
“কৃতজ্ঞতা প্রকাশ”
গতকাল সকালে আমার ফোনে অচেনা একটা নাম্বারে কল আসে, রিসিভ করলে আব্বুকে চায়।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি আব্বুর নাম্বারে কল দেন, আমাকে কেন?
লোকটা ভদ্রভাবে জবাব দেয় ম্যাডাম আপনি মনে হয় এক সময় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন,এখন ছেড়ে দিয়েছেন।
জ্বী।
জ্বী, আপনার আব্বুকে অনেক বছর ধরে খোঁজছিলাম পরে আপনার পরিচিত একজন আপনার নাম্বারটা দিল আমি স্যারের সাথে কথা বলতে চাই।
আমিও একজন শিক্ষক।
ওকে বলেই আব্বুকে ফোনটা দিলাম, কথা বলে লোকটা আব্বুকে অনুরোধ করলেন আমাদের বাসার ঠিকানা দিতে তিনি আব্বুর সাথে সরাসরি একবার দেখা করতে চান।
দুপুর ২টা ৩৫/৩৮ বছরের একজন লোক এসে আব্বুকে চাইলেন, গেইট খুলে ভিতরে বসতে বললাম।
আব্বু আসা মাত্রই লোকটা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আর পা ছুঁয়ে সালাম করলেন বিষয়টা ভালো লাগলো।
আব্বু লোকটাকে চিনতে পারলেন না, আপনার পরিচয়?
লোকটা বললেন তিনি স্কুলের শিক্ষক।
আব্বু বললেন আমি তো চাকরি থেকে অবসরে আছি, বলুন কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
লোকটা মাথা নত করে বললেন স্যার আপনার ঋণ কোনদিন শোধ করা সম্ভয় নয়,তাই কৃতজ্ঞতা জানাতে আসছি।
আব্বু মুসকি হেসে বললেন কিসের ঋণ?
লোকটা বলা শুরু করলেন “স্যার আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে আমি তখন এস.এস.সি পরীক্ষা দিচ্ছি আপনি তখন ওই হলরুমে ডিউটিতে যান ইউ.এনও হলেও সেদিন এসিল্যান্ড হিসাবে। আমি নকল করছিলাম বলেই লজ্জায় মাথাটা নিচু করে রাখেন..
তারপর।
স্যার রুমে ঢুকেই আপনি এই অবস্থায় আমাকে দেখা মাত্রই আমার খাতাটা নিয়ে যান, চেয়ে দেখলাম সারা হলরুম স্তব্দ, দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা ভয়ে কাঁপছিলো।
মনে মনে ভাবলাম আমার পড়াশোনা জীবনটা এখানেই শেষ সংসারের হাল ধরা হলো না ভেবেই দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে
লাগলাম।
এই কথাটা শোনে আমার চেখেও পানি চলে আসলো আমার আব্বু এতটা কঠিন হৃদয়ের মানুষ ছিলেন কোনদিন বুঝতেই পারলাম না।
স্যার আপনি এক নজরে পুরো হলরুমটা চেয়ে দেখে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছে আমার খাতাটা রেখে কিছু লিখে রুম থেকে বেরিয়ে যান।
আমি ১০ মিনিট অপেক্ষা করে চোখ মুছতে মুছতে হলরুম থেকে বেরিয়ে আসবো তখনি একজন স্যার ডাকলেন, আমি সামনে গেলাম, তোমার ভাগ্য ভালো এমন একজন সৎ, মহৎ মানুষের সামনে পড়ছো তাই বেঁচে গেলে।
নাও খাতা নিয়ে লিখতে শুরু করো স্যার তোমাকে কয়েক বছরের জন্য পড়াশোনা স্থগিত করাতে পারতেন,করেন নাই। ওনার অনেক ক্ষমতা তবু তোমাকে বহিষ্কার করেন নাই, বলছে একটু ধমক দিয়ে ১০মিনিট পরে খাতাটা দিয়ে দিবেন ভালো ভাবে পড়াশোনা করতে বলবেন।
