পৃথিবীর পথে পথেঃ স্টরমবলী ভল্কানো আইল্যান্ড ,ইটালি সময় কাল ২০১৮ ( ১ম পর্ব ) ভ্রমণ কাহিনী 

“Volcanoes are nature’s reminders that beneath the surface lies a world of hidden wonders and dangers”

 

 

জীবন্ত আগ্নেয়গীরি !

যেখান থেকে ২৪ ঘণ্টা আগুন আর ধোঁয়া বের হয় ?

ভাবতেই যে কেউ আতঙ্কিত হবে।

হ্যাঁ সেই আগ্নেয়গিরির কথায় বলছিলাম। যার নাম ‘স্টরম্বলি আগ্নেয়গিরি’ । এবার সেটায় আমরা দেখতে যাচ্ছি। সবসময় আগুন বের হচ্ছে এই জন্য এই আগ্নেয়গিরি কে বলা হয় ‘সমুদ্রের লাইট হাউস’ ।

আমাদের পরিবার ট্র্যাভেল টিম রওনা দিলাম এই আগ্নেয়গিরি দেখতে ।প্লেন ল্যান্ড করলো সিসিলি তে। এটা ইটালির দক্ষিণে একটি বড়ো আইল্যান্ড । এখানেও একটা আগ্নেয়গিরি আছে ,যার নাম ‘এটনা’ । তবে এটা মাঝে মাঝে অগ্নুৎপাত ঘটায় ।

আমরা জানি ইটালিতে অনেক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে।

এখান থেকে বাসে করে যেতে হবে জেটির দিকে ।যেতে সময় লাগলো ৪/৫ ঘণ্টা । সুন্দর রাস্তা ।রাস্তার মাঝের আইল্যান্ডে  আমাদের দেশের যেটা  করবি ফুল সেই ফুলের গাছ  লাইন করে লাগানো। ফুলে ফুলে রঙ্গিন হয়ে আছে। বাস কখনো পাহাড়ের সুরঙ্গ কেটে বানানো  লম্বা টানেলের মধ্যে ঢুকছে আবার কখনো হিলের উপরে উঠছে। সাজানো গোছানো সব সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর। বোঝায় যাচ্ছে মানুষ খুব সৌখিন আর দেশের অবস্থা ভালো ।

জেটিতে এসে সুন্দর একটা ফেরিতে উঠলাম। উন্নত দেশে সব কিছুই উন্নত । ফেরি চলছে এক এক করে সাতটি ছোটো ছোটো আইল্যান্ড পার হতে দেখলাম। সিসিলি থেকে ৬০ কিমি দূরত্ব । দুই  ঘণ্টা লাগলো স্টরম্বলি আসতে । খুব ইনজয় করলাম পুরো জার্নি টি। ওয়েদার খুব আরামদায়ক।

স্টরম্বলি আইল্যান্ড টি ছোটখাটো একটা আইল্যান্ড ।মাত্র ১২.৬ স্কোয়ার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে আছে ।সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ২,৭০০ মিটার উঁচু ।  ৫০০ লোকের বসবাস। শুধু মাত্র ট্যুরিজম ব্যাবসার জন্য তারা থাকে। পানি খাবার সব কিছু মেন ল্যান্ড থেকে আসে। কারন পুরোটিই একটা আগ্নেয়গিরি । কে থাকবে এখানে?  কখন বিরাট অগ্নুৎপাত হয় কে যানে।পানি খুব পরিমাণ মতো ব্যাবহার করা হয়।

সিসিলির উত্তর কোষ্টে  মোট চারটি  আগ্নেয়গিরি আছে,  আর স্টরমবলী আইল্যান্ড আগ্নেয়গিরি তার মধ্যে একটা। এখান  থেকে ২৪ ঘন্টা আগুন,ছাই আর ধোঁয়া বের  হতেই আছে। এখানে যে সমুদ্রটি আছে তার নাম Tyrrhenian sea। এই সমুদ্রের নিচে অনেক আগ্নেয়গিরি আছে যা পানির নিচে ডুবে আছে। এই স্টরম্বলি আগ্নেয়গিরি টিও একসময় পানির নিচে ছিল মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে । অগ্নুৎপাতের পাথর লাভা জমতে জমতে এটা এখন মাটির উপরে উঠে এসেছে।

আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে উঠলাম ।সুন্দর দুই রুম একটা কিচেন এবং বাথ টয়লেট সহ এই ফ্ল্যাট টি এই আগ্নেয়গিরির ঢালে বানানো ।একটা ঝুলন্ত বারান্দা আছে যেখানে বসে সরাসরি আগুন দেখা যায় । দিনের বেলায় রোদে আগুন দেখা না গেলেও অনবরত ধোঁয়া আর ছাই উদগিরন দেখা যাচ্ছিলো। রাতে  ক্লিয়ার আগুন দেখা যায়।

রাতে শুয়ে ভাবছিলাম আমরা একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি তে শুয়ে আছি। একটা গা শিহরন করা ভয়ংকর অনুভূতী ।

দুটো ছোটো ছোটো ভিলেজ আছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দক্ষিণ পশ্চিমে । প্রধান জীবিকা ট্যুরিজম । কারর হোটেল,  কারর রেস্টুরেন্ট, কেউ ট্র্যাভেল এজেন্ট ,কেউ গাইড, কেউ ছোটো ছোটো বোটের মালিক এবং তা দিয়ে টুরিস্টকে নিয়ে আগ্নেনেয়গিরি দেখাতে নিয়ে যায়। কারর আছে ঘোড়া টানা গাড়ী তাতে টুরিস্ট বসিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় ছোটো দ্বীপটি । আর আছে সুভেনিয়ার এর দোকান।

আমরা যথা রিতি  বুকিং দিলাম গাইড সহ জ্বলন্ত মুখের কাছে যাওয়া । একলা যাওয়া নিষেধ । প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অভিজ্ঞ গাইড ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। বুকিং দিলাম ট্রলারে করে যে পাশে মানুষে যাওয়া নিষেধ সেখানে সমুদ্র থেকে দেখা। এই দ্বীপ টির তিন টি পাশ আছে ।দুই পাশ মানুষ চলাচল করতে পারবে ।কিন্তু তৃতীয় পাশে উঁচু কাঁটা তারের বেড়া দেয়া । মানুষের যাওয়া নিষেধ , কারন সেখান দিয়ে অনবরত লাভা গড়িয়ে পড়ে। তাই সে পাশ টি  পোড়া কালো রঙের। একটা ভয়ংকর দৃশ্য সেখানে।

দুই হাজার ৭০০ মিটার উঁচু তে জ্বালা মুখ দেখতে অনেক হাঁটতে হয়। যখন মানুষ সেখানে যায় তখন তারাকে আর দেখা যায় না নিচ থেকে। আমরা মাঝামাঝি একটা নিরাপদ রেস্টুরেন্ট থেকে বসে দেখতে থাকলাম । রওনা দেয়া হয়েছিলো বিকাল ৫ টার দিকে । শুধু মাত্র আমার মেয়ে জ্বালা মুখ পর্যন্ত গেছে । আমরা পাহাড়ের মাঝামঝি সেই আগুন দেখার রেস্টুরেন্টের সামনে বেঞ্চে বসে সূর্য ডোবার জন্য অপেক্ষা করলাম। আমাদের মতো যারা অতদুর যেতে পারবেনা তারা দলে দলে আসতে লাগলো। সন্ধ্যা লাগতেই রাতের অন্ধকারে ঠিক ছয় টায় প্রথম ঝোলাক করে আগুন বের হল । এক ভয়ংকর অনুভূতী । তারপর দুই/এক মিনিট পর পর অনবরত আগুন আর ধোঁয়া বের হচ্ছে।

আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে দেখার পর ফিরে আসলাম । কিন্তু ফেরার পথের বর্ণনা টি একটু বলি । চারদিক অন্ধকার একদিকে আগ্নেয়গিরি আর একদিকে সমুদ্র । সরু মাটির রাস্তা তাও আবার সেটা  আগ্নেয় গিরির গা বেয়ে বেয়ে ।  কিছুদূর পর্যন্ত সুংসাং নীরবতা ।কোনো মানুষ বা বাড়িঘর কিছুই নাই। গা ছমছমে একটা ভয়। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঝোপ থেকে ডাকাত বের হবে। তবে সেখানে কোন ডাকাত নাই তবে রাস্তায় এঁকে বেকে সাপ যেতে দেখলাম। যাই হোক লোকালয় আসলো । কিন্তু কোন বাড়ি থেকে মানুষের আওয়াজ নাই। এতোই নীরব । রাস্তায় কোন মানুষ নাই।

