু শোন,
তোমার মেয়ে হলে ওর নাম রেখো রুবাইয়াত। নামটা আমার ভীষণ পছন্দ। আর শোন,রুবাইয়াত নামের অর্থ তোমার মেয়ে জন্মানোর পরে তোমার প্রিয় মানুষের কাছ থেকে জেনে নিয়ো,
ভালোবাসি রুকু। খুব ভালোবাসি তোমায়।
ইতি,
তোমার রাশেদ।
আজ রুকুর খুশীর দিন। রুকুর ফুটফুটে একটা কন্যা হয়েছে। হাসপাতাল ভর্তি মানুষ। রুকুর স্বামী রায়হান ভীষণ খুশী। রুকুর কানে কানে এসে বললো _____ দেখেছো! আমাদের একটা রাজকন্যা এসেছে।
আর শোন, ওর নাম হবে রুবাইয়াত।
রুকু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রায়হানের দিকে।
রায়হান বললো কি মিল নামটায় তাইনা,,
রুকু, রাশেদ, রায়হান = রুবাইয়াত।।
রুকু রায়হানকে জিজ্ঞেস করলো রুবাইয়াত নামের অর্থ কি?
রায়হান বললো, রুবাইয়াত অর্থ চার লাইনের কবিতা।
রুকু,রাশেদ,রায়হান আর রুবাইয়াতের কবিতা।।
.
২০ ফেব্রুয়ারী ২০২২ ইং।
রাতঃ ১:৩৬ মিনিট।
৫টি মন্তব্য
রোকসানা খন্দকার রুকু
চার লাইনের কবিতার মিমর্ষ পরিনতি। প্রেমের পরিনতি গুলো এমনই হয়। মন পড়ে থাকে এক ঘরে, দেহ থাকে অন্য ঘরে। ভালো লাগলো অনেক। গল্প জমেছে, আমাদের ধন্যবাদ লিখুন কাভি-কাবার। শুভ কামনা রইলো কবি।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমাদের জন্য।।
মনিরুজ্জামান অনিক
অনিঃশেষ ভালোবাসা জানবেন।
এই গল্পটি গল্পর সাথ জুড়ে দেয়া ছবিটা দেখে লিখা।
হালিমা আক্তার
ভালোবাসা কি এমনি হয়। শুভেচ্ছা রইলো।
সাবিনা ইয়াসমিন
চার লাইনের কবিতা শিরোনামে মর্মস্পর্শী এক গল্প পড়লাম। অনেক ভালো লেখেন আপনি। এমন গল্প আরও পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
শুভ কামনা 🌹🌹