কথাটা শোনে আমি আবার কেঁদেছিলাম আনন্দে আর আপনার প্রতি শ্রদ্ধায় তারপর থেকে মনদিয়ে পড়াশোনা করছি,মাস্টার্স পাশ করে একজন ভালো শিক্ষক হয়েছি।
স্যার আপনাকে অনেক খোঁজছি পায়নি একজন বয়স্ক শিক্ষকের কাছে আপনার কথা শেয়ার করলাম তিনি শোনা মাত্রই বললেন একজনেই
ভালো একজন ইউএনও ছিলেন।
এবার আব্বুর প্রতি আমার শ্রদ্ধাটা বেড়ে গেল, ভুল বুঝার জন্য নিজের মনকে শাসন করলাম।
আপনি হয়ত ওনার কথাই বলছেন, তারপর আলিফ ম্যাম এর নাম্বারটা দিলেন আপনাকে খোঁজে পেলাম, স্যার যদি আপনি ওইদিন দয়াটা না করতেন তাহলে হয়ত আজ মাঠে কৃষিকাজ কারতাম।
দয়া কেন বলছেন? দয়া করার মালিক আল্লাহ।
আমি আপনাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম যাতে নিজেকে শোধরে নিতে পারেন, আমি খুব খুশি হয়েছি আপনার সফলতার কথা শোনে।
জ্বী স্যার! আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই আমার জন্য দোয়া করবেন।
অবশ্যই দোয়া করবো আপনি ২০ বছর আগের ঘটনাটা মনে রেখে যে আমার সাথে দেখা করতে আসছেন, এটা আমার চাকরি জীবনের সেরা পাওনা হয়ে রইল।
আপনার পরিবারের সবাই কেমন আছেন?.জ্বী স্যার পরিবার বলতে আব্বা,আম্মা ভালো আছেন।
আব্বু অবাক হয়ে বললেন ছেলে,মেয়ে?
লোকটা মুসকি হেসে বললেন স্যার আমার আব্বা একজন দিনমজুর ছিলেন, মা মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন জমিজমা নেই। তাই চার বোনকে আমি পড়াশোনা করাইছি, নিজে চাকরি করে টাকা জমিয়ে বিয়ে দিয়েছি, এখন আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে বলেই মাথা নিচু করে রাখলেন।
আব্বু লোকটাকে স্যালুট করলেন সত্যি আমার গর্ব হচ্ছে ওইদিনটার জন্য আপনার উজ্জল ভবিষ্যৎটা শোনার সৌভাগ্য আমার হলো। এর মধ্যে আম্মুর রান্না শেষ লোকটা খেয়ে সন্ধ্যার পরে বিদায় নিলেন আর আব্বুকে তাঁর বিয়েতে যেতে অনুরোধ করলেন…
সত্যি আব্বুকে নিয়ে খুব গর্ব হয় যে চাকরি জীবনে চেয়ারটার মর্যাদা রেখেছিলেন বলেই এখনো মানুষ তাকে সম্মান করে, ভালোবাসে।
আব্বু ভালো একজন মানুষ ছিলেন বলেই সমাজে আব্বুর পরিচয়ে সম্মানিত হই।
শ্রদ্ধা রইল আব্বু, স্যালুট তোমাকে ❤️
১০টি মন্তব্য
রোকসানা খন্দকার রুকু
আগের নকল বিষয়টি একটু কড়াকড়ি ছিল। সরাসরি এক্সফেল্ড করে দিত। এখন অতো কড়াকড়ি নেই।
আপনার বাবার জন্য শুভকামনা রইল। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবন দান করুন।
আপনিও ভালো থাকবেন।।।
সুরাইয়া নার্গিস
ধন্যবাদ বড় আপু।
নকল এক সময় খুবই ভয়াবহ আকার ধারন করেছিলো তারপর আস্তে আস্তে কমে গেছে, আমাদের সময় কেউ নকল করে শুনি নাই।
আব্বুর কাছে শুনছি,নকল করলে নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার রয়ে যায় বরং নিজের জ্ঞান,মেধাকে কাজে লাগিয়ে জীবনে সফলতা সম্ভব।
আলমগীর সরকার লিটন
আসলে আমি নকল টকল করতে পারতাম না
মুখস্ত যা থাকত তাই লেখতাম!