একটা জিনিস আছে আর তা হল প্রত্যেক বাড়িতে  ফুলের বাগান আর সেই ফুল হল আমাদের দেশের  ‘হাসনাহেনা ফুল গাছ’  । রাতের বেলা হাস্না হেনা থোকায় থোকায় ফুটে আছে আর তার সুগন্ধ ছড়াচ্ছে । যা আমার  চিরদিন মনে থাকবে।

আর ওদিকে আমার মেয়ে নিচে এসে যে বর্ণনা দিলো সেটা  হল ,তারা একদল অভিযাত্রী ইয়ং ছেলেমেয়ে । তাদের গাইড কে ফলো করে করে উঠতেই আছে ।  এবড়ো থেবড়ো সরু পথ দিয়ে ।কোথায় পা ফেলতে হবে কোথায় হবেনা তা সর্ব ক্ষণ গাইড চেক করছে। একটু এদিক ওদিক হলেই খাড়া আর ঢালু গা বেয়ে  পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা । পড়ে গেলে  একেবারে নিচে।

যাইহোক তারা  দুই ঘণ্টা ধরে  ট্রেকিং করে করে উঠেছে। সবার পায়ে তাদের দেয়া বিশেষ জুতো, পোশাক, সেফটি বেল্ট আর হেম লেট পরতে হয়েছে, যা বাধ্যতা মূলক । সবায় কে নিয়ে গাইড একেবারে জ্বালা মুখের কাছা কাছি বসে কিছুক্ষণ এর বর্ণনা ইতিহাস, কেন আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয় ,পৃথিবীর গঠনএবং  কখন সবচেয়ে বড়ো বড়ো অগ্নুৎপাত হয়েছে ,  কেন সব মানুষ এখান থেকে চলে গিয়েছে সব বর্ণনা দিলো।

তারা সেখানে একটা নিরাপদ দূরত্বে বসে আছে আর হটাৎ একটা বিকট আওয়াজ করে ধুম করে আগুন  আর ছাই উপরে উঠলো । এই জন্যই গাইড দরকার কোথায় বসতে হবে ,কতদূরে থাকতে হবে, কি বিপর্যয় হতে পারে তা তারা যানে ভালো । তাছাড়া মেশিন থাকে বসা যা আগাম বার্তা দায় আজকে ভয়ংকর ভাবে দুর্যোগ হবে কি হবে না। সেই হিসেবে  তারা যায় সেখানে । গার্ড আছে কেউ একলা যাতে না যায় তার জন্য। কারন আগে একলা গিয়ে দুই একজন মারা গেছে।

যাওয়ার সময় সময় বেশি লাগলেও আসার সময় কম সময় লেগেছে ।যখন আমার মেয়ে ঘরে আসলো তার দুই জুতো ভর্তি কালো ছাই আর ডেবরী দিয়ে। সন্ধ্যা থেকে দলে দলে ভাগ হয়ে আট  দশ টি দল সেখানে যায় একটা যায় আর একটা নেমে আসে যাতে গ্যাঞ্জাম না হয়। একটা সিস্টেম ফলো করে বলে সবায় সুন্দর করে দেখতে পায়।

প্রথম দিনের অ্যাডভেনচার এই ভাবে শেষ হল ।

লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস ,লন্ডন

 

 

২৩৪জন ২৩২জন
0 Shares

একটি মন্তব্য

  • হালিমা আক্তার

    সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে কতো ভাবে সাজিয়েছে। চমৎকার বিশ্লেষণ মূলক লেখা। জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, মৃত্ আগ্নেয়গিরি। ভূগোল এর ছাত্রী হিসেবে বিষয় গুলো ধারণা থাকলেও দেখা হয় নাই। আপনার বর্ণনায় দেখা হলো। ইতালিতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে দুটো নগরীর ধ্বংসাবশেষ হয়তো এখনো আছে। জীবন্ত আগ্নেয়গিরির চেয়ে ভয়ানক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