অনেক শুভেচ্ছা রইল———
সুরাইয়া নার্গিস
ধন্যবাদ ভাইয়া।
নকল না করাই ভালো নিজের মেধাকে কাজে লাগালে ভালো ফলাফল করা সম্ভব।
আপনি সব মুখস্থ করতেন আর আমি কোনদিন প্রশ্ন মুখস্থ করতাম না একবার রিডিং পড়তাম তারপর নিজের মতো বানিয়ে উওর লিখতাম।
আম্মু ধমক দিতেন শিখে লিখবে তবে বানিয়ে লেখার পর বইয়ের ভাষার চেয়ে উওরটা ভালো হতো পরে আম্মু খুশি হতেন ☺️
এখন মনে হয় ওই বানিয়ে লেখা থেকেই লেখিকা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো,আজ তা সফল হচ্ছে ❤️
মোঃ মজিবর রহমান
আমি অনার্সে পড়ার সময় রাষ্ট্র বিজ্ঞান আর আমাদের পরিক্ষা একই সময়ে একই মানে পাশাপাশি ছিলো। আমার এয়ারমেট একঘন্টা পরে ওয়াশে গিয়ে হাতে লিখে এনে লিখছিলো। যে স্যার দেখে ফেলল সে ছিলো কঠিন থেকে কঠিনতর। খাতা নিলেন তখন থেকে প্রায় ২.৩০ ঘন্টা ঐ বন্ধু স্যারের পিছন পিছন ঘুরেছিল কিন্তু খাতা দেইনি। পরে জানতে পারি ঐসন্মানীয় শিক্ষক তার ছেলেকে পর্যন্ত এক্সফেল করেছেন কিন্তু অন্যায় করতে কাউকে দেননি। স্যালুট এই শিক্ষকদের তাদের সন্মান একখন সমপর্যায় রয়েছে।
সুরাইয়া নার্গিস
ধন্যবাদ।
এমন শিক্ষক সমাজে এখনো প্রয়োজন ইদানিং যে শিক্ষক স্কুল,কলেজে পড়ায় তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়লে নাম্বার বেশি।
সততা নেই বললেই চলে, ন্যায়নীতি বান শিক্ষকের বড়ই অভাব।
শুভ কামনা রইল সকল শিক্ষকদের জন্য।
হালিমা আক্তার
নকলের নাম শুনলে ভয় করতো। নকল তো দুরের কথা। নিজে পড়ে এবং বুঝে যা পারতাম তাই দিতাম।আমাদের স্কুলে এক স্যার ছিলেন, পরীক্ষার হলে ঢুকেই বলে দিতে পারতেন। হলে কেউ নকল করবে কি-না। আর স্যারের হাতে ধরা পড়লে জামিন নাই। তবে যারা নকলে এক্সপার্ট তারা সহজে ধরা পড়ে না। বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষার সময় বোটানিতে দুই বান্ধবী প্রচুর নকল করে ও ধরা খায়নি। প্রায় পরীক্ষায় ওরা নকল করতো।
সুরাইয়া নার্গিস
ধন্যবাদ আপু।
আমার আম্মু বলতেন নকল করতে সাহস লাগে,বুদ্ধি জ্ঞান সব লাগে যাতে পরীক্ষক বুঝতে না পারে সেভাবেই নকল করতে হয়।
আপনার বান্ধবীরা সাহসী বলতে হবে আমি কিছু না পারলেও কারো কাছে দেখতে চাইতাম না কারন আমি অন্যের খাতার লেখা বুঝতাম না।
তাই নিজে যা পারতাম লিখলাম, মাঝে মাঝে নিজের মনের মতো করে বানিয়ে উওর খাতায় লিখতাম।
তবে বর্তমানে নকল নেই বললেই চলে অতীত নকল ছিলো,স্যাররা কড়া ছিলো বলেই আমরা মেধাবী হয়েছি,অনেক কিছু শিখেছি।
হালিম নজরুল
সময়ের ব্যবধানে পরিবেশ এখন অনেক পাল্টে গেছে। সেই শিক্ষকও নেই, সেই পরিবেশ বা ছাত্রও নেই।
সুরাইয়া নার্গিস
ধন্যবাদ ভাইয়া।
আপনি ঠিক বলছেন আগে শিক্ষকের প্রতি ছাত্র/ছাত্রীদের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিলো তা বর্তমানে নেই বললেই চলে